ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

বিএনপি

নেতা বহু সংগঠক নেই, রুটিনে আবদ্ধ মহাসচিব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৬ ঘণ্টা, মে ৫, ২০১৭
নেতা বহু সংগঠক নেই, রুটিনে আবদ্ধ মহাসচিব

ঢাকা: বিএনপি এখন নেতায় ভরপুর। সে তুলনায় সংগঠক বলতে গেলে খুবই কম। দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, মহানগরে, বিভাগীয়-জেলা-উপজেলা শহরে এমপি বা সভাপতি প্রার্থীর বর্ণিল পোস্টারের ছড়াছড়ি। 

যে কোনও সংসদীয় আসনে বিএনপির কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ জন উৎসাহী প্রার্থী রয়েছেন। তারা নিজেরা একটি গ্রুপ বা কর্মীদল পরিচালনা করেন।

এবং তাকে প্রার্থী করা না হলে অন্য কেউ কিভাবে বিজয়ী হয়, সেটা ‘দেখে নেবার জন্য’ আস্তিন গুটিয়ে বসে আসেন।  

প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলকে নয়, তারা লড়াই করছেন নিজের দলের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য। বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কদিন আগেও পোস্টার লাগাতেন বা মাইকিং করতেন এমন কেউ কেউও এখন এমপি নির্বাচনের জন্য নিজের মনোনয়ন দাবি করছেন।

আগের কিস্তি পড়ুন
** দিশেহারা বিএনপি-৫: সর্বত্র ক্রনিক কোন্দলের ছায়া
** দিশেহারা বিএনপি-৪: কৌশলের চক্কর ও সমন্বয়হীন আন্দোলন
** দিশেহারা বিএনপি-৩: নির্ভরশীলতায় হ্রাস নিজস্ব সামর্থ্য
** দিশেহারা বিএনপি-২ : দুর্নীতি-সুবিধাবাদে গ্রাস নেতৃত্ব
** 
দিশেহারা বিএনপি-১: দলের ভেতরে-বাইরে হতাশার বিষবাষ্প

বিগত আন্দোলনের সময়ও দেখা গেছে, বিএনপির মিছিল খণ্ডখণ্ড ভাবে একেকজন নেতার নেতৃত্বে মাঠে কাজ করেছে। একত্রে কমই কর্মসূচি পালন করেছে। আন্দোলনের সময়ও দলের অন্য গ্রুপের কেউ আহত হলে বা গ্রেফতার হলে বা নির্যাতিত হলে দূর থেকে দেখেছে। দলগতভাবে এগিয়ে আসে নি।

বিএনপি রাজনীতির বিশেষজ্ঞরা দেশব্যাপী গ্রুপিং ও অনৈক্যের জন্য কয়েকটি কারণকে চিহ্ণিত করেছেন: ১. কমিটি না থাকায় এবং নিয়মিত কাউন্সিল না হওয়ায় সবাই নেতা হয়ে গেছে। ২. কেন্দ্রে গ্রুপিং থাকায় তৃণমূলেও সেসব গ্রুপিং-এর শাখা বিস্তার লাভ করেছে। ৩. বছরের পর বছর কেন্দ্রীয়ভাবে দেশব্যাপী সংগঠনের খোঁজ-খবর ও তদারকি না করায় স্থানীয় ক্ষেত্রে একটি ফ্রি-স্টাইল অবস্থা তৈরি হয়েছে। ৪. কেন্দ্রীয় সংগঠন থেকে বিভিন্ন নেতা ভিন্ন ভিন্ন সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার সুযোগ নিচ্ছে তৃণমূলের নেতারা।  

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিএনপির জন্য এখন প্রয়োজন ত্যাগী ও নিবেদিত-প্রাণ সংগঠক, যারা নিজেরা পদ-পদবীর তোয়াক্কা না করে দলের সাংগঠনিক ঐক্য ও দৃঢ়তা প্রতিষ্ঠায় কাজ করবেন। অতীতে যাদু মিয়া, বি. চৌধুরী, কে.এম ওবায়েদ, আ. সালাম তালুকদার, আ. মান্নান ভূইয়া, খোন্দকার দেলোয়ার সার্বক্ষণিকভাবে দল গোছাতে ব্যস্ত থাকতেন; সংগঠনের পেছনে সময় ব্যয় করতেন। বিএনপিতে এখন এমন সংগঠকের আকাল।  

যারা আছেন, তারা নিজেদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্যস্ত। সভা-সমাবেশ, সেমিনারে বক্তব্য দেওয়া এবং মিডিয়াতে মুখ দেখানো, গুলশান অফিসে ম্যাডাম খালেদা জিয়াকে চেহারা দেখানো ইত্যাদিই তাদের একমাত্র কাজ। ম্যাডামের আশেপাশে থেকে এবং মিডিয়ায় নিজের উপস্থিতির জন্য সাংবাদিকদের সঙ্গে লাইন রেখে চলেই তারা দলের জন্য ‘অনেক কাজ’ করছেন বলে প্রমাণ দিতে সচেষ্ট।

বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, থানা, ওয়ার্ড কমিটিকে নিয়ে বসা, তাদের সমস্যা-সম্ভাবনা দেখা, কর্মীদের মামলা-মোকাদ্দমা সমালানোর জন্য কেউই যেন ফুসরত পাচ্ছেন না। ফলে বিএনপি নামক দলটি বিরাট হলেও সংগঠন হিসাবে সেটা অভিভাবকহীন এবং নিঃসঙ্গ হয়ে আছে।  

দলে যে একজন মহাসচিব আছেন, বিশ্রঙ্খল সংগঠনের দিকে তাকালে সেটা বিশ্বাস করাই কষ্টকর হয়ে যায়।  

অথচ প্রতিষ্ঠার পর জিয়াউর রহমান সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন সংগঠন ও কর্মী বাহিনী গঠনের দিকে। তিনি নিজে প্রায়-অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন বাংলাদেশের ব্যাপক অঞ্চল পায়ে হেঁটে সফরের মাধ্যমে। দলীয় কার্যালয়ে তিনি নিজে উপস্থিত থাকতেন এবং কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে পালা করে অফিসে বসে দলের নেতা-কর্মী ও সাংগঠনিক খোঁজ-খবর নেওয়ার ব্যাবস্থাও চালু করেছিলেন। পরে ক্ষমতায় এলে বিএনপি সাংগঠনিক কার্যক্রম ব্যক্তি ও নেতা নির্ভর হয়ে যায়। এমতাবস্থায় তারেক রহমান তৃণমূল পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সাংগঠনিক জোয়ার আনার চেষ্টা করেন। তিনি দলের ডাটাবেস ও তথ্য-উপাত্ত গড়ে তুলতেও চেষ্টা করেন। কিন্তু দুর্নীতির বিষয়গুলো তার সকল কার্যক্রমকেই ম্লান করে দেয়।  

১/১১-এর পর সাংগঠনিক যে স্থবিরতা, বিশৃঙ্খলা ও চেইন অব কমান্ডের ভাঙন সৃষ্টি হয়, সেটা পুরোপুরি পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে বলা যাবে না। দলের কেন্দ্রীয় ও বিভিন্ন শাখা অফিসে নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি যত না সাংগঠনিক সভা-সমাবেশভিত্তিক, তারচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত বিকাশ ও প্রচারভিত্তিক। দলের প্রেস কনফারেন্সে বিভিন্ন স্তরের নেতা-কর্মীদের গায়ের জোরে ক্যামেরার সামনে আসার চিত্র দৃষ্টি এড়ায় না। একই চেহারা সব সময় চেয়ার দখল করে কিংবা টিভির সামনে হাজির হতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত। দলের নেতৃত্বে নতুনদের উঠে আসার সুযোগও সীমিত হয়ে আছে।  

কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের সাংগঠনিক কার্যক্রম বা সফরের ঘটনা নেই বললেই চলে। কাউন্সিল, বর্ধিত সভা, কর্মী বৈঠক উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায় নি। এমন কি, গত নির্বাচনের আগে সরকার বিরোধী বা নির্বাচন বিরোধী আন্দোলনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক প্রস্তুতি ছিল না। এ লক্ষ্যে রাজধানীর থানা ও ওয়ার্ডে কোনও সভা হয় নি। দেশব্যাপী সফর ও সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধিমূলক কার্যক্রম দেখা যায় নি। যে কারণে খালেদা জিয়ার ‘মার্চ ফর ডেমেক্রেসি’ এক অর্থে মাঠে মারা যায়। দলীয় সংগঠকরা নেত্রীর ডাকে নেতা-কর্মীদের সমবেত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হন।

বিএনপির মতো দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের জন্য একজন দক্ষ মহাসচিবের অভাব মিটছে না। বর্তমান মহাসচিব ঢাকার বাইরে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সাংগঠনিক সফরও করতে পারেন নি। তিনি বক্তৃতা, বিবৃতি দেওয়া আর কারাবন্দি থাকার মধ্যেই আবর্তিত হয়েছেন। দলের সাংগঠনিক ক্ষেত্রে প্রাণ সঞ্চার করতে পারেন নি। তার কাজ-কর্ম তাকে পূর্ণকালীন মহাসচিব করার মতো অবস্থান তৈরি না করলেও বিশেষ ব্যক্তির পছন্দের কারণে তিনি পূর্ণকালীন দায়িত্ব পেয়েছেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন। তার নেতৃত্বে দলে সৃজনশীল সাংগনিক দক্ষতার কোনও চমকও দৃষ্টি গোচর হয় নি। বরং একটি আপতকালীন সময়ে ‘ভারপ্রাপ্ত’ দায়িত্ব পালনের রুটিন কাজেই তাকে স্বাচ্ছন্দ ও তৃপ্ত মনে হয়েছে বর্তমান পূর্ণকালীন দায়িত্বের সময়েও।  

বিএনপির মতো বিরাট সংগঠনের তৎপরতা কয়েক জনের মধ্যেই আবর্তিত হওয়ায় সাংগনিক দিক-নির্দেশনার অভাব বোধ করেছেন বিরাট কর্মী-সমর্থক বাহিনী। বিগত আন্দোলনে সেটা দীর্ঘ সময় ছিল রিজভি আহমেদের ‘ওয়ানম্যান শো’। তার আটকের পর দলের মুখপাত্র হওয়ার মতো নেতা-কর্মীও খুঁজে পাওয়া যায় নি। শেষ পর্যন্ত একদা সংস্কারপন্থী বলে পরিচিতি মেজর হাফিজ এবং ড. ওসমান ফারুককে হাল ধরতে হয়।  

নেতা-কর্মী তো বটেই মিডিয়া পর্যন্ত এ প্রসঙ্গে দিশেহারা ছিল যে, বিএনপির কর্মসূচি কে জানবেন বা কে মুখপাত্রের দায়িত্ব পালন করবেন। চাপ ও চ্যালেঞ্জের সময় উত্তরণ ঘটানোর মতো সাংগঠনিক কাঠামো বিএনপি প্রদর্শন করতে পারে নি। অথচ অন্য সময় নেতাদের চাপে ত্যাগীদের কোণঠাসা হওয়ার উপক্রম বিএনপির কার্যক্রমে দেখা যায়। চেয়ার ও মঞ্চ দখল করার জন্য যারা প্রতিযোগিতা করেন, তারা সঙ্কটের সময় বিএনপিকে কোনো সার্ভিস দেন নি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির মতোই কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের এমন বহু সদস্যই আছেন, পদ-প্রাপ্তির পর সংগঠনের কাজে তাদের চেহারাও দেখা যায়নি। সদস্য বা উপদেষ্টাদের কার কি কাজ, সেটাও সুনির্ধারিত আছে বলে মনে হয় না। নিজ নিজ খেয়াল-খুশিতে সবাই কাজ করছেন।  

দলও তাদের কাজ ঠিক করে দেয় নি; তারাও দলের জন্য সমন্বিতভাবে কাজ করতে পারছেন না। ফলে বেশ হযবরল অবস্থা বিরাজ করছে বিএনপির নেতৃত্ব কাঠামোয়। আর অসংখ্য নেতার মধ্যে দক্ষ, যোগ্য, নিবেদিত সংগঠক না থাকায় কিংবা দলের পক্ষে সাংগঠনিক দায়িত্ব দিয়ে সংগঠন বিকাশ করার ব্যবস্থা না থাকায় অসংখ্য নেতার চাপে যুগপযোগী সাংগঠনিক শক্তি অর্জন ও বিকাশ সাধন করতে পারছে না বিএনপি।

বাংলাদেশ সময় ১৪৪৮ ঘণ্টা, মে ০৫, ২০১৭

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।