গাড়লে ভাগ্যবদল

কাওছার উল্লাহ আরিফ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম | আপডেট: ১৪:৫৭, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৩

বগুড়া: ভেড়ার বৈশিষ্ট্যের একটি জাত গাড়ল। বগুড়ার বিভিন্ন উপজেলায় অনেক উদ্যোক্তা গাড়ল পালন করে বেশ লাভের মুখ দেখছেন। চাকরির পেছনে না ছুটে যদি শিক্ষিত বেকার তরুণরা গাড়ল পালনে এগিয়ে আসে তাহলে অল্প দিনেই সফলতা মুখ সহজেই দেখতে পাবে।

মঙ্গলবার (৭ ফেব্রুয়ারি) জেলার কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখা যায়, গাড়ল পালনে উদ্যোক্তাদের নানান কর্মকাণ্ড।

সরেজমিনে দেখা যায়, বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলায় গত তিন বছরে গাড়লের ৩ থেকে ৪টি খামার গড়ে উঠেছে। ব্যক্তি উদ্যোগে অনেক গৃহস্থ ও কৃষক গাড়ল পালন করছেন। গাড়ল ভেড়ার একটি জাত।  এরা ভেড়ার মতোই নিরীহ ও বোকা। দেখতে ভেড়ার চেয়ে কিছুটা সুন্দর। অনেকটা দুম্বার মতো।

জানা যায়, গাড়ল পালন করা খুবই লাভজনক। এতে খরচ কম হয় লাভ হয় বেশি। দেশে গাড়ল পালনের অপর সম্ভবনা রয়েছে। স্বাদ ও পুষ্টিগুণ বেশি হওয়ায় এর মাংসের চাহিদা ব্যাপক। গাড়ল দেখতে ভেড়ার মতো হলেও ভেড়া নয়। ভারতের নাগপুর অঞ্চলের ছোট নাগপুরি জাতের ভেড়ার সঙ্গে আমাদের দেশি ভেড়ার ক্রসব্রিড। এই ক্রসব্রিডের নাম গাড়ল। গাড়ল এবং ভেড়ার সমন্বয়ে জন্ম নেওয়া বাচ্চাকে ক্রসব্রিড বলা হয়েছে। গাড়ল ভেড়ার থেকে বড় হয় এবং এর লেজ লম্বা হয়।

বগুড়া সারিয়াকান্দি উপজেলার ধাপ এলাকায় নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা যমুনা গাড়ল খামার এর প্রো. মো. আশরাফ আলী বাংলানিউজকে বলেন, তিনি অবসর প্রাপ্ত প্রকৌশলী। প্রায় তিন বছর আগে ছেলেকে নিয়ে ৪০ শতক জায়গার ওপর গাড়লের খামার গড়ে তোলেন। তাদের খামারে প্রথমে মেহেরপুর, টাঙ্গাইল জেলা থেকে গাড়ল সংগ্রহ করা হয়। গাড়ল বিভিন্ন পরিবেশের সঙ্গে সহজে মানিয়ে নিতে পারে। এ জন্য পালন করা খুব সহজ। ভেড়ার জাত গাড়ল পশু হিসেবে কোরবানিও দেওয়া যায়। 

গাড়ল সাধারণত কাঁচা ঘাস, গাছের পাতা, বিচুলী, ভূষি, খৈলসহ সব ধরনের খাবার খেয়ে থাকে। ভেড়ারমতো গাড়লও একে উপরের অনুসরণ করে চলে। এ জন্য গাড়ল পালন করা অনেক সহজ। তবে পুরুষ গাড়ল শান্তশিষ্ঠ দেখা গেলেও রাগি প্রকৃতির। সুযোগ পেলে মাথা দিয়ে আঘাত করে।

তিনি আরও বলেন, যমুনার চরে তাদের জমি রয়েছে। কিছু জমি এগ্রিমেন্ট নেওয়া হয়েছে। গাড়ল ও গরুর জন্য সে জমিতে নেপিয়ার ঘাস চাষাবাদ করা হয়। খাওয়ানোর জন্য প্রতিদিন সকাল ১০টার দিকে গাড়লগুলোকে নৌকাযোগে চরের জমিতে নিয়ে যাওয়া হয়। আবার নিয়ে আসা হয় সন্ধার আগে। শীতকালে এদের গ্রথ কম হয়ে থাকে এবং গড়মকালে বৃদ্ধি পায় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।  

মো: আশরাফ আলীর ছেলে কৃষি কর্মকর্তা মো. নাজমুস সাদাত শাওন বাংলানিউজকে বলেন, প্রথমে ৬৫টি গাড়ল নিয়ে খামার করলেও এখন ১৫০টি গাড়াল এবং কয়েকটি গরু পালন করছেন তারা। গাড়লের সংখ্যা আরও বেশি ছিল। সম্প্রতি কিছু গাড়ল বিক্রি করেছেন। গাড়ল সব পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারে। এদের রোগব্যাধি অনেক কম। এ জন্য গাড়ল পালন সহজ। প্রতি ৭ মাস পর পর গাড়ল বাচ্চা দেয়। প্রসবকালে ২টি পর্যন্ত বাচ্চা হয়। ৪ থেকে ৫ মাসের একটি গাড়লের বাচ্চার দাম ৬ থেকে ৮ হাজার টাকা। মাদি গাড়ল বিক্রি হয় প্রতিটি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকায়। গর্ভবতী গাড়ল বিক্রি হয় ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকায়। পাঠা গাড়ল বিক্রি হয় প্রতিটি ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকায়। গাড়লের মাংস ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। এর মাংস সুস্বাধু হওয়ায় চাহিদা বেশি। পূর্ণ বয়স্ক গাড়লের ওজন ৫৫ থেকে ৬০ কেজি পর্যন্ত হয়। চাকরি না খুঁজে গাড়ল খামার করেই স্বাবলম্বী হতে পারেন অনেকেই। গাড়ল পালনে বাড়তি খাবারের প্রয়োজন নেই। আগামীতে এক থেকে দের হাজারের মতো গাড়লের সংখ্যা বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, দিন দিন গাড়ল পালনে বাড়ছে কর্মসংস্থান। তার খামারে ৪ থেকে ৫ জন মানুষ কাজে নিয়োজিত। তিনি এলাকার অনেক বেকার যুবককে গাড়ল পালনে সহযোগিতা করেছেন। তাদের আজ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে। 

মো. নাজমুস সাদাত শাওন বলেন, গাড়লের লোমগুলো সূক্ষ্ম। বিদেশে চিকন লোমের ইকোনমিক ভেল্যু বেশি। ভেড়ার লোম কিছুটা মোটা। সেই হিসেবে গাড়লের লোমের চাহিদা বেশি। এখনও দেশে গারলের বড় খামার গড়ে ওঠেনি। সারিয়াকান্দিসহ কয়েকটি এলাকায় ছোট আকারে খামার গড়ে উঠছে। গাড়ল গবেষণার পর ইকোনমিক ভেল্যু বিবেচনায় বড় আকারে খামার তৈরিতে জনসাধারণের মধ্যে উৎসাহ দেখা দিতে পারে।

পৌর এলাকার কলনীপাড়ার মো. জিহাদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সারিয়াকান্দি এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে যারা গাড়ল পালন করছেন তিনি তাদের একজন। তিনি পেশায় একজন ছ’মিল ব্যবসায়ী। তবে তার দীর্ঘদিনের শখ ছিল সে গাড়ল পালন করবে। তাই যমুনা গাড়ল খামার থেকে তিান ৫টি গাড়ল ৬০ থেকে ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করেন। এখন তার খামারে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকার গাড়ল রয়েছে। বছর না ঘুরতেই তিনি দ্বিগুন টাকার সম্ভাবনা দেখছেন।

তিনি বলেন, পড়াশুনা শেষ করার পর চাকরি না খুজে অনেকেই নিজ উদ্যোগেই এলাকায় গাড়ল খামার করছেন। প্রতিটি গাড়ল ১৪ মাসে দুটি করে বাচ্চা দেয়। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি মাসে আয় হয় প্রায় ২০-২৫ হাজার টাকা। এই অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণ চারণভূমি থাকায় মাঠ থেকেই খাদ্য পাওয়া যায়। ফলে গাড়ল চাষ করে সহজেই লাভবান হচ্ছেন। তিনি ছ’মিলের জন্য কেনা গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করেও গাড়লগুলোকে খাওয়ান। সে হিসেবে গাড়লগুলোকে খাওয়ানোর জন্য বাড়তি কিছু কিনতে হয় না তার।
  
এদিকে, আমাদের দেশে ছাগলের খামারে বেশ লাভবান হচ্ছেন। ব্লাক গোট (কালো ছাগল) বিশ্বে সুনাম কুড়িয়েছে। গাড়লের চাহিদা বেড়ে গেলে এ খামার সুনাম অর্জন করবে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ও সুন্দরবন এলাকায় গাড়লের সংখ্যা বেশি। তবে খামরিদের সংখ্যা কম। বগুড়া জেলায় বর্তমানে ভেড়ার সংখ্যা ১ লাখ ৬২ হাজার। এর মধ্যেই গাড়লও আছে। ভেড়ার মাংসের চেয়ে অনেক বেশি উপাদান মেলে গাড়লের মাংসে। যা মানব শরীরের জন্য বড় ভূমিকা রাখে। গাড়লের মাংসে জিঙ্ক, আয়রণ, পটাশিয়াম, ফসফরাস, সেলিনিয়াম ভিটামিন-বিসহ কয়েক প্রকারের খনিজ রয়েছে। রোগ প্রতিরোধ ও শরীরে ইমিউনিটি বাড়াতে বিদেশে গাড়লের মাংসের পরিমিতি খাবার গুরুত্ব পেয়েছে।

এ বিষয়ে বগুড়া জেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা ডা. সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, গাড়ল পালন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি পুষ্টির চাহিদা পূরণ হচ্ছে। পুষ্টির উৎস হিসাবে গাড়লের গুরুত্ব গরু-ছাগলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। গাড়লের মাংসে কোলেস্টেরল অনেক কম। সব বয়সী মানুষ এর মাংস খেতে পারে। এ কারণে গাড়লের খামারে প্রতি অনেকের আগ্রহ দেখাচ্ছেন ও দিন দিন এর প্রসার বাড়ছে। গাড়ল পালনে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে। কিভাবে গাড়লকে উন্নত প্রজননে টিকে রাখা রায় সেই গবেষণা চলমান বলেও মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৩
কেইউএ/এসএম


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : তৌহিদুল ইসলাম মিন্টু

ফোন: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮১, +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২১৮২ আই.পি. ফোন: +৮৮০ ৯৬১ ২১২ ৩১৩১ নিউজ রুম মোবাইল: +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৬, +৮৮০ ১৭২ ৯০৭ ৬৯৯৯ ফ্যাক্স: +৮৮০ ২ ৮৪৩ ২৩৪৬
ইমেইল: [email protected] সম্পাদক ইমেইল: [email protected]
Marketing Department: +880 961 212 3131 Extension: 3039 E-mail: [email protected]

কপিরাইট © 2006-2025 banglanews24.com | একটি ইস্ট-ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের (ইডব্লিউএমজিএল) প্রতিষ্ঠান