ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

জ্বালানি দুর্ভিক্ষ বনাম সিদ্ধান্তহীনতার মূল্য

জাহিদ নেওয়াজ খান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২২ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১১
জ্বালানি দুর্ভিক্ষ বনাম সিদ্ধান্তহীনতার মূল্য

‘শেল অয়েলের সহিত দাবি নিষ্পত্তি চুক্তি’ এ শিরেনামে ১৯৭৫ সালের ১১ আগস্ট একটি সংবাদ প্রকাশ করে দৈনিক ইত্তেফাক। খবরে বলা হয়: “বাংলাদেশে শেল অয়েল কোম্পানির গ্যাস অনুসন্ধান ও গ্যাসক্ষেত্র কার্যক্রমের ব্যাপারে সকল প্রশ্নের নিষ্পত্তি করিয়া গত শনিবার (৯ আগস্ট) ঢাকায় কোম্পানির সহিত বাংলাদেশ সরকারের এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

সরকারি হ্যান্ডআউটে প্রকাশ, শেল যে সকল গ্যাস ক্ষেত্রে জড়িত ছিল, সেইগুলি বর্তমানে শতকরা একশত ভাগ সরকারি মালিকানায় আনিয়া পেট্রোবাংলার অধীনে বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড লিমিটেড এর হাতে দেওয়া হইয়াছে। চুক্তি অনুসারে শেল কোম্পানি স্থিরীকৃত একটি অর্থ লাভ করিবে। চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হাবিবুর রহমান, শেল অয়েল কোম্পানির আর এইচ কিলবে, অর্থসচিব জনাব কফিলউদ্দিন মাহমুদ, পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রশাসন) মনসুর আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। ”

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার মাত্র ছয় দিন আগে সেই চুক্তি সই হওয়ার দিনটিই এখন বাংলাদেশের জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস। এমন একটি দিনকে জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস করার কারণ দুটি:

এক. ওই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ খুবই অল্প টাকায় বিশাল যে গ্যাস সম্পদের মালিক হয়েছে গত তিন যুগ ধরে দেশের গ্যাস চাহিদার এক বড় অংশ মেটাচ্ছে সেই গ্যাস।

দুই. রাষ্ট্রীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার, বঙ্গবন্ধুর এই চিন্তার বাস্তবায়ন এখন আরো বেশি জরুরি।

তবে বিশাল এ গ্যাস সম্পদ বাংলাদেশের নিজস্ব সম্পদ হওয়ার ইতিহাস কয়েক বছর আগেও  দেশের খুব কম লোকই জানতেন। এক্ষেত্রে পেট্রোবাংলার সাবেক পরিচালক, মুক্তিযোদ্ধা মকবুল এলাহির অবদান অনেক। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনিই সেই ইতিহাস নতুন করে উন্মোচন করেছেন। আর জ্বালানি খাতের ম্যাগাজিন ‘এনার্জি এন্ড পাওয়ার’ কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে সেই ইতিহাস তুলে ধরার পর গত বছর থেকে ৯ আগস্ট জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস পালন করছে সরকার।

ডাচ কোম্পানি শেল অয়েলের গ্যাস সম্পদ কিভাবে বাংলাদেশের হলো, আর সেই গ্যাস সম্পদ কিভাবে বছরের পর বছর বাংলাদেশের জ্বালানি সমস্যা সমাধানে বড় ভূমিকা রাখছে তা বুঝতে হলে সেসময় যুদ্ধ-বিধ্বস্ত একটি দেশের পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার দর্শনটিও বুঝতে হবে।

এ ভূ-খন্ডে ষাটের দশকের শেষভাগ থেকে জ্বালানি চাহিদা মেটানোর জন্য প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ শুরু হয়। বৃহত্তর সিলেটে চালু হয় একটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি এবং একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এর আগে দেশে বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র বলতে ছিলো কাপ্তাইয়ের জলবিদ্যুৎ। ছোট ছোট যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ছিলো সেগুলো ছিলো আমদানি করা জ্বালানি তেলনির্ভর। তখন গ্যাস নেটওয়ার্কও তেমন বিস্তৃত ছিলো না। দীর্ঘ সংগ্রাম এবং যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের জন্মের পর এর অর্থনৈতিক উন্নয়ন ছিলো সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এজন্য জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করার বিষয়টিও কম বড় চ্যালেঞ্জ ছিলো না। ফলে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন পরিকল্পনার পাশাপাশি জ্বালানির জোগান নিশ্চিত করা ছিলো বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার।  

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে ফিরে আসার মাত্র ৩ মাস ১৬ দিনের মধ্যে প্রেসিডেন্সিয়াল আদেশের মাধ্যমে গঠিত হয় বাংলাদেশ মিনারেল, অয়েল এন্ড গ্যাস কর্পোরেশন (বিএমওজিসি)। কিন্তু কয়লা, চুনা পাথর ও কঠিন শিলার মতো সম্পদ অনুসন্ধান এবং আহরণের কাজ জোরদার করার জন্য বিএমওজিসিকে পরে ভাগ করে এক বছরের মধ্যেই গঠিত হয় বাংলাদেশ অয়েল এন্ড গ্যাস কর্পোরেশন (বিওজিসি) এবং বাংলাদেশ মিনারেল এক্সপ্লোরেশন এন্ড ডেভলেপমেন্ট কর্পোরেশন (বিএমইডিসি)।  

নতুন প্রতিষ্ঠান গঠনের সঙ্গে সঙ্গে সংবিধানে উল্লেখ করে প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহারও নিশ্চিত করেছিলো সেই সময়ের সরকার। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা আছে:

১. সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে।
২. মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ সুবিধাদান নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।    

সংবিধানের এই মূলমন্ত্রকে মৌলনীতি হিসাবে গ্রহণ করেই বঙ্গবন্ধু দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য সকলের কাছে জ্বালানি সুবিধা পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে কাজ শুরু করেন। সদ্য স্বাধীন দেশে পরিত্যক্ত হিসাবে পাওয়া শিল্প এবং খাতগুলোকে পুর্নগঠন করার জন্য জাতীয়করণ আইন করা হয়। পাকিস্তান পেট্রোলিয়াম লিমিটেড (পিপিএস) এর ফেলে যাওয়া ছাতক ও হরিপুর গ্যাস গ্যাস ক্ষেত্র নিয়ে গঠিত হয় বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম লিমিটেড (বিপিএল)। এর ফলে বেসরকারি মালিকানা থেকে এই দুটি গ্যাস ক্ষেত্রের মালিকানা রাষ্ট্রের কাছে চলে আসে। বিপিএল পরে ১৯৮২ সালে কাজ শুরু করে সিলেট গ্যাস ফিল্ড লিমিটেড নামে।

অন্যদিকে রয়্যালটির আওতায় এ ভূ-খন্ডে ৬০ এর দশক থেকে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করে আসছিলো শেল বিভি। তারা আবিষ্কার করে তিতাস, বাখরাবাদ, হবিগঞ্জ, রশিদপুর ও কৈলাসটিলা গ্যাস ক্ষেত্র। এর মধ্যে তিতাস এবং হবিগঞ্জ থেকে ৩টি কূপের মাধ্যমে গ্যাস উত্তোলন এবং বিতরণের কাজ করছিলো তারা। এজন্য ৫টি গ্যাস ফিল্ডের পুরো মালিকানার সঙ্গে বিতরণ কোম্পানি তিতাসের মালিকানার একটি বড় অংশও ছিলো শেলের হাতে।

শেলের ওই গ্যাস সম্পদ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসার ক্ষেত্রে অন্য অনেক কিছুর সঙ্গে প্রধান যে কারণটি কাজ করেছে তা হলো সে সময়ের তেল সংকট।

৭৩ সালে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সদ্য স্বাধীন দেশ বেশ বিপাকে পড়ে। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য দেশীয় জ্বালানি সম্পদ কিভাবে ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে নতুনভাবে কাজ শুরু করে সেসময়ের আওয়ামী লীগ সরকার। তখন সরকারের সুষ্পষ্ট নীতি ছিলো দেশীয় জ্বালানি সম্পদ আহরণ এবং এর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে ১৯৪৮ সালের পেট্রোলিয়াম আইন সংশোধন করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম অ্যাক্ট ১৯৭৪ প্রণয়ন করা হয়। এতে সকল জ্বালানি সম্পদের মালিকানা শতভাগ রাষ্ট্রের উপর ন্যস্ত করে চালু করা হয় পিএসসি’র মাধ্যমে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের বিধান। আর আগে থেকে যারা কাজ করছিলো তাদের জন্য নতুন করে অনুমতি নেওয়ার বিধান বাধ্যতামূলক করা হয়।

পেট্রোলিয়াম আইন সংসদে পাস হয় ১৯৭৪ সালের ২২ আগস্ট। আইন অনুযায়ী আইন পাসের ৬ মাস পর ১৯৭৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শেলের ৫টি গ্যাস ক্ষেত্রের মধ্যে যে তিনটি অপারেশন শুরু করেনি সেই রশিদপুর, কৈলাসটিলা এবং বাখরাবাদের দখল বুঝে নেয় পেট্রোবাংলা। গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে পেট্রোবাংলার মালিকানা সাইনওবোর্ডও টানিয়ে দেয়া হয়। সেসময় বাখরাবাদের দায়িত্ব বুঝে নেন পেট্রোবাংলার পরিচালক প্রশাসন মনসুর আহমেদ এবং রশিদপুর ও কৈলাসটিলা ফিল্ডের পেট্রোবাংলার কোÑঅর্ডিনেশন অফিসার এম বদরুদ্দোজা।

এর আগে অবশ্য শেলকে সরকারের পক্ষ থেকে গ্যাস বিতরণ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র উন্নয়ন করার জন্য অনুরোধ জানানো হলে তারা তা অবজ্ঞা করে। গ্যাস ক্ষেত্রের দখল নেয়ার পর টনক নড়ে শেল এর প্রধান কার্যালয়ের। ওই বছরের মে মাস থেকে আলোচনা শুরু হয়। বাংলাদেশের পক্ষে আলোচনায় নেতৃত্ব দেন সেসময়ের অর্থসচিব কফিল উদ্দিন মাহমুদ এবং পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ও সচিব ড. হাবিবুর রহমান।

আলোচনায় শেলকে তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির শেয়ারসহ সব মালিকানা বিক্রি করে দেয়ার প্রস্তাব দেয় সরকার। আলোচনার সফল সমাপ্তি শেষে ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট বাংলাদেশ এবং শেলের মধ্য চুক্তি হয়। এতে ৫টি গ্যাস ফিল্ড এবং তিতাস বিতরণ কোম্পানির শতভাগ মালিকানা পায় বাংলাদেশ। দাম ঠিক করা হয় সাড়ে ৪ মিলিয়ন পাউন্ড বা ১৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এই অর্থ বাংলাদেশ সরকার বছরে দুটি করে মোট ১৮টি সমান কিস্তিতে পরিশোধ করে। গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে বর্তমানে দৈনিক ৮৪০ থেকে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। যা মোট গ্যাস উৎপাদনের ৪৩ ভাগ। আর এ গ্যাসের দৈনিক বিক্রিমূল্যই ১০ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০১০ সালের জুন হিসাব থেকে দেখা যায়, সেসময় পর্যন্ত ৬.৫২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট (টিসিএফ) গ্যাস উত্তোলন করা হয়, যার বিক্রিমূল্য প্রায় ৭৯ হাজার কোটি টাকা। এই ফিল্ডগুলোতে মোট গ্যাস ইনিশিয়াল ইন প্লেস (জিআইআইপি) ছিল ১৮.৬৮ টিসিএফ, যা দেশের মোট আবিষ্কৃত গ্যাস মজুদের ৬৫ শতাংশ। পি১ এবং পি২ মিলিয়ে এগুলোর মোট বর্তমান মজুদের পরিমাণ ৬.৮০ টিসিএফ, যার বিক্রিমূল্য বর্তমান দামে প্রায় ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
 
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মনসুরের মতে, বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তার ভিত্তি অর্জিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ওই সফল সিদ্ধান্তে শেলের কাছ থেকে গ্যাস সম্পদ কিনে নেয়ার মধ্য দিয়ে। আর এই বিবেচনা থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে চুক্তির দিনটিকে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তিনি বলছেন, বঙ্গবন্ধুর নীতি ছিলো দেশীয় জ্বালানি সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা, বর্তমান সরকারও সেই লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে।

অবশ্য সেসময়ের বাস্তবতায় বঙ্গবন্ধু শুধু শেলের গ্যাস রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। ৭৩ সালের অয়েল-শকের পর বাংলাদেশে নিজস্ব তেল গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন এবং সেসময়ের বিশ্বসেরা জিওলজিস্ট ও পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হাবিবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে ইন্দোনেশিয়ার অনুসরণে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের জন্য মডেল পিএসসি দলিল চূড়ান্ত করা হয়। আগে প্রচলিত কনসেশন বা রয়্যালটি ব্যবস্থায় আবিষ্কার হওয়ার তেল বা গ্যাসের মালিকানা কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের হাতে চলে যাওয়ার বিপরীতে পেট্রোলিয়াম অ্যাক্ট এবং পিএসসি দলিলের মাধ্যমে সম্পদে রাষ্ট্রের শতভাগ মালিকানা নিশ্চিত করা হয়।

পিএসসি দলিল চূড়ান্ত হওয়ার পর সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হলে তাতে ব্যাপক সাড়া মেলে। এই অঞ্চলের মধ্যে এটিই ছিলো সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের প্রথম উদ্যোগ। দরপত্রের মাধ্যমে মাত্র ৯ মাসে বঙ্গোপসাগরের ৮টি ব্লকের জন্য ৬টি কোম্পানির সাথে পিএসসি সই করা হয়। সব কোম্পানি মিলে সাগরে ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার সাইসমিক সার্ভের কাজ করে। খনন করা হয় বেশ কয়েকটি অনুসন্ধান কূপ। কিন্তু এরমধ্যে শুধুমাত্র ইউনিয়ন অয়েল নামের একটি আমেরিকান কোম্পানি কুতুবদিয়ায় একটি ছোট গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করে। আর সেসময় বিশ্ববাজারে গ্যাসের তেমন কোনো বড় চাহিদা না থাকার কারণে কোম্পানিগুলো আগ্রহ হারাতে থাকে। এক সময় তারা ব্লকগুলো ছেড়ে চলে যায়।

একই সময় বঙ্গবন্ধু সরকার বিকল্প জ্বালানি উৎস কয়লা উত্তোলনের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে সপরিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকান্ডের পর নিজস্ব জ্বালানি অনুসন্ধান এবং এর ব্যবহার বাড়ানোর কাজে ভাটা পড়ে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামল পর্যন্ত কাজের ধারা কিছুটা অব্যাহত থাকলেও পরে আর তা ধরে রাখা যায়নি।

৯০ এর ৬ ডিসেম্বর দীর্ঘ সামরিক ও স্বৈরশাসনের অবসানের পর নির্বাচিত বিএনপি সরকার পিএসসি মডেল অনুসরণ করে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের কাজ শুরু করলেও তাতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে কোম্পানি নির্বাচনের বিষয়টি ব্যাহত হয়। বিশেষ করে সেময় আবিস্কার করা সিলেটের জালালাবাদ গ্যাস ক্ষেত্র পিএসসির আওতায় উন্নয়নের জন্য অক্সিডেন্টালকে দিয়ে দেয়ার বিষয়টি যথাযথ সিদ্ধান্ত ছিলো না বলে অনেকেই মনে করেন। ওই সরকারের সময় দেশের কয়লা সম্পদ উন্নয়নের জন্য চীনের সহায়তায় বড়পুকুরিয়ায় একটি আন্ডারগ্রাউন্ড খনির কাজ শুরু হয়। কিন্তু খনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তখন সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে এই খনি উন্নয়ন করতে না পারার কারণে এটি দেশের তেমন কোনো উপকারে আসেনি। গত ৫ বছর খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হলেও চলতি বছরই এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে অষ্ট্রেলিয়া প্রবাসী খনি বিশেষজ্ঞ মাসুদ হোসেন তার এক পর্যবেক্ষণে বলেছেন, বড়পুকুরিয়ায় আন্ডারগ্রাউন্ড খনি করার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই ঠিক ছিলো না। সেখানকার জিওলোজিক্যাল স্ট্রাকচার অনুসারে উন্মুক্ত খনি হওয়া উচিত ছিলো। তার মতে এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র।

১৯৯১-৯৬ মেয়াদের বিএনপি সরকারের পর আবারো ক্ষমতায় আসে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ। জ্বালানি নিরাপত্তার বিচারে ৯৬ থেকে ২০০১ শাসনামল ছিলো মোটামুটি একটি সফল সময়। সেসময় পিএসসির মাধ্যমে বেশ কয়েকটি ব্লকে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে চুক্তি হয়। তাতে দেশীয় সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগের অংশ হিসাবে প্রতিটি ব্লকে দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের জন্য ১০ শতাংশ করে ক্যারিড ইন্টারেস্ট রাখা হয়। আশির দশকে গঠিত হলেও আগে বাপেক্স এর একমাত্র দায়িত্ব ছিলো তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান। ফলে কোম্পানিটি পুরেটাই ছিল সরকারের আর্থিক অনুদানের উপর নির্ভরশীল। আওয়ামী লীগ শাসনামলে বাপেক্সকে প্রকৃত অর্থেই ইএনপি অর্থাৎ একটি এক্সপ্লোরেশন এন্ড প্রোডাকশন কোম্পানি করা হয়। সেসময় ঘোষণা দেয়া হয়, সরকারের পক্ষ থেকে বাপেক্সকে বছরে চারটি অনুসন্ধান কূপের জন্য অর্থায়ন করা হবে। কিন্তু এটি আসলে কার্যকর হয়নি। এই সময়কালে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকার কারণে নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন সম্ভব হয়। আবিষ্কার হয় বিবিয়ানার মতো বড় একটি গ্যাস ক্ষেত্র। সর্বশেষ গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয় ১৯৯৯ সালে মৌলভীবাজারে।

আওয়ামী লীগ শাসনামলে চাহিদার চেয়ে গ্যাস সরবরাহ বেশি থাকলেও সেসময়ের নেতৃত্ব বুঝতে ভুল করেননি যে কেবলমাত্র গ্যাস নির্ভর বিদ্যুৎ খাত থাকলে ভবিষ্যতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা বিঘিœত হতে পারে। তাই বড়পুকুরিয়া কয়লা খনির পাশাপাশি ফুলবাড়ি কয়লা খনি উন্নয়ন ও উত্তোলনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করে সরকার। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষণের সমীকরণের কারণে ফুলবাড়ি আবিষ্কার করা কোম্পানি বিএইচপি বিলিটন বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিএইচপির স্বার্থ এশিয়া এনার্জি কিনে কয়লা উত্তোলনে আগ্রহ প্রকাশ করলে বিএনপির সময় করা চুক্তি এশিয়া এনার্জিকে অ্যাসাইন করে সরকার। এর ধারাবাহিকতায় এশিয়া এনার্জি তাদের অনুসন্ধান ও উন্নয়ন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার মাধ্যমে কাজ শুরু করে।

আবারো বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের রিট আবেদনের কারণে আইওসির সাথে পিএসসির মাধ্যমে জল ও স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধান বন্ধ হয়ে যায়। তবে সরকারের প্রথম দু বছর চাহিদা অনুসারে গ্যাস সরবরাহে কোনো ধরনের সংকট ছিলো না। এ প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগের সময় আবিষ্কার হওয়া গ্যাস ক্ষেত্রগুলো উন্নয়নের কাজ শুরু হয় বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শাসনামলের দ্বিতীয়ার্ধে এসে। তবে বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার বিচারে এ সময়টিকে বিশেষজ্ঞরা সবচেয়ে বন্ধ্যা সময় মনে করেন। পুরো সময়ই আগের সরকারের সমালোচনায় মুখর থাকে বিএনপি। আগে আবিষ্কার হওয়া গ্যাস ক্ষেত্র উন্নয়নে পদক্ষেপ নেয়া হলেও নতুন আবিষ্কারে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পুরো ৫ বছরে একমাত্র আবিষ্কার ৯ নং ব্লকের বাঙ্গুরায় একটি ছোট গ্যাস ফিল্ড। অন্যদিকে, ফুলবাড়ি কয়লা খনি উন্নয়নের জন্য এসময় এশিয়া এনার্জির পক্ষ থেকে বিজনেস ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান দেয়া হলেও সরকার বিশেষজ্ঞদের দিয়ে মূল্যায়নের নামে তা ঝুলিয়ে রাখে। অভিযোগ আছে সরকারের মিসহ্যান্ডলিং এর কারণেই এটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। দুই জনের মৃত্যুর মতো দুঃখজনক ঘটনাও ঘটে। সেসময়ই নতুন করে কয়লা নীতি করার কথা বলা হয়, কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে বিএনপি সরকারের একমাত্র প্রশংসনীয় উদ্যোগ ছিলো বাপেক্সকে শক্তিশালী করার লক্ষ্য হিসেবে ৮ ও ১১ নম্বর ব্লক বাপেক্সের নামে বরাদ্দ দেয়া।

বিএনপির সময় আশাজাগানিয়া আরেকটি প্রকল্প ছিলো বাংলাদেশ হয়ে মিয়ানামারের গ্যাস ভারতে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রেও সাফল্য পায়নি বিএনপি সরকার। সেটি সফল হলে চট্টগ্রামে এখন যে গ্যাস সংকট তা হতো না।

এরপর আসে প্রলম্বিত তত্তা¡বধায়ক সরকার। ২ বছর সময়ের মধ্যে মোট ৪ জন জ্বালানি খাতের মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় সাগরে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র গ্রহণ এবং মূল্যায়নের কাজও সে সময় শেষ হয়। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে পিএসসি সইয়ের বিষয়টি রেখে দেয়া হয় নির্বাচিত সরকারের জন্য। তত্ত্বাবধায়ক আমলে আবারো কয়লা নীতি চূড়ান্ত করার উদ্যোগও নেয়া হয়। কিন্তু এবারো তা চূড়ান্ত হয়নি। তবে তেল গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্সকে কার্যকর করার জন্য ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ৩২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার ঘোষনা দেয়া হয়। কাজ শুরুর পর বাপেক্সকে শক্তিশালী করার জন্য এটিই এ যাবত কালের সবচেয়ে বড় উদ্যোগ। বর্তমান সরকার অবশ্য গুরুত্বসহ তত্তা¡বধায়ক সরকারের নেয়া এই উদ্যোগ অব্যাহত রেখেছে।

মেয়াদকালের অর্ধেকের সামান্য বেশি সময় পার করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। দিন বদলের কর্মসূচি নিয়ে আসা সরকার এরইমধ্যে সব ক্ষেত্রে ভিশন ২০২১ ঘোষণা করে তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এই সময়কালে সবার জন্য বিদ্যুৎ পৌছে দেয়া সরকারের একটি লক্ষ্য। আড়াই বছর সময়কালে জরুরি কর্মসূচির আওতায় স্থাপিত নতুন নতুন বিদ্যুৎ কেন্দ্র যোগ হওয়ার কারণে চলতি বছর লোডশেডিং আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমে এসেছে। আর ২০১৫ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৫০০০ মেগাওয়াট করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ অব্যাহত রেখেছে সরকার।

প্লান্টের ধরণ এবং পদ্ধতি নিয়ে বির্তক থাকলেও সরকার এরইমধ্যে প্রায় ৫০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হয়েছে। আরো কমপক্ষে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কম উৎপাদন হচ্ছে গ্যাস না পাওয়ার কারণে। প্রাথমিক জ্বালানি সংকটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারকে আমদানি করা জ্বালানি তেলে যেতে হয়েছে। যা বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি করেছে এবং আরো করবে। সরকারের হিসাবে চলতি বছরের শেষে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি তেলের অবদান বেড়ে হবে ৩০ শতাংশ। আর গ্যাসের অবদান ৮৫ থেকে কমে ৬৫ শতাংশে নেমে আসবে। ফলে বিপিডিবির লোকসান বাড়ার পথ ধরে সরকারের ভর্তুকির পরিমাণ বাড়বে।

অন্যদিকে, আমদানি করা কয়লা দিয়ে প্রায় ৩,০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে তা অর্জিত হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। জাইকার মাধ্যমে করা পাওয়ার সেক্টর মাস্টার প্লানে ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসাবে কয়লাকে অগ্রাধিকার দেয়া হলেও এতে বলা হয়েছে, বর্তমান অবকাঠামো ব্যবহার করে আমদানি করা কয়লা দিয়ে কোনোভাবেই ৬০০ থেকে ৭০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব নয়। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৫ সালে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসার যে প্রাক্কলন করা হয়েছে তা অর্জিত হবে কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নিয়ে রাশিয়ার সাথে আলোচনা চললেও শিগগিরই তা হবে এমন কোনো সম্ভাবনাও নেই।

প্রাথমিক জ্বালানি খাতে বিশেষ করে গ্যাস খাতে বিগত আড়াই বছরে গ্যাসের প্রতিদিনের উৎপাদন প্রায় ২৮৪ মিলিনয় ঘনফুট বেড়েছে। হাইডোকার্বন ইউনিটের সমীক্ষায় দাবি করা হয়েছে, সামান্য কিছু প্রযুিক্তগত পরিবর্তনের মাধ্যমে দেশীয় গ্যাস ক্ষেত্র থেকে আরো ৪০০-৫০০ এমএমসিএফডি উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এ সময়কালে বাপেক্স মোট ওয়ার্কওভার, উন্নয়ন ও অনুসন্ধান মিলিয়ে ১৪টি কূপ খনন করেছে। টু-ডি এবং থ্রি-ডি সিসমিক সার্ভে হয়েছে অনেক এলাকায়। বাপেক্স এর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কাজ নিয়ে রাশান কোম্পানি গ্যাসপ্রম এবং চীনা কোম্পানি সিএনওসি আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। পিএসসির আওতায় কর্মরত শেভরন তার তিনটি ফিল্ডে এবং স্যান্টোস একটি অফশোর ফিল্ডে কাজ করছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দরপত্রে চূড়ান্ত হয়ে থাকা কনোকোফিলিপসের সাথে সম্প্রতি সরকার পিএসসি সই করেছে। সাগরের সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য জাতিসংঘের কাছে দাবি উত্থাপন করেছে বাংলাদেশ। তবে পরিকল্পনা থাকলেও স্থলভাগে গ্যাস অনুসন্ধানে এখন পর্যন্ত কোনো পিএসসি চূড়ান্ত করা যায়নি। নতুন বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া শুরু হলেও উন্মুক্ত করা হয়নি গ্যাস সংযোগের বিষয়টি।

প্রাথমিক জ্বালানি কয়লা নিয়ে দীর্ঘ ৬ বছর ধরে জমে ওঠা বির্তক নিরসণ করে কয়লা উত্তোলনেও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি সরকার। এখন পর্যন্ত কয়লা নীতি চূড়ান্ত করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। সমন্বিত জাতীয় জ্বালানি নীতি প্রণয়নের কাজও শুরু হয়নি। কিন্তু নিজস্ব কয়লা উত্তোলন না করে আমদানি করা কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সরকার ব্যাপক উৎসাহে কাজ করছে। গ্যাস অনুসন্ধান ব্যাপকভিত্তিক করা না হলেও বিদেশ থেকে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি নিয়ে নানা ব্যস্ততা চলছে বিগত দুই বছর ধরে।

বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক উত্তরাধিকার। মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় থাকলেও দেশীয় জ্বালানি সম্পদের অনুসন্ধান এবং ব্যবহারে বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রত্যয়ী। দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার ভিতও রচিত হয়েছে তার হাতে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি বিশেষজ্ঞ এবং পেশাজীবীদের সমন্বয়ে দক্ষ প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু করেছিলেন। প্রতিষ্ঠানের কাঠামোগুলো ছিল আমলাতন্ত্রমুক্ত।   সেসময় পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যান ছিলেন পেট্রোলিয়াম সচিব এবং সরাসরি মন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানের মর্যাদা কমিয়ে তাকে মন্ত্রণালয়ের অধিনে আনা হয়। বর্তমান সরকার এখনো এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির বড় কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং জ্বালানি খাতের সকল পর্যায়ে আমলাদের অনুপ্রবেশ বাড়ছে বিপজ্জনকভাবে। সেসঙ্গে জ্বালানি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ কমছে আশংকাজনকভাবে।

বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়কালেই দেশীয় জ্বালানি সম্পদ ব্যবহারের সম্ভাব্য সব সূচনাই করেছেন। কিন্তু বর্তমান সরকার নিজস্ব জ্বালানির সর্বোচ্চ ব্যবহার না করেই ঝুঁকে পড়েছে আমদানি নির্ভর জ্বালানির উপর। যা আগামীতে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে দেশের বৃহৎ জ্বালানি সম্পদ কয়লা উত্তোলনে সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতা পরিবর্তিত বিশ্বপ্রেক্ষাপটে এর ব্যবহার অনিশ্চিত করে তুলতে পারে। বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন যে দেশে জ্বালানি দুর্ভিক্ষ চলছে। কিন্তু প্রাথমিক জ্বালানির এই দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় নিজস্ব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারে সরকারের সঠিক রাজনৈতিক উদ্যোগ এখনো অনুপস্থিত। এতে রক্ষণশীলরা এবং তাদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত মানুষ আপাত খুশি হতে পারে। কিন্তু যেদিন ঘরে বাতি আর উনুন জ্বালাতে চরম সমস্যা হবে সেদিন সরাসরি সংকট বোঝা যাবে। যে সংকট এখন পার করছে বাংলাদেশের শিল্পখাত, যে কারণে পুরো অর্থনীতি। তোপখানা থেকে পল্টন পর্যন্ত মিনি শক্তির দাপট দেখানো গ্রুপগুলো এই বিলাসিতা দেখাতেই পারে। কারণ সংকট সমাধানে তাদের কোনো দায় নেই।

জাহিদ নেওয়াজ খান: বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল আই

বাংলাদেশ সময় ১৯১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।