ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

বিএনপি

দিশেহারা বিএনপি-৫ 

সর্বত্র ক্রনিক কোন্দলের ছায়া

পলিটিক্যাল ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৯ ঘণ্টা, মে ১, ২০১৭
সর্বত্র ক্রনিক কোন্দলের ছায়া সর্বত্র ক্রনিক কোন্দলের ছায়া

ঢাকা: পুরাতন ক্রনিক রোগের মতো কোন্দল ঘিরে ধরেছে বিএনপিকে। শীর্ষস্তর স্থায়ী কমিটি থেকে তৃণমূল পর্যন্ত দলাদলি ও কোন্দলে জর্জরিত দলটি। নানা উপদল আর গ্রুপে বিভক্ত সাংগঠনিক কাঠামো। দলকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে নেওয়ার বদলে নানা গ্রুপ ও উপদল পারস্পরিক ক্ষমতার লড়াই ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েই ক্ষয় করছে যাবতীয় শক্তি ও সামর্থ্য।

আগের কিস্তি পড়ুন
** দিশেহারা বিএনপি-৪: কৌশলের চক্কর ও সমন্বয়হীন আন্দোলন
** দিশেহারা বিএনপি-৩: নির্ভরশীলতায় হ্রাস নিজস্ব সামর্থ্য
** দিশেহারা বিএনপি-২ : দুর্নীতি-সুবিধাবাদে গ্রাস নেতৃত্ব
** 
দিশেহারা বিএনপি-১: দলের ভেতরে-বাইরে হতাশার বিষবাষ্প
বিএনপিতে বিরাজমান কোন্দল যত না আদর্শিক, তারচেয়ে বেশি ব্যক্তিগত ও নেতৃত্বের। ব্যক্তিকেন্দ্রিক পরিচয়েই বিএনপির নেতা-কর্মীরা পরিচিত।

ঢাকায় যেমন সাদেক হোসেন খোকা বা মির্জা আব্বাস গ্রুপ, চট্টগ্রামে তেমনি আবদুল্লাহ আল নোমান বা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী গ্রুপ সরব। আন্দোলন-সংগ্রাম-কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীরা সমবেত হন গ্রুপ নেতার নেতৃত্বে। বিএনপির ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম বলতে গেলে ফাঁকা। সেখানে নানা নেতার নিজস্ব বলয়ের প্রভাব তীব্র।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিএনপিতে কোন্দল ও গ্রুপিং ছিল। কিন্তু সেটা ছিল আর্দশিক। বিএনপিতে আসা ডান ও বামপন্থিদের মধ্যে স্নায়ুচাপ ও সুপ্ত প্রতিযোগিতা ছিল। প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান উভয় গ্রুপকে দলের মূলস্রোতে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। শাহ আজিজ ও যাদু মিয়ার গ্রুপকে ব্যালেন্স করার জন্য জিয়া মধ্যপন্থি বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে দলের মহাসচিব করে দলীয় ও সাংগঠনিক ঐক্য গড়ে তুলেছিলেন। এখন মধ্যপন্থি ও সর্বজনগ্রাহ্য আস্থাভাজন কেউই সংগঠনের হাল ধরার জন্য এগিয়ে আসতে পারেননি।  

সাবেক মহাসচিবদের মধ্যে আবদুল মান্নান ভূইয়া ও খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন শেষ পর্যন্ত ঐক্য ও শৃঙ্খলা বজায়ে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছিলেন। ভারসাম্যের জায়গাটিতে এখন বিরাজ করছে গভীর শূন্যতা। দলের সামগ্রিক ঐক্য ও সংহতি নয়, নেতারা নিজেদের কোটারি ও গ্রুপকেই যেন বলশালী করতে তৎপর। যাকেই যখন সংগঠন গোছানোর বা কমিটি করার দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, তিনিই তখন নিজেদের লোকদের দিয়ে কমিটি পূর্ণ করছেন। কখনও অর্থের বিনিময়ে কমিটি দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।  

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরাও এমন অভিযোগ থেকে মুক্ত নন। ২০১০ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলার কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয় একজন প্রভাবশালী স্থায়ী কমিটির সদস্যকে। তিনি পূর্ববর্তী কমিটির ৮০ শতাংশ লোককেই বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন গিয়াস কাদের চৌধুরী ও আসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বে। পূর্ববর্তী গোলাম আকবর চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন কমিটির কাউকেই নতুন কমিটিতে জায়গা দিয়ে সমন্বয় করা হয়নি। ফলে ঐক্য ও সমন্বয়ের বদলে সেখানে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ, অবিশ্বাস ও গ্রুপিংয়ের নতুন বিন্যাস। ব্যক্তিগত প্রভাব ও অর্থের বিনিময়ে নেতা-কর্মীদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে এমন কমিটি গঠনের জোর প্রতিবাদও হয়। এখন গিয়াস কাদের চৌধুরী ও আসলাম চৌধুরীর মধ্যকার তীব্র কোন্দল ও দলাদলিতে উত্তর জেলা বিএনপির কাজ স্থবির হয়ে আছে। স্থানীয় নেতা এসএম ফজলুল হক দলীয় ঐক্য ও সংহতি বজায়ের জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছেন। বিষয়টি এখন দলের শীর্ষ পর্যায়ে মীমাংসা ও সমঝোতার জন্য উপস্থাপিত হয়েছে।  

দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা কমিটিতেও বিরাজ করছে নেতাদের মধ্যকার ব্যক্তিগত দলাদলি ও কোন্দল। এসব কোন্দল মেটানো এবং সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেই বললেই চলে। ফলে বিগত দিনের আন্দোলন-সংগ্রামে ব্যাপক জনসমর্থন ও কর্মী বাহিনী থাকার পরেও নেতৃত্বের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সর্বজনগ্রাহ্যতার অভাবে বিএনপি ঐক্যবদ্ধভাবে জোরালো শক্তি নিয়ে মাঠে নামতে ব্যর্থ হয়।

তৃণমূলের মতোই স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মধ্যেও নিজস্ব প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা রয়েছে। একাধিক সভায় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতেই সদস্যরা পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করেছেন এবং নানা ইস্যুতে ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়েছেন। কেন্দ্রীয় কমিটির মতোই নাজুক অবস্থা মহানগরীতেও। সেখানে নেতাদের মধ্যে দূরত্ব বিরাজ করছে। ওয়ার্ড ও থানা কমিটিগুলোও পরিচালিত হচ্ছে বিভিন্ন নেতার পছন্দের লোকদের দ্বারা। বিএনপির আদর্শ ও রাজনীতির প্রচার-প্রসারের বদলে নিজ নিজ নেতার অনুসরণই এখন মহানগরের নেতা-কর্মীদের প্রধান কাজ। গ্রুপ নেতার নিজস্ব স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে গিয়ে দলের মূল লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, আদর্শ, নীতি ও কর্ম-কৌশল বাস্তবায়িত করা অনেক সময়ই রক্ষিত হচ্ছে না। ফলে বিএনপির বিশাল কর্মী-সমর্থন ও মাঝারী সারির নেতারা শীর্ষ স্তরের নানা নেতৃত্বের ব্যক্তিগত বলয়ে আবর্তিত হচ্ছেন। শীর্ষ নেতাদের মধ্যকার দূরত্বের কারণে অনুসারীরাও ঐক্যবদ্ধ না হয়ে পারস্পরিক দূরত্বে অবস্থান করছেন।  

প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নানা দল ও গ্রুপ থেকে লোক নিয়ে বিএনপি গড়ে তোলার সময় তাদের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদভিত্তিক অ্যান্টি-আওয়ামী লীগ ও ভারত-বিরোধিতার একটি আদর্শিক জায়গায় একতাবদ্ধ করেছিলেন। জিয়ার পর দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকাকালে দলের আদর্শিক ও সাংগঠনিক জায়গাটিকে মজবুত করা হয়নি। বরং বিভিন্ন ব্যক্তির স্বার্থ এবং অর্থ-বিত্তভিত্তিক বিবেচনায় দল পরিচালিত হয়েছিল। যে কারণে আদর্শগত নয়, ব্যক্তিগত নেতৃত্বই প্রাধান্য পেয়েছে দলটিতে। মাঝে তরুণ নেতা তারেক রহমান তৃণমূলসহ সংগঠনের সর্বক্ষেত্রে একটি আদর্শিক প্রণোদনা সৃষ্টির চেষ্টা করলেও সেটা সফল হয়নি। দলের প্রবীণ নেতৃত্ব ও কোটারি সুবিধাপ্রাপ্তরা তারেকের নেতৃত্বে দেশব্যাপী নতুন নেতৃত্ব বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে হাওয়া ভবনসহ নানা ইস্যুতে তারেককে বিতর্কিত করা হয়।  

অভিজ্ঞ মহল মনে করেন, তারেক রহমানের বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ দলগুলোর আক্রমণের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল দলের ভেতরের অনেকেই। এখনও দলীয় কোন্দল সংগঠনের বৃহত্তর ঐক্যের অন্তরায়। কোন্দলের কারণে বিভিন্ন স্থানে কমিটি গঠন করা যাচ্ছে না। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি পুনর্গঠিত হচ্ছে না। দলের কাঠামোয় সবাইকে সুসংগঠিত করার মাধ্যমে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার পরিস্থিতি বিএনপিতে অনুপস্থিত। তারপরেও এখনও পর্যন্ত দলের একমাত্র ঐক্যস্থল হিসেবে খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী বিপুল নেতা-কর্মী-সমর্থক দলটির পেছনে রয়েছে। কিন্তু এদের সাংগঠনিক জনশক্তিতে রূপান্তরিত করে দলের শক্তি বৃদ্ধি করার মতো অবস্থা নষ্ট হচ্ছে-- প্রথমত অপরাপর শীর্ষ নেতাদের উপদলভিত্তিক কোন্দল ও গ্রপিংয়ের কারণে, এবং দ্বিতীয়ত সাংগঠনিক মেধা ও যোগ্যতাসম্পন্ন নেতার অভাবে।  

বিএনপিতে এখন প্রচুর নেতা আছেন বটে। কিন্তু সেসব নেতাদের মধ্যে সংগঠক আছেন খুব কমই। নিজের নেতৃত্বের বাইরে দলের সংগঠন বিস্তারে সচেষ্ট হতে পারেন এমন চরিত্র বিএনপিতে অনুপস্থিত।  

পরের কিস্তি পড়ুন: দিশেহারা বিএনপি-৬: নেতা বহু, সংগঠক নেই একজনও

বাংলাদেশ সময়: ১৬০৪ ঘণ্টা, মে ০১, ২০১৭

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।