ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

আওয়ামী লীগ

বাংলানিউজকে স্পিকার

বঙ্গবন্ধুর ট্রিমেন্ডাস প্রভাব তো আছেই

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮০০ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৬
বঙ্গবন্ধুর ট্রিমেন্ডাস প্রভাব তো আছেই স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী

ঢাকা: ‘রাজনীতির আবহে বড় হয়েছি। আমাদের বাড়ির খাবার টেবিলে, চায়ের টেবিলে রাজনীতি, বিশ্ব রাজনীতি নিয়ে অনেক আলোচনা হতো।

বাবাকে দেখতাম বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কাজ করতেন। এর একটা ট্রিমেন্ডাস প্রভাব তো আছেই। ’

নারীরা সারাজীবন অন্যের জন্য করেন

এ কথা বলে নিজের অতীত চারণে খানিক বিরতি দেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।   তারপর একে একে মেলে ধরেন স্মৃতির ঝাঁপি। একটু একটু করে বলতে থাকেন জীবনের সব স্তরে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে রাজনীতিতে পরিণত হয়ে ওঠার গল্প।

কেবল রাজনীতিরই নয় উঠে আসে ব্যক্তি ও শিক্ষা জীবনের কথাও।

আমার পীরগঞ্জের মানুষ কমপ্লিকেটেড না

এসএসসিতে ঢাকা বোর্ডে মানবিক বিভাগে মেধা তালিকায় প্রথম (১৯৮৩) হয়েছিলেন। দ্বিতীয় হয়েছিলেন এইচএসসিতে (১৯৮৫)। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি (১৯৮৯), এলএলএমে (১৯৯০) দুটোতেই ফার্স্টক্লাস ফার্স্ট। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিট অব অ্যাসেক্স থেকে সাংবিধানিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে পিএইচডি।

দেশের প্রথম নারী স্পিকারের মেধার পরিচয়ে বোধ করি আর কোনো বিশেষণের প্রয়োজন পড়ে না। মেধাবৃত্তির এমন উচ্চস্তরে নিজেকে মেলে ধরার পর কেনো রাজনীতির চ্যালেঞ্জ নিয়ে মাঠে নামলেন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী?
 
যার দাদা সিকান্দার আলী তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের বিচারপতি, যার বাবা রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন বঙ্গবন্ধু সরকারের সচিব, যার মা নাইয়ার সুলতানা ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ও পিএসসি সদস্য- তাদের উত্তরসূরি হয়ে রাজনীতিতে কেনো?

এমন প্রাসঙ্গিক এক প্রশ্নের জবাবেই স্মৃতির আয়না থেকে ধুলো সরিয়ে অতীতের ক্যানভাসে নিজেকে মেলতে শুরু করেন সবচেয়ে কম বয়সে (৪৬ বছর) জাতীয় সংসদের স্পিকার হয়ে ওঠা শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, আমাদের বাড়িতে সবসময় রাজনীতির পরিবেশটা ছিল। এখন যারা বড় বড় নেতা তাদের অনেকেই কিন্তু আমাদের বাড়িতে যাতায়াত করতেন। কাজেই আমি সেভাবেই বড় হয়েছি। পরবর্তীতে আমি যখন আইন পেশায় জড়িত হয়ে গেলাম, তখন থেকেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কমিটি, সাব কমিটিতে কাজ করতে থাকি। বিশেষ করে, নির্বাচন উপ কমিটি-এগুলোতে কাজ করি।

কিন্তু রাজনীতির আসল ভিতটা গড়ে দেন আমার বাবা রফিকুল্লাহ চৌধুরী। নোয়াখালীর চাটখিলের পাঁচগাও গ্রামে তার জন্ম। বাবা যখন স্কুলে অষ্টম বা দশম শ্রেণীতে পড়েন, তখন থেকেই কিন্তু ছাত্রলীগ করতেন। যখন ক্লাস টেন এ মেট্রিক পরীক্ষা দেন, তখন আমার চাচারা নৌকা নিয়ে হলের বাইরে বসে থাকতেন। কারণ তার (বাবার) বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ছিল। বাবার পরীক্ষা শেষ হলে হল থেকে বের হলেই নৌকাতে অন্য জায়গায় চলে যেতে হতো, না হলে তাকে ধরে ফেলবে, গ্রেফতার করবে, পরীক্ষাটা দিতে পারবেন না। এরকম ‘ডাই-হার্ড’ ছাত্রলীগ করা লোক আমার বাবা, সেই স্কুল জীবন থেকেই।

বাবা প্রসঙ্গে নস্টালজিক হয়ে পড়া শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রথম নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন আমার বাবা। যাই হোক, আমার বাবা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ‘‌‌পিওরলি সিলেকশন’। বাবা ছাত্রলীগের সভাপতি হলেন। কিন্তু তার আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিলো আইনজীবী হওয়ার। তিনি আইন পেশায় থাকবেন এবং রাজনীতি করবেন। তখন একটা পয়েন্টে (এক সময় এসে) বঙ্গবন্ধু বাবাকে বললেন, তুই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দে। তোর মত মেধাবি ছাত্র আমার প্রশাসনে দরকার। তখন বাবা তার নেতার কথায় ১৯৬১ সালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দেন।

স্পিকার বলতে থাকেন, বাবা প্রশাসনে যোগ দিয়েছেন, কিন্তু ছাত্রলীগের সেই সত্ত্বা কোন দিন বিসর্জন দেননি। নেতার নির্দেশে পরীক্ষা দিয়েছেন, নিজের জীবনের মোড় ঘুড়ে গেছে, আমলা হয়ে গেছেন, কিন্তু ভেতরে যে সত্ত্বা সেটা রয়েই গেছে। চিরকাল তার ভেতরে ছাত্রলীগের সত্ত্বা জাগ্রত ছিল। শুনেছি, সিভিল সার্ভিস একাডেমির ট্রেনিং  এ নোটিশ করা হয়েছিল, তিনি (বাবা) কোন ডিবেটেই মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ‘কায়েদে আজম’ সম্বোধন করেননি, শুধু বলতেন ‘মিস্টার জিন্নাহ’। এটাও কিন্তু পয়েন্ট হিসেবে নোটেড করা হয়, যে, এই ছেলেটা কখনো কায়েদে আযম বলে না, শুধু মিস্টার জিন্নাহ বলে। ছেলেটা কে?
 
স্পিকার বলেন, পরে তো দেশ স্বাধীন হলে বাবাকে বঙ্গবন্ধু তার সচিব করলেন। তারপর বাবা তার সঙ্গে কাজ করলেন। যোগ্য বাবার যোগ্য উত্তরসূরি শিরীন শারমিন চৌধুরী রাজনীতিতে নেমেই কিন্তু ভেলকি দেখাতে শুরু করলেন। ওয়ান-ইলেভেনের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে গ্রেফতার হওয়া বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য যে আইনজীবী প্যানেল গঠন করা হলো-তাতে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেন তিনি।

যার ফলশ্রুতিতে সংরক্ষিত আসনের এমপি হয়ে পেলেন মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর তৎকালীন স্পিকার আব্দুল হামিদকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দেওয়া হলে যুগান্তকারী এক সিদ্ধান্ত নিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার মন্ত্রিসভার নম্র-ভদ্র, মার্জিত শিরীনকে বসিয়ে দিলেন স্পিকারের গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে।   দেশের ইতিহাসে সংসদের প্রথম নারী স্পিকার হিসেবে লেখা হলো শিরীন শারমিন চৌধুরীর নাম। দেশের সর্বকনিষ্ঠ স্পিকার হওয়ারও রেকর্ডও গড়লেন তিনি।

তারপর সেই নবম জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হলো। দশক সংসদেও স্পিকার হয়ে দক্ষ হাতে অধিবেশন পরিচালনা করতে করছেন তিনি। মেধার স্বাক্ষর রাখছেন কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (সিপিএ) চেয়ারপারসন হিসেবে। মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন ফোরামে কাজ করেও বিশ্বব্যাপী নাম কুড়িয়েছেন ‘সাংবিধানিক আইন ও মানবাধিকার বিষয়ে ডিএইচডি ডিগ্রি ‍অর্জনকারী শিরীন শারমিন চৌধুরী।

আর এমন সব অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়িয়েই রাজনীতির মাঠে জনসেবার কাজটাকে আরো সুচারুভাবে এগিয়ে নিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করতে চান তিনি।

তাই অকপটে বলেন, হ্যাঁ, আমার লেখাপড়ার রেজাল্ট ভাল, সবই ভাল, কিন্তু বাবা কখনো চাননি আমি প্রশাসনে আসি, বিসিএস দিই।

তাছাড়া আমার নিজেরও আগ্রহ ছিল স্বাধীন পেশায় কাজ করার। আইন একটা স্বাধীন পেশা, কারো অধীনে কাজ করতে হয় না। নিজেই নিজেরটা করতে হয়। এভাবেই আইন পেশায় আসা। পরে তো রাজনীতিই ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠলো। কার্যত নিজের বাবার ওপরে বঙ্গবন্ধুর যে ট্রিমেন্ডাস প্রভাবের যে কথা বলেছেন, সেটাই পরবর্তীতে প্রবাহিত হয়েছে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর রক্তে। আর নিজের ছেড়ে দেওয়া রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনে নির্বাচনের সুযোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো পরিণত করে তুলেছেন তাকে।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জননী। তার স্বামী সৈয়দ ইশতিয়াক হোসেন একটি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির কনসালট্যান্ট।

কথায় কথায় বেলা পড়ে আসে। স্পিকারের অফিস কক্ষটিতে তবু অবাধ আলো। আর সব সরকারি স্থাপনার মতো দিনের বেলায় বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানোর প্রয়োজন পড়ে না স্পিকারের কক্ষে। যেনো বৃষ্টি হলে দেওয়াল জোড়া কাঁচের শরীরে হাত রেখে অনুভব করা যাবে প্রকৃতিতে। সিলিংয়েও খানিকটা জায়গায় স্বচ্ছ কাঁচ আকাশের সঙ্গে মিতালির সুযোগ করে রেখেছে।

অফিসে বসেই দেখা যাবে, বজ্র-বিদ্যুতের ঝলকানি, কালবোশেখির দাপট। এভাবেই প্রকৃতির কাছাকাছি রিখে এই স্থাপত্যের নকশা করেছেন ল‍ুই আই কান।

ঘরে অপর দেওয়ালগুলোতে ভারি কাঠের পালিশ করা আলগা দেওয়াল চকচক করছে। স্পিকারের পেছনে সেই চকচকে দেওয়ালেই ঝুলছে এই সংসদে এর আগে দায়িত্বপালন করা স্পিকারদের নাম ও ছবি। সেই তালিকার নিজের অংশে শিরীন শারমিন চৌধুরীর নামটা জ্বলজ্বল করছে টানা দু’ঘরে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪২ ঘণ্টা, মে ১০, ২০১৬
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।