ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি

শুধু উৎপাদন বাড়ালেই ঢাকার গ্যাস সংকট দূর হবে না

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৫২ ঘণ্টা, জুন ২, ২০১১
শুধু উৎপাদন বাড়ালেই ঢাকার গ্যাস সংকট দূর হবে না

ঢাকা: সঞ্চালন লাইন সম্প্রসারণ করা না হলে উৎপাদন বৃদ্ধি করেও গ্যাস সংকট দূর করতে পারবে  না সরকার। অথচ সঞ্চালন লাইন সম্প্রসারণ সংক্রান্ত একটি উচ্চ পর্যায়ের সমীক্ষা প্রতিবেদন ৫ বছর ধরে ঝুলে আছে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে।



আর জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের দাবি, সরকার এখন গ্যাস সংকট মোকাবেলায় ভুল পথে হাঁটছে।

ওই সমীক্ষায় তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের প্রস্তাবিত ১৭ ও ১৮ নম্বর কুপের প্রসেস প্লান্ট থেকে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে এবি (আশুগঞ্জ- বাখরাবাদ) পাইপ লাইনে সংযোগ প্রদান এবং ১৭ ও ১৮ থেকে ভিএস (ভাল্ব স্টেশন) পর্যন্ত মোট ১০ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপনের সুপারিশ করেছে।

পেট্রোবাংলা সূত্র বাংলানিউজকে জানিয়েছে, ২০০৬ সালে তৎকালীন জ্বালানি সচিব নাসির উদ্দিন আহমেদ গ্যাস সঞ্চালনের সমস্যা দূর করতে কি করা প্রয়োজন এ বিষয়ে একটি সমীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেন।

সে মোতাবেক তিতাস গ্যাসের প্রতিনিধি আতিকুর রহমান পেট্রোবাংলার নিজাম শরিফুল ইসলাম, বাখরাবাদ গ্যাসফিল্ডের প্রতিনিধি, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লি.(জিটিসিএল) এবং বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লি. (বিজিএফসিএল) এর প্রতিনিধির সমন্বয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটি সরেজমিনে অনুসন্ধান শেষে ১০ কিলোমিটার সঞ্চালন লাইন সম্প্রসারণের উল্লেখিত এই প্রস্তাবটি জমা দেয়। প্রস্তাবটি পেট্রোবাংলার বোর্ড মিটিংয়ে সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। প্রকল্পটি জরুরি ভিত্তিতে গ্রহণ করার জন্য সুপারিশসহ প্রস্তাবটি জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।

কিন্তু সেই সুপারিশ আজও ঝুলে আছে। ওই প্রস্তাবে বলা হয়েছে, এই ১০ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপন করা সম্ভব হলে দুই ধরণের সুবিধা পাওয়া যাবে।

এক নম্বর সুবিধা পাওয়া যাবে, তিতাস গ্যাসক্ষেত্র থেকে ১০০০ পিএসআই চাপে গ্যাস এবি পাইপ লাইনে সঞ্চালন করা সম্বব হবে। যা বর্তমানে ৮০০ পিএসআই এ ( উত্তর- দক্ষিণ পাইপ লাইনে সঞ্চালন করা হচ্ছে)। ফলে চট্রগ্রামে গ্যাস সঞ্চালনে নিম্নচাপে বর্তমানে যে সমস্যা রয়েছে, তা দূর হবে এবং পর্যাপ্ত গ্যাস সঞ্চালন করা যাবে।

দুই নম্বর সুবিধা উল্লেখ করা হয়েছে, তিতাস গ্যাসক্ষেত্র থেকে যে পরিমাণ গ্যাস উত্তর- দক্ষিণ পাইপ লাইনে সরবরাহ করা হতো তা ভিন্ন পথে সঞ্চালিত হলে বিবিয়ানা, হবিগঞ্জ, রশিদপুর বিভিন্ন গ্যাস ক্ষেত্র থেকে উক্ত পরিমাণ গ্যাস আশুগঞ্জ পর্যন্ত সঞ্চালন করা সম্ভব হবে।

 ফলে ঢাকাসহ আশুগঞ্জের পশ্চিমাঞ্চলের গ্যাস সমস্যা বহুলাংশে লাঘব হবে। একই সাথে চট্রগ্রামে গ্যাস সঞ্চালনের জন্য প্রস্তাবিত কমপ্রেসার স্থাপনের প্রয়োজন হবে না।

১০ কিলোমিটার দীর্ঘ এ পাইপলাইন স্থাপনে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে জিটিসিএল ৭ কিলোমিটার এবং বিজিএফসিএল ৩ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনে বিনিয়োগে আগ্রহী ছিল। কিন্তু এর পরেও গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটি ৫ বছর ধরে ঝুলে আছে।

পেট্রোবাংলার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে বলেছেন, বর্তমান যে পরিমাণ গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে সেটিই সঠিকভাবে সঞ্চালন করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় সঞ্চালন সমস্যা নিরসন না করে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যুক্তিহীন।

তিনি দাবি করেছেন দেশে বর্তমানে মূলত উত্তর-দক্ষিণ পাইপলাইন (২৪ ইঞ্চি), রশিদপুর-আশুগঞ্জ, তিতাস-ঢাকা পাইপ লাইন ( ১৬ ও ১৪ ইঞ্চি), ব্রক্ষপুত্র বেসিন পাইপলাইনে (২৪ ইঞ্চি) গ্যাস সরবরাহ হয়ে আসছে। বর্তমানে এসব পাইপলাইন দিয়ে যে পরিমাণ গ্যাস সঞ্চালন করা হচ্ছে, তার অতিরিক্ত সঞ্চালন করা সম্ভব নয়।

অন্যদিকে এবি ( আশুগঞ্জ-বাখরাবাদ) পাইপলাইন (২৪ ইঞ্চি), বাখরাবাদ-ডেমরা (২০ ইঞ্চি) সঞ্চালন লাইনে সঞ্চালন ক্ষমতার ২০ থেকে ৪০ ভাগের বেশি সঞ্চালিত হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সরকার শুধু গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর দিকে ঝুঁকে আছে। কিন্তু পাইপ লাইনের সমস্যা দূর করতে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এ অবস্থায় দেশের গ্যাস সংকটের সুরাহা সম্ভব নয়।

এর পরেও থেমে নেই বর্তমান সরকার। তারা জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির প্রস্তাব মোতাবেক ফাস্ট ট্রাক, সুপার ফাস্ট ট্রাক প্রকল্প গ্রহণ করেছে।

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তোফিক- ই এলাহী আগামী ৩ মাসের মধ্যে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নির্দেশ দিয়েছেন বলে জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে।

এই প্রকল্পের আওতায় ৩ ধাপের কাজ করার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ১ নম্বরে রয়েছে, কূপের ভু-উপরিভাগে গ্যাস প্রবাহের বাধা সমুহ ভাল্ব এবং চোখ সমূহের সমন্বয়ের মাধ্যমে ১২০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন বৃদ্ধি করা।

দ্বিতীয় ধাপে রয়েছে ওয়ান লাইন অপরেশনের মাধ্যমে কিছু কূপে সামান্য মেরামত কাজ সম্পাদনের মাধ্যমে ৭০ থেকে ১১০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

তৃতীয় ধাপে পাইপ পরিবর্তনের মাধ্যমে কিছু কূপের উৎপাদন ৬০ থেকে ২৪০ মিলিয়ন ঘনফুট উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব।

এর মধ্যে প্রথম দুটি সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য জোর তাগিদ দেয় পেট্রোবাংলা।

অনেকে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, উপরোক্ত পদ্ধতিতে হয়ত গ্যাসের উৎপাদন বাড়বে কিন্তু তা গ্রাহক পর্যায়ে পৌছানো সম্ভব নয় বিদ্যমান পরিস্থিতিতে।

সাবেক জ্বালানি সচিব নাসির উদ্দিন বাংলানিউজকে ওই কমিটি গঠনের সত্যতা স্বীকার করে বলেছেন, আমি বদলী হয়ে যাওয়ার পরে ওই রিপোর্ট জমা দেওয়ার ব্যাপারে আমার করার কিছু ছিল না।

আমি ব্যক্তিগতভাবে সে সময়ে বোর্ড মিটিংয়ে বিষয়টি অনুমোদন দেওয়ার জন্য সদস্য প্রফেসর নুরুল ইসলামকে বলেছিলাম। তার পরেও বিষটি অনুমোদন দেওয়া হয়নি। পরে আমি প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য হওয়ার পরও প্রকল্পটির জন্য চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছি। মনে কোথায় যেন গলদ রয়েছে। সকলেই জানে কি করতে হবে।

ওই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন কর্ াউচিত ছিল। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন সরকার শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি করে গ্যাস সংকটের সমাধান করতে পারবে না।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান ড. হোসেন মুনসুর বাংলানিউজকে বলেছেন এ বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই।

অনেক চেষ্টা করেও জ্বালানি সচিব মেজবাহুর রহমানের মুঠোফোনে তাকে পাওয়া যায়নি।

বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘন্টা, ০২ জুন, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।