ধলার মাঠ, মেহেরপুর থেকে ফিরে: মেহেরপুর জেলার দিগন্ত জোড়া বিস্তীর্ণ সবুজ ফসলের মাঠ ধলার মাঠ। মাঠের আয়তনের বিষয়ে একেকজনের কাছে একেক তথ্য।
মেহেরপুর সদর, গাংনী ও মুজিবনগর উপজেলাবাসীর খাদ্যভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত ধলার মাঠ। এমনকি কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা জেলার অনেক চাষীর জমিও রয়েছে এ বিশাল মাঠে।
বোরো ধান, গম, পাট, তামাক, সবজি, মসুরি, সরিষা থেকে শুরু করে সকল ধরনের ফসলের আবাদ হয় ধলার মাঠজুড়ে। চাষীদের সুবিধার্থে মেহেরপুর সদর ও গাংনী উপজেলায় মোট ৫০টি সোলার সেচ পাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে সেচ কাজের জন্য চাষীদের আর ডিজেল কিনতে হয় না।
![](files/solar_1_661410600.jpg)
মেহেরপুর সদর উপজেলার চাষী জামান আলীর ৭ বিঘা জমি রয়েছে এ মাঠে। প্রতিবার সেচ দিতে বিঘা প্রতি ৫ থেকে ৬ লিটার ডিজেল কিনতে হতো তাকে। ৬ লিটার ডিজেলের বাজার মূল্য ৪শ’ ২০ টাকা। কিন্তু এখন সোলার ইরিগেশন পাম্পের কারণে মাত্র ২শ’ টাকায় এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে পারছেন তিনি।
শুধু জামান আলীই নন, অধিকাংশ চাষীই এখন সোলার ইরিগেশন পাম্পের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। তবে খুচরা ডিজেল বিক্রেতারা পড়ে গেছেন বিপাকে। কারণ, আগের মতো কৃষি কাজের জন্য ডিজেল বিক্রি হয় না।
ধলার মাঠ সংলগ্ন খুচরা ডিজেল বিক্রেতা শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘বোরো মৌসুমে প্রতিদিন ৫শ’ থেকে ৭শ’ নিটার(লিটার) ত্যাল (ডিজেল) বিক্রি করতাম। কিন্তু সোলার এসে প্রতিদিন দুইশ নিটার ত্যাল বিককিরি হয় না’।
![](files/solar_3_519898280.jpg)
মেহেরপুরের বিভিন্ন এলাকার মাঠে মাঠে এখন নতুন করে সম্প্রসারিত হচ্ছে ব্যাটারিবিহীন সৌরবিদ্যুৎ চালিত সেচ পাম্প। অর্ধেক খরচে ঝামেলামুক্তভাবে কৃষকরা তাদের কৃষি জমিতে সৌরবিদ্যুৎ চালিত পাম্পের সেচ সুবিধা ভোগ করায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এ প্রযুক্তির চাহিদা।
ফলে জেলায় এখন দেখা দিয়েছে সবুজ কৃষি বিপ্লবের অপার সম্ভাবনা।
আর কৃষকদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে নতুন দিগন্তের। সৌরশক্তিকে ব্যবহার করে এ জেলার কৃষকরা প্রায় হাজার একর জমিতে এখন চাষ করছেন। সূর্যের আলোর সাহায্যে স্থাপিত সেচ পাম্প জমিতে সেচ ব্যবস্থায় কৃষকদের মধ্যে নতুন আশার আলো জ্বালিয়েছে। এ সেচ ব্যবস্থায় কৃষকদের জ্বালানি তেল (ডিজেল) বা বিদ্যুতের ওপর আর নির্ভরশীল হতে হবে না।
![](files/solar_5_298414238.jpg)
সময় ও অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হওয়ায় এবং কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কারণে জেলার কৃষকদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এ আধুনিক এ প্রযুক্তির সেচ পদ্ধতি।
বরগুনার বেসরকারি সংস্থা রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আরডিএফ) এবং ইনফ্রাসট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) আর্থিক সহায়তায় জেলার বিভিন্ন স্থানে সৌরবিদ্যুৎ চালিত সোলার সেচ পাম্প স্থাপন করা হচ্ছে।
মেহেরপুর সদর ও গাংনী উপজেলায় ২০ হর্স পাওয়ারের ৪০টি ও সাড়ে ৭ হর্স পাওয়ারের ১০টি সেচ পাম্প চালু রয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পের অনুকূলে ৮০ থেকে ১০০ একর জমি চাষের আওতায় নেওয়া আছে। ২০ হর্স পাওয়ার সোলার সেচ পাম্প নির্মাণে ৫৬ লাখ টাকা ও সাড়ে ৭ হর্স পাওয়ারে খরচ হয়েছে ৩৫ লাখ টাকা। প্রতিটি সোলার সিস্টেমে সৌরশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে।
![](files/solar_6_617080820.jpg)
পাম্পগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ৭ কোটি ২০ লাখ লিটার পানি উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে করে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার ইউনিট বিদ্যুতের সাশ্রয় হচ্ছে। এগুলো ঝামেলা ছাড়াই ২০ বছর টানা সার্ভিস দেবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
সৌরবিদ্যুৎ চালিত সেচ পাম্পের সুফল তুলে ধরে গাংনী উপজেলার নওপাড়া গ্রামের কৃষক ফরমান আলী বলেন, সেচের জন্য এখন আর বিদ্যুৎ ও ডিজেলের আশায় বসে থাকতে হয় না। শুধু রোদেলা দিন হলেই মাঠ ভেজাতে পারি। মাত্র ২০ মিনিটেই এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে পারছি।
বাওট গ্রামের কৃষক মিন্টু হোসেন ও আসাদ আলী জানালেন, বোরো চাষের সময় ধান লাগানো ও ঘরে তোলার আগ মুহূর্তে এক বিঘা জমিতে সেচ দিতে ৯০ লিটার ডিজেল ও নগদ ২ হাজার টাকা দিতে হতো। আমাদের বিঘা প্রতি খরচ হতো প্রায় সাড়ে ৫
থেকে ৬ হাজার টাকা। এখন অর্ধেক খরচ হচ্ছে।
সৌরবিদ্যুৎ চালিত সেচের ফলে জমি ও পানির অপচয় অনেকাংশে কমে গেছে বলেও জানান চাষিরা।
![](files/solar_7_854839360.jpg)
জমি ও পানির অপচয় রোধ প্রসঙ্গে গাংনী নওপাড়া গ্রামের কৃষক জাহারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ‘সুলার পামে (সৌরচালিত সেচ পাম্প) ডেন(ড্রেন) তৈরি করতে হয় না। ডেনে অনেক জমি খেয়ে ফ্যালে (জমির অপচয়)। সেচের পানি অন্যের জমিতেও চলে যায়। কিন্তু সোলার পামে ডেন তৈরি করতে হয় না। মাটির নিচ দিয়ে মোটা পাইপের মাধ্যমে জমিতে সেচ দেওয়া যায়। ৩৩ শতকে খরচা মাত্র ২শ’ টাকা’।
প্রতিটা সোলার ইরিগেশন সেচ পাম্প ১৫ শতক জায়গাজুড়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে। জমি অধিগ্রহণ বাবদ বার্ষিক দেড় লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে মালিকদের। ২০ বছরের চুক্তিতে এসব জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে কৃষি বিপ্লবের জন্য।
মেহেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, কৃষি উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নতুন নতুন তথ্য প্রযুক্তির সমন্বিত ব্যবহার করে কৃষি ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে হবে। সেকেলে আর মান্ধাতার আমলের কৃষি উৎপাদন পদ্ধতির বদলে আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। সৌরবিদ্যুৎ চালিত সোলার সেচ পাম্প আমাদের কৃষি ক্ষেত্রে এক ধাপ এগিয়ে নিতে সাহায্য করছে। চাষাবাসে সেচ দিতে এখন আর কৃষকদের ডিজেল ও বিদ্যুতের দিকে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতে হচ্ছে না।
বাংলাদেশ সময়: ০৮২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০১৬
এমআইএস/এএসআর