ঢাকা, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

আওয়ামী লীগ

‘মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে রাজনীতিতে, তবে স্প্লিন্টার আজও কাঁদায়’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১১২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৪, ২০১৯
‘মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে রাজনীতিতে, তবে স্প্লিন্টার আজও কাঁদায়’ বাংলানিউজের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন এমপি মো. আবু জাহির, ছবি: বাংলানিউজ

হবিগঞ্জ: ছাত্ররাজনীতি থেকে উঠে আসা পরীক্ষিত মানুষটি আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের সময় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তবে আজও তাকে অসহ্য যন্ত্রনা দেয় সেই গ্রেনেডের স্প্লিন্টার। প্রায় ১৪ বছর ধরে শরীরজুড়ে অনেক স্প্লিন্টার নিয়ে রাজনীতি করছেন। বাকিটা জীবনও তিনি এই রাজনীতিতেই উৎসর্গ করতে চান। নেতাকর্মীদের পাশে থেকে আরও সক্রিয় করে রাখতে চাচ্ছেন নিজের আদর্শের দলকে। সে লক্ষ্যেই সামনে কাউন্সিল রেখে আবারও সভাপতি পদে প্রার্থী হয়েছেন হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি এমপি মো. আবু জাহির।

এদিকে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হবিগঞ্জও। এর প্রতিটি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন থেকে শুরু করে উপজেলা, পৌরসভা এমনকি জেলা আওয়ামী লীগও এখন সুসংগঠিত।

অথচ এই সৃশৃঙ্খল রাজনীতি কয়েকবছর আগেও ছিল না। অন্তর্দ্বন্দ্ব, গ্রুপিং, পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিসহ নানা রেষারেষি ছিল। এরপর ২০১৩ সালে দলের সভাপতি হয়ে সংগঠনের রূপ পাল্টে দেন আবু জাহির।

এ হিসেবে কৌতূহল জাগতে পারে, এতদিন দলের কী কী করেছেন তিনি, সভাপতিত্বে কতটুকু সফল, আবার সভাপতি হলে দলের নতুন উন্নয়নে ভাবনা কী, একইসঙ্গে জেলা সদর আসনের তিনবারের এমপি হিসেবে তিনি জনগণের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্য। সম্প্রতি এসব বিষয় নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন অ্যাডভোকেট আবু জাহির। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বাংলানিউজের হবিগঞ্জ ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট বদরুল আলম।

বাংলানিউজ: নিজের সম্পর্কে কিছু বলবেন?

আবু জাহির: আলহামদুলিল্লাহ! ভালো আছি। সবসময় ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে এরমধ্যেই আমার শান্তি। জনগণের কাজ করেই সবসময় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। সবার কাছে দোয়া প্রার্থী, নিজেকে শেষদিন পর্যন্ত রাজনীতিতেই নিয়োজিত রাখতে চাই।

বাংলানিউজ: আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পর জেলা আওয়ামী লীগের গতিশীলতা কতটুকু?

আবু জাহির: হবিগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগ ছিল একটা নেতৃত্ব সংকটে। হবিগঞ্জে আওয়ামী লীগ এক সময় এত সমৃদ্ধ ছিল না। তবে কেউ কেউ কাজ করেছেন। তারা আমাদের মাঝে নেই। এরপর আমি দায়িত্বে আসি। আওয়ামী লীগকে তৃণমূল থেকে জেলা পর্যন্ত সুসংগঠিত করতে নেমে পড়ি। অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাই। যার ফসল আজকের হবিগঞ্জ আওয়ামী লীগ। জেলার প্রতিটি স্তর আজ সুসংগঠিত।
তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গ্রেনেড হামলায় আহত আবু জাহিরকে দেখতে আসেন, ছবি: সংগৃহীতআবু জাহির: গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও চারটি আসনেই আমাদের দলের প্রার্থী ছিল। সবগুলোতেই আমরা ক্ষমতায়। এছাড়া জেলার পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন প্রায় সবকটিতেই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। অথচ কয়েকবছর আগেও এমন ছিল না। আমি বিগত ছয় বছর সভাপতি। এর আগে ১০ বছর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। তখনও আওয়ামী লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ সব সহযোগী সংগঠনকে একটি সুশৃঙ্খল নিয়িমের মধ্যে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছি। যে কারণে আওয়ামী পরিবারের ভাবমূর্তি স্থিতিশীল ছিল। আমার রাজনীতিতে হবিগঞ্জ জেলার মানুষের উন্নয়ন ও স্বস্তি ছাড়া দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়নি। আমার সবসময়ের উদ্দেশ্য, জনগণের জন্য কাজ করা। নেতাকর্মীদের পাশে থাকা।

বাংলানিউজ: বিরোধী দলে থাকাকালীন আপনার ভূমিকা কতটুকু?

আবু জাহির: শুরু থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলাম। আওয়ামী লীগের আদর্শ আমার হৃদয়ে দাগ কাটে খুদে ছাত্র অবস্থায়ই। যখন থেকে রাজনীতি করি, তখন থেকেই বলছি, কোনোদিন দল ক্ষমতায় আছে কি-না ভাবিনি। দলের কাজ করতে হবে, প্রয়োজন, করেছি। বরং বিরোধী দলের হয়ে কাজ করেছি শক্ত হাতে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করে জেল কেটেছি কয়েকবার। বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দেওয়া ঘোষণা বাস্তবায়নে প্রত্যেকটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছি। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে হবিগঞ্জের রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম বাস্তবায়ন করেছি। যে কারণে একাধিকবার স্বৈরাচারী জিয়া, এরশাদ, খালেদা সরকারের আমলে কারাভোগ করতে হয়েছে। এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখিও হতে হয়েছে। শুধু তাই না, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি ফারুক রশিদ হবিগঞ্জে ১৯৮৯ সালে এসে জনসভা, কর্মসূচি দিয়েছিলেন। গুটি কয়েক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে এবং হবিগঞ্জের শান্তিকামী জনগণ নিয়ে জীবন বাজি রেখে তাকে এখানে কোনো সভা করতে দিইনি। এখনও এর ধারাবাহিকতা রেখেছি। হবিগঞ্জ জেলায় জামায়াত-শিবির মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। এখানে বিএনপির ধান্দাবাজির রাজনীতি স্তম্ভিত।

বাংলানিউজ: আপনার হাত ধরে দল আজ সুসংগঠিত। প্রতিটি আসনেই আওয়ামী লীগের এমপি, বেশির ভাগ উপজেলা, ইউনিয়নে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতায়, এ সফলতায় আপনার ভূমিকা কী?

আবু জাহির: বিগত দিনে হবিগঞ্জ জেলার প্রত্যেকটি উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন নির্বাচনে দলীয় নেতাকর্মীরা যাতে নির্বাচিত হয়ে আসতে পারেন, এর জন্য আগে থেকেই বিভিন্ন এলাকায় জনসভার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয়ী করার চেষ্টা করেছি। তৃণমূলের নেতাকর্মীদের একত্র করেছি। সভা মিছিল করিয়েছি। জনগণের কাছে তুলে ধরেছি আওয়ামী লীগের প্রতিটি উন্নয়ন। একইসঙ্গে আমাদের আগামীর ভাবনাও জনগণ জেনেছে। দলের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের আশ্বাস এবং আমাদের প্রতি জনগণের আস্থা জয় এনে দিয়েছে। এছাড়া যেকোনো নির্বাচনে দলের প্রার্থী নির্বাচন করাটাও ছিল সঠিক সিদ্ধান্তে। সবার মতামতের ভিত্তিতে তৃণমূলের প্রার্থীও আমরা দিয়েছি। প্রার্থীর মাঠপর্যায়ে জনপ্রিয়তা, তার প্রতি জনগণের আস্থা পর্যবেক্ষণ করেই তবে মনোনয়ন দিয়েছি। যা আজ দৃশ্যমান।

বাংলানিউজ: আপনার আগে যিনি সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন, তিনি কী সফল?

আবু জাহির: আমার আগে যিনি সভাপতি ছিলেন, সেসময় আমি সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছি। আমরা দলকে যৌথভাবেই, যৌথ নেতৃত্বের মাধ্যমেই পরিচালনা করে আসছি। সফলতা-ব্যর্থতা ও দায়-দায়িত্ব আমাদের সবারই।

বাংলানিউজ: দল ক্ষমতায়, এই সময়ে অনেকেই সভাপতি প্রার্থী হয়েছেন, এটা কীভাবে দেখছেন?

আবু জাহির: মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দলের কাউন্সিলররা ডেলিগেট সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত দেবেন, আমি একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে তা স্বাগত জানাই।
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বাবা আবু জাহিরকে জড়িয়ে ধরেন শিশু মেয়ে আরিফা আক্তার মুক্তি, ছবি: সংগৃহীতবাংলানিউজ: কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের সময় গুরুতর আহত হয়েছিলেন। শুনেছি, সেই স্প্লিন্টার এখনও শরীরে যন্ত্রণা দেয়, এমনকি মাঝে মাঝে চিকিৎসাও নিতে হয়। সেই নিমর্ম অভিজ্ঞতাটা কেমন আর এখন কী অবস্থা?

আবু জাহির: আমার জীবনে একটি বিভীষিকাময় স্মৃতি এটা। সেদিন বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায়। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সারা বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতাদের হত্যার অংশ হিসেবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি হবিগঞ্জ-লাখাই থেকে নির্বাচিত এমপি এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবিরিয়া সাহেবের ওপর গ্রেনেড হামলা হয়। এতে তিনি মারা যান। তিনি ছাড়া আরও কয়েকজনকে নির্মমভাবে জীবন দিতে হয়েছিল। আমি তার পাশেই বসা ছিলাম। প্রায় শতাতধিক নেতাকর্মী গুরুতর আহত হই। মরেই গিয়েছিলাম আমি। আল্লাহ বাঁচিয়ে রেখেছেন। তবে এই যন্ত্রনা আজও আমাকে কাঁদায়। স্প্লিন্টার শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছি। সেদিন যা ঘটেছিল, আমি যে বেঁচে আছি, এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া। এ জন্য জনগণের দেওয়া পবিত্র আমানত রক্ষার চেষ্টা করে যাচ্ছি।

বাংলানিউজ: দল নিয়ে আগামীর ভাবনা কী, সভাপতি হলে কীভাবে দেখতে চান জেলা আওয়ামী লীগ?

আবু জাহির: দল যদি আমাকে পুনরায় দায়িত্ব দেয় অতীতের সব কাজের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ অনুসারে দল পরিচালিত করব। দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে কাজ করে যাব।

বাংলানিউজ: বিপুল ভোটে এমপি হয়েছেন। এবার নিয়ে তিনবার আপনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন, এ নিয়ে কিছু বলবেন?

আবু জাহির: বাল্যকাল থেকেই মানুষের জন্য কাজ করতে আগ্রহী ছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি আমাকে তিনবার মনোনয়ন দেওয়ায় এবং এলাকার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেওয়ায় আমি এ সুযোগ পাই। এখন আমি জনগণের কাজ করে যাচ্ছি। উন্নয়নে কাজ করছি। ইতোমধ্যে হবিগঞ্জে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগসহ সব ক্ষেত্রেই ব্যাপাক উন্নয়ন হয়েছে। জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে বেশিরভাগ সময় সাধারণ মানুষের সঙ্গেই থাকছি। প্রায় প্রতিদিনই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এলাকার মানুষকে সময় দিচ্ছি। জনসেবাকে আমি ইবাদত মনে করি। যেহেতু বেঁচেই গেছি, তাই যতদিন বেঁচে থাকব, সাধারণ মানুষের জন্যই কাজ করব। ইনশাল্লাহ।

বাংলানিউজ: ধন্যবাদ মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

আবু জাহির: আপনাকেও ধন্যবাদ।

বাংলাদেশ সময়: ২০০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৯
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।