ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

রাজনীতি

পুনর্গঠিত না হলে হাসিনার পর আ’লীগের অস্তিত্ব থাকবে না

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৯
পুনর্গঠিত না হলে হাসিনার পর আ’লীগের অস্তিত্ব থাকবে না

ঢাকা: সম্প্রতি লন্ডনে থেকে বাংলাদেশে এসেছেন একুশের অমর গানের রচিয়তা ও সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। অতিথি হিসেবে যোগ দেবেন আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় সম্মেলনে। সম্মেলন, প্রাচীন দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ, বাংলাদেশের রাজনীতি, তার জীবন এবং অমর একুশের গান নিয়ে তিনি মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলানিউজের স্টাফ করেসপন্ডেন্ট দীপন নন্দীর। পাঠকদের জন্য দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ প্রথম পর্ব

বাংলানিউজ: স্বাধীনতার ৫০ বছরের দ্বারপ্রান্তে আমরা দাঁড়িয়ে। যে আদর্শ নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল, বিগত ৪৯ বছরে তার কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে বলে আপনি মনে করেন?

আবদুল গাফফার চৌধুরী: বাংলাদেশের নামটা বাস্তবায়িত হয়েছে।

আদর্শের প্রাণ বাস্তবায়ন হয়নি।

বাংলানিউজ: এর কারণ কী বলে মনে করছেন?

আবদুল গাফফার চৌধুরী: বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্র গঠনে বাধা দিয়ে দেশের প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ক্ষমতা দখল এবং সে আদর্শগুলোকে ধ্বংস করার চেষ্টা করে। এরপর বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তারাও দেশের এবং দেশের বাইরের চাপে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ পুরোপুরি অনুসরণ করতে পারেনি। সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনা যায়নি। সামাজিক জীবনে ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে অসাম্প্রদায়িকতা প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। বিএনপি ও জামায়াত মিলে দেশটাকে সাম্প্রদায়িকতার যে জালে জড়িয়ে ফেলেছে, সে জাল শেখ হাসিনার পক্ষে একা কাটা সম্ভব হয়নি। তিনি নিজেও চারদিকে এমন সব শক্তি দ্বারা বেষ্ঠিত, তারা তাকে এ পথে যেতে বাধা দিচ্ছে। এসব নানা কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। এর জন্য আরও দীর্ঘ সময় প্রয়োজন হবে।

বাংলানিউজ: ৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি দাবি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের। বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। সংসদেও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ অবস্থাতেও কেন তারা ৭২-এর সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারছে না?

আবদুল গাফফার চৌধুরী: ৭২-এর সংবিধান প্রবর্তন ও প্রত্যাবর্তন আওয়ামী লীগের ওয়াদা। যা পুরোপুরি পালন হয়নি। ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম থেকে বাদ দেওয়া হয়নি, ধর্মনিরপেক্ষতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়নি। এক কথায় ৭২-এর সংবিধানের মূল ভিত্তিকেই পুনঃস্থাপন করা হয়নি। শেখ হাসিনার সরকার জনমতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ৭২-এ ফিরে যাচ্ছে। তারা শাসনতন্ত্রে বা সংবিধানের যেসব ধারা গণতন্ত্রের বিরোধী ছিল সেসবকে বাদ দিয়েছে। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের বৈধতা বাতিল করেছে। এখন ৭২-এর সংবিধানে পুরোপুরি ফিরে যেতে পারবেন, যদি সংবিধান থেকে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে বাদ দেওয়া যায়। কিন্তু জনমতের ভয়ে আওয়ামী লীগ সে পথে এগুতে পারছে না। আমাদের জনগণ এখনও ধর্মান্ধ। একটি পরিপূর্ণ শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে এ ধর্মান্ধতা থেকে মুক্ত করার পর ৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া সম্ভব। তার আগে সম্ভব বলে মনে করি না।

বাংলানিউজ: শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) থেকে আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন শুরু হচ্ছে। যাতে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা আবারও দায়িত্ব নেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু তিনি বারবার এ দায়িত্ব থেকে দলের নেতাকর্মীদের কাছ থেকে অব্যাহতি চেয়েছেন। শেখ হাসিনার পর অন্য নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কতটা শক্তিশালী থাকবে বলে আপনি মনে করেন?

আবদুল গাফফার চৌধুরী: শেখ হাসিনা সরে গেলে একটা অরাজক অবস্থা দেখা দেবে। আমার ধারণা তিনি যদি সরে যেতে চান, তাহলে একজন একটি নির্বাচিত সভাপতির হাতে দায়িত্ব দিতে হবে। তার মনোনীত সভাপতির হাতে নয়। সে সঙ্গে তিনি অভিবাবক হিসেবে দলের উপরের ছায়া হয়ে থাকবেন। তার নেতৃত্ব আরও কিছুদিন প্রয়োজন হবে, দলের জন্য, দেশের জন্য। কিন্তু আওয়ামী লীগ যতদিন পর্যন্ত গণতান্ত্রিক দল না হবে, ততদিন পর্যন্ত শক্তিশালী হবে না। সভাপতি নির্বাচন থেকে শুরু করে সবকিছু তার হাতে, এটা গণতেন্ত্রর পরিচয় নয়। দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে আওয়ামী লীগের ভেতরে আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বাংলানিউজ: আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের কমিটিগুলোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। সে সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের প্রবেশ করানো হচ্ছে এটা বন্ধের উপায় কী?

আবদুল গাফফার চৌধুরী: আমি মনে করি, ভোটের মাধ্যম ছাড়া গণতন্ত্র বিকল্প নেই। মনোনয়ন দিয়ে দল ও সরকার গঠন হলে গণতন্ত্র কার্যকর হয় না। আওয়ামী লীগের মন্ত্রীরা সিন্ডিকেট তৈরি করে। ছাত্রলীগকে ধ্বংস করেছেন এই মন্ত্রীরা। তারা সিন্ডিকেট তৈরি করেন এবং মন্ত্রীর প্রভাব যাতে বজায় থাকে সেজন্য এলাকায় নানা অত্যাচার করে। তারা ও তাদের সঙ্গীরা দুর্বৃত্তদের প্রশ্রয় দেন। পুলিশও তাদের আটকাতে পারেনা। উপরের ক্ষমতার জোরে প্রভুত্ব বিস্তার করে। যাতে জনগণের সমর্থন থাকে না। আজকে যদি আওয়ামী লীগ পুনর্গঠন করা না হয়, বর্তমানে যেভাবে আছে তা থাকে, তাহলে শেখ হাসিনার পর অস্তিত্ব থাকবে না। শেরে-এ-বাংলা এ কে ফজুলল হকের কৃষক শ্রমিক পার্টি, মাওলানা ভাসানীর ন্যাপের মতো আওয়ামী লীগের অবস্থা হবে।

বাংলানিউজ: আমরা বিগত ১০ বছরে কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল দেখতে পাচ্ছি না। শক্তিশালী বিরোধী দল ফিরিয়ে আনতে কী প্রয়োজন? আমরা কি আরেকটি নির্বাচনে যাবো?

আবদুল গাফফার চৌধুরী: এ ভুলটার শুরু বঙ্গবন্ধুর আমল থেকে। বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছিলেন খুবই ভালো চিন্তা থেকে। তাতে বিরোধীতা করার কোনো রাস্তা খোলা রাখেননি। তার মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমান তিনি বিরোধীদল তৈরি করতে দিলেন। কিন্তু তাদের কোনো ক্ষমতা নেই। সংসদে অনাস্থা দেওয়ার, বাজেট সংশোধন করার কোনো ক্ষমতা নেই। প্রেসিডেন্টকে ইমপিচমেন্ট করার ক্ষমতাও ছিল না। এক রকম পুতুল পার্লামেন্ট তৈরি করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর রাজনীতি দুই ভাগ হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পক্ষে আর বিপেক্ষ। বিএনপি গঠিত হয় স্বাধীনতাবিরোধীদের সমর্থনে। ফলে স্বাধীনতার স্বপক্ষে একটি ভালো সংগঠন তৈরি হয়নি।

বাংলানিউজ: বঙ্গবন্ধুর সময়ে জাসদ শক্তিশালী ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সমাজতান্ত্রিক দলগুলো কেন শক্তিশালী বিরোধীদল হতে পারেনি?

আবদুল গাফফার চৌধুরী: আওয়ামী লীগ আমলে জাসদকে সন্ত্রাসের পথে ঠেলে দেওয়া হয়। জাসদ ভুল করার পরে সঠিক পথে আসতে পারতো। কিন্তু তাদের উপরে দমননীতি প্রয়োগ করা হয়। তারা সব চলে যায় সন্ত্রাসের পথে। জিয়া ও তার পরের বাকি সরকারের আমলে বিরোধীদলকে তৈরি করতে দেওয়া হয়নি। বর্তমান শেখ হাসিনা আমলেও বিরোধীদলকে মাথা তুলতে দেওয়া হয়না। বিএনপিকে দেওয়া হচ্ছে না, ঠিক আছে। কারণ তারা স্বাধীনতার বিপক্ষের দল। গণজাগরণ মঞ্চ যখন তৈরি হয়েছিল তখন আমার মনে হয়েছিলো একটি বিরোধীদল গড়ে উঠবে। কিন্তু হতে দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার পক্ষের লোককে এগিয়ে যেতে দেওয়া হয়নি।

বাংলানিউজ: এটা কি শেখ হাসিনার ভুল? নাকি তার আশপাশের মানুষের ভুল পরামর্শ?

আবদুল গাফফার চৌধুরী: এটা শেখ হাসিনার নিজেরই সিদ্ধান্ত। তিনি ভুল করেননি। তিনি যদি এখনই পবিত্র হতে চান, তাহলে মারা যাবেন। কারণা তার বিরোধীতাকারীরা ধর্মান্ধ ও সামাজিকভাবে শক্তিশালী। নব্যধনীরা সংসদ, গণমাধ্যম দখল করেছে। শেখ হাসিনা রাতারাতি তাদের বিরুদ্ধে গেলে মারা যাবেন। সেজন্য উনি ধীরে চলার নীতি নিয়েছেন। ইতোমধ্যেই তার প্রধান শত্রু বিএনপি, জামায়াত, স্বাধীনতাবিরোধী, বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ধ্বংস করেছেন। এখনই পুরো গণতন্ত্র দিলে তা ঠিক হবে না।

(চলবে)

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৯
ডিএন/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad