দুপুর দেড়টায় নয়, বিকাল ৫টায় ফিরছেন নিশাত -মুহিত
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ০৭:১১, জুন ৩, ২০১২
ঢাকা: দেশের প্রথম নারী এভারেস্ট বিজয়ী নিশাত মজুমদার ঢাকায় ফিরছেন রোববার বিকালে। সঙ্গে ফিরছেন তার সঙ্গী দ্বিতীয় বারের মতো এভারেস্ট জয়ী এম এ মুহিত। তাদের সঙ্গে আরো আসছেন তাদের গাইড মিংমা গ্যালজে শেরপা।
প্রসঙ্গত, তাদের ঢাকায় ফেরার কথা ছিল দুপুর দেড়টায়। কিন্তু তাদের জন্য নির্ধারিত বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেওয়ায় ফ্লাইট পিছিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে তাদের দেশে ফেরার সময়টাও পিচিয়ে যায় সাড়ে ৩ ঘণ্টা। অপরদিকে, এভারেস্ট বিজয়ী দ্বিতীয় বাংলাদেশি নারী ওয়াসফিয়া নাজরীনও তার বিপদসঙ্কুল এভারেস্ট যাত্রা শেষ করে নিরাপদে নেমে এসেছেন লুকলায়। শুক্রবার লুকলায় এলেও খারাপ আবহাওয়ার কারণে সেখান থেকে তিনি কাঠমান্ডু আসতে পারছেন না। আবহাওয়া ভালো থাকলে রোববারই কাঠমান্ডুগামী হেলিকপ্টারে উঠবেন তিনি। এরপর নানা আনুষ্ঠানিকতা সেরে দু’তিনদিনের মধ্যে ঘরে ফিরে আসবেন এভারেস্ট জয়ী দেশের দ্বিতীয় নারী ওয়াসফিয়া।
রোববার বিকাল ৫টায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে (বিজি-৭০২) হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবেন নিশাত-মুহিত।তার সকালেই নেপালের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে এভারেস্ট জয়ের সনদ গ্রহণ করেন বলে জানা গেছে।
ঢাকায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুই পরিবারের সদস্য, নিশাতের কর্মস্থল ঢাকা ওয়াসা এবং বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্র্যাকিং (বিএমটিসি) ক্লাবের পক্ষ থেকে বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা দেওয়া হবে।
নিশাত মজুমদার ও এমএ মুহিত দুজনই বিএমটিসি’র সদস্য এবং তাদের এভারেস্ট অভিযানের অন্যতম উদ্যোক্তা বিএমটিসি।
নিশাতের বাবা আব্দুল মান্নান মজুমদার এবং বিএমটিসি’র কর্মকর্তারা আরো জানান, দেশের প্রথম নারী-পুরুষ এভারেস্ট অভিযানের সফল অভিযাত্রী নিশাত-মুহিতকে সংবর্ধনা জানাতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঢাকায় অবতরণের পর তাদের দু’জনকে নিয়ে বর্ণাঢ্য গাড়ি ৠালি বের করা হবে। ৠালিটি বিমানবন্দর থেকে শুরু হয়ে শহীদ মিনার হয়ে তাঁতিবাজার গিয়ে শেষ হবে। নিশাতের প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসাও সংবর্ধনার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
সংবর্ধনা দেবে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ও, তবে বাংলাদেশের অপর নারী এভারেস্ট জয়ী ওয়াসফিয়া নাজরীন দেশে ফেরার পর। ক্রীড়া মন্ত্রণালয় নিশাত, মুহিত, ওয়াসফিয়া ছাড়াও সংবর্ধিত করবে পৃথিবীর সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো মুসা ইব্রাহীমকে, একই অনুষ্ঠানে।
১৯ মে সকাল নয়টা ৩০ মিনিটে এভারেস্টের সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠেন নিশাত মজুমদার ও এম এ মুহিত। এর ঠিক এক সপ্তাহ পর ২৬ মে সকাল ছয়টা ৩১ মিনিটে সেখানে পা রাখেন ওয়াসফিয়া নাজরীন। ২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন মুসা ইব্রাহিম। এরপর ২০১১ সালের ২১ মে দ্বিতীয় বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন এমএ মুহিত। এবার মুহিতের দ্বিতীয় বারের মতো এভারেস্ট জয়, যা বাংলাদেশের পর্বতারোহণের ইতিহাসে অনন্য। তাছাড়া আগেরবার মুহিত তিব্বতের দিক থেকে এভারেস্ট চূড়া জয় করেন। এবার করেন নেপালের দিক থেকে। ফলে তিনিই একমাত্র বাঙালি যিনি উত্তর ও দক্ষিণ দুই দিক থেকেই এভারেস্ট জয়ের রেকর্ড গড়েছেন।
নিশাত ও মুহিত তাদের এই অভিযান বাংলাদেশের তরুণদের উৎসর্গ করেছেন।
উল্লেখ্য, ৯ এপ্রিল এভারেস্টেরে উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু ঢাকা ওয়াসার হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা নিশাত মজুমদার। তবে ২৭ এপ্রিল তুষারধসে তিনি সামান্য আহত হন। হিমালয়ান রেসকিউ অ্যাসোসিয়েশন বেসক্যাম্পে মেডিকেল ক্যাম্প থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফের যাত্রা শুরু করেন।
সফল অভিযান শেষে ২২ মে বেসক্যাম্পে ফেরেন নিশাত ও মুহিত। এরপর ২৭ মে লুকলায় নামেন তারা। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার কারণে বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় সেখানে যাত্রাবিরতি করতে হয় তাদের। অবশেষে ৩১ মে আবহাওয়া ভালো হলে হেলিকপ্টারে করে সকাল ১০টায় নেপালের কাঠমান্ডু ত্রিভুবন বিমানবন্দরে নামেন।
ত্রিভুবন বিমানবন্দরে নিশাত ও মুহিতকে ফুলের মালা ও উত্তরীয় দিয়ে বরণ করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা (হিসাব) হারুন অর রশীদ, সুইস বেকারির স্বত্বাধিকারী উলফাত কাদের, পর্বতারোহী মীর শামসুল আলম, কায়সার কাদের, বাংলাদেশ ঘুড়ি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মৃধাসহ অনেকেই।
বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত নিম চন্দ্র ভৌমিকের আমন্ত্রণে তার বাসভবনে চা-চক্রে যান নিশাত ও মুহিত। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিলেন নাট্যব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ।
রাষ্ট্রদূতের বাসা থেকে নিশাত ও মুহিত যান তিব্বত গেস্টহাউসে। সেখানে দু’দিন অবস্থান করে নানা আনুষ্ঠানিকতা সারেন তারা।
শুক্রবার সকালে প্ল্যান, নেপাল সংবর্ধনা দেয় নিশাত মজুমদার ও এম এ মুহিতকে। নিশাত-মুহিতের এবারের এভারেস্ট অভিযানের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল। এ প্রতিষ্ঠানের ‘বিকজ আই অ্যাম এ গার্ল’- প্রকল্পের প্রচারণার কাজে সহায়তা করবেন নিশাত। উল্লেখ্য, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল আগামী ১১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী ‘বিকজ আই অ্যাম এ গার্ল’ প্রচারাভিযানের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করতে যাচ্ছে।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নিমচন্দ্র ভৌমিক।
অনুষ্ঠানে নিশাত মজুমদারের এভারেস্ট অভিযানের ছবি নিয়ে একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। নিশাতের এই জয়কে বাংলাদেশের আশাবাদ ও সম্ভাবনার প্রতীক বলে উল্লেখ করেন প্ল্যান নেপালের কান্ট্রি ডিরেক্টর ডোনাল কিয়ান। এ সময় নেপালে এভারেস্ট উইমেন সেভেন সামিটস ইকো অ্যাকশন সংস্থার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ১৯৮১ সালের ৫ জানুয়ারি নিশাতের জন্ম লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জে । বাবা ব্যবসায়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মান্নান মজুমদার ও মা গৃহিণী আশুরা মজুমদার। দুই ভাই-দুই বোনের মধ্যে নিশাত দ্বিতীয়। তাকে তার পরিবারের সদস্যরা নিশু নামে ডাকেন। দুই বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় আসেন নিশাত। ১৯৯৭ সালে রাজধানীর বটমূলী হোম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৯৯ সালে শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ঢাকা সিটি কলেজ থেকে হিসাববিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন তিনি।
নিশাত একমাত্র বাংলাদেশি নারী হিসেবে ইতিমধ্যে সর্বোচ্চ ৭২০০ মিটার পাড়ি দিয়ে তিনটি পর্বত জয় করেছেন। ২০০৩ সালে এভারেস্ট বিজয়ের ৫০ বছর পূর্তিতে সে সময়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ (৩,১৭২ ফুট) কেওক্রাডং জয় করেন তিনি। এ আয়োজনে ছিল বাংলাদেশ অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন।
২০০৬ সালের মার্চে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বাংলাদেশের নারী অভিযাত্রী দলের সঙ্গে আবারও কেওক্রাডং চূড়ায় ওঠেন তিনি। এই আয়োজনে ছিল বিএমটিসি।
২০০৭ সালের মে মাসে বিএমটিসি’র অর্থায়নে দার্জিলিংয়ের হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে মৌলিক পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ নেন। একই বছর সেপ্টেম্বরে হিমালয়ের মেরা পর্বতশৃঙ্গ (২১ হাজার ৮৩০ ফুট) জয় করেন নিশাত মজুমদার।
২০০৮ সালের মে মাসে হিমালয়ের সিঙ্গুচুলি পর্বতশৃঙ্গে (২১,৩২৮ ফুট) ওঠেন। একই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি ভারতের উত্তর কাশীর গঙ্গোত্রী হিমালয়ের গঙ্গোত্রী-১ পর্বতশৃঙ্গে (২১,০০০) বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অভিযানে অংশ নেন। নিশাত ২০০৯ সালের এপ্রিলে বিশ্বের পঞ্চম উচ্চতম শৃঙ্গ মাকালুতে (২৭,৮৬৫ ফুট) ভারত-বাংলাদেশ যৌথ অভিযানে অংশ নেন। ২০১০ সালে তিনি নেপাল-বাংলাদেশ মৈত্রী পর্বতশৃঙ্গ ((২০,৫২৮ ফুট) জয় করেন। সর্বশেষ ২০১১ সালে মানাসুলু অভিযানে অংশ নিয়ে ৭,০০০ মিটার পর্যন্ত আরোহন করেন নিশাত।
ভারতের ব্রিটিশ সার্ভেয়ার জেনারেল স্যার জর্জ এভারেস্টের নামে পর্বতশৃঙ্গটির নামকরণ করা হয়েছে। স্যার জর্জ সর্বপ্রথম এভারেস্টের অবস্থান নির্ণয় করেন এবং এর উচ্চতা মাপেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এভারেস্টের উচ্চতা ৮,৮৪৮ মিটার (২৯ হাজার ২৯ ফুট)।
১৯৫৩ সালের ২৯ মে নিজজিল্যান্ডের স্যার এডমন্ড হিলারি এবং নেপালের দরিদ্র শেরপা তেনজিং নোরগে সর্বপ্রথম এভারেস্ট শৃঙ্গ জয় করে সেখানে মানুষের জয়পতাকা ওড়ান।
১৯৭৫ সালের ১৬ মে জাপানের জুনকো তাবেই বিশ্বের প্রথম নারী হিসেবে এভারেস্ট জয় করেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নারী হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ এ পর্বত জয় করেন স্টেসি অ্যালিসন ১৯৮৮ সালে। তবে প্রথম বাঙালি নারী হিসেবে ভারতের শিপ্রা মজুমদার ২০০৯ সালে এভারেস্ট জয় করেন।
বাংলাদেশ সময় : ০৭১০ ঘণ্টা, জুন ০২, ২০১২ এসএআর/সম্পাদনা : অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর