ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

রাজনীতি

পাল্টে যাচ্ছে জামায়াতের নেতৃত্ব!

মান্নান মারুফ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১০১ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১০
পাল্টে যাচ্ছে জামায়াতের নেতৃত্ব!

ঢাকা: পাল্টে যাচ্ছে জামায়াতের নেতৃত্ব। যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জড়িয়ে পড়া এবং বিভিন্নভাবে বিতর্কিত জ্যেষ্ঠ নেতাদের সরিয়ে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বসতে চাইছেন অপেক্ষাকৃত নতুনরা।



দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসতে চাইছেন অপেক্ষাকৃত তরুণ ও ‘কিনম্যান ইমেজ’ এর অধিকারী সাবেক শিবির নেতারা। তাদের কারোরই বয়স ৫০ এর বেশী নয়। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা সম্ভব নয় এমন নেতারাই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে আসতে চান।

এদের মধ্যে প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি অধ্যাপক তাসনীম আলম কেন্দ্রীয় জামায়াতের আমীর হচ্ছেন বলে দলীয় ও জামায়াত সমর্থক পরিমণ্ডলে জোর জল্পনা রয়েছে। আর সম্ভাব্য সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে আলোচনায় রযেছেন মহানগর সেক্রেটারি হামিদুর রহমান আযাদ এমপি ও নুরুল ইসলাম বুলবুল।

নেতৃত্বের পরিবর্তনে আগ্রহীরা মনে করছেন, জামায়াতে ইসলামীতে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের ৭ শ’ ৭২ জন সিনিয়র শিবিরনেতা রয়েছেন। তাদের ২শ’ ২৩ জন জামায়াতের নেতৃত্ব দিতে ও পরবর্তী সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে সক্ষম। এছাড়া সারাদেশে ৮৩ হাজার শিবিরকর্মী রয়েছেন।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, জামায়াতের নেতৃত্বে পরিবর্তন নিয়ে ফলপ্রসু আলোচনার জন্য শিগগিরই শিবিরের সাবেক সভাপতি, সেক্রেটারি ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা বিশেষ বৈঠকে বসছেন। এখন এ নিয়ে নিজেদের মধ্যে মোবাইল ফোনে আলাপ চালাচ্ছেন তারা। এছাড়া যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও।

পরিবর্তন প্রত্যাশীরা মনে করছেন, নেতৃত্ব  থেকে জ্যেষ্ঠদের সরিয়ে দিলে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে জামায়াতকে বেকায়দায় ফেলা কঠিন হবে। তাছাড়া বিতর্কিতদের সরিয়ে রেখে দল আরও শক্তিশালী করাও সহজ হবে। তাই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পরিবর্তন অপরিহার্য বলে মনে করছেন তারা। যেসব জ্যেষ্ঠ নেতার যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে ফেঁসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে তাদের পক্ষে মাঠে নামতেও এখন তীব্র আপত্তি রয়েছে তাদের।

শীর্ষ নেতারা গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের পক্ষে অর্ধশতাধিক কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেও সেগুলোতে পরিবর্তন-কামী সাবেক শিবিরনেতাদের কমই অংশ নিতে দেখা গেছে।

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সাবেক শিবিরনেতা বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে বলেন, ‘আমাদের দলে কোনো যুদ্ধাপরাধী নেই। কিন্তু যেহেতু এটিকে ইস্যু তৈরি করে জামায়াতকে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টা চলছে তাই রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে আমরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে তরুণদের চাইছি। ’

অপর এক সাবেক শিবিরনেতা বলেন, ‘যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে যাদের গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা আছে তাদের আর নেতৃত্বে না থাকাই ভালো। ’

জামায়াতের প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি তাসনীম আলম বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে বলেন, ‘পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে দলে অনেক পরিবর্তন হতে পারে। তবে এটা সময়ের ব্যাপার। আর নেতৃত্ব পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেবে সুরা কমিটি। ’

দলের আমীর ও সেক্রেটারি জেনারেল কে হচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সময় হলেই সব দেখতে পাবেন। নতুন নেতা কে হবেন তা আগে বলা মুশকিল। ’

দলীয় হিসেবে সারাদেশে ৭৬ লাখ জামায়াত কর্মী, ৫৫ লাখ রোকন ও তিন হাজার মধ্যম সারির নেতা রয়েছেন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিবির নেতা।

সূত্র জানায়, বর্তমানে সাবেক শিবির নেতা মীর কাশেম আলী, আবু নাসের মুহাম্মদ রহমত উল্লাহ, যোবায়ের আহমেদ, মতিয়ার রহমান আকন্দ, বুলবুল আহম্মেদ, মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম খান, রফিকুল ইসলাম মাসুদ, সেলিম উদ্দিন, মোহাম্মদ মজিবুর রহমান, জাহিদুর রহমান, নজরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার আমীর হোসেন আযাদ, শামসূল ইসলাম, রেজাউল করিমসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের দেড় শতাধিক শিবির নেতা জামায়াতের সারাদেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করছেন।

জামায়াতের মূল নেতৃত্বে পরিবর্তন এলে এদের অনেককেই বড় পদে দেখা যেতে পারে বলে জানিয়েছে দলীয় সূত্র।

জানা গেছে, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে পাঁচ শীর্ষ নেতা গ্রেপ্তার হওয়ার পর জামায়াত নেতাকর্মীদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে মহানগর জামায়াত আমীর রফিকুল ইসলাম খানসহ আরও অনেকেই আত্মগোপনে আছেন। এছাড়া নির্বাহী পরিষদের ছয় নেতা ছাড়াও জেলা পর্যায়ের ৭৭ জন জ্যেষ্ঠ নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার অভিযোগ। যে কোনো সময় তাদেরও গ্রেপ্তার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তাহলে শিবিরের সাবেক নেতারা জামায়াতের হাল ধরতে চান।

প্রসঙ্গত, জামায়াত আমীর মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর মকবুল আহমাদকে ভারপ্রাপ্ত আমীর ও এটিএম আজহারুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল করা হয়। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধেও হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার অভিযোগ রয়েছে।  

এছাড়া কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য একেএম ইউসুফ, আবদুস সুবহান, আবু নাসের মোহাম্মদ আবদুজ জাহেদ ও মীর কাসেম আলী যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তার হলে কেন্দ্রীয় সুরা কমিটির ১৫ সদস্যের মধ্যে ১১ পদই শূন্য হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্যদের মধ্য থেকে শূন্য পদ পূরণ করা হবে বলে জানা গেছে। আর কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের অধিকাংশই সাবেক শিবিরনেতা।

তবে জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমীর এটিএম আজহারুল ইসলাম শিগগিরই দলের নেতৃত্বে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে তিনি বলেন, ‘দলে পরিবর্তন আসবে, তবে সময় লাগবে। হঠাৎ করে শীর্ষ নেতারা গেপ্তার হওয়ায় দলে কিছুটা অস্থিরতা থাকতেই পারে। আমরা তা কাটিয়ে দলকে আরও এগিয়ে নিতে কাজ করে যাচ্ছি। জ্যেষ্ঠ নেতাদের পরামর্শেই সাংগঠনিক কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। ’

জামায়াতে নেতৃত্ব নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব নেই বলেও দাবি করেন এই নেতা।

তার অনুসারি এক নেতা বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে জানান, আমীর পদে এখনই পরিবর্তন আনতে রাজি নয় জামায়াত। আমীর পদ শূন্য হলে গঠণতন্ত্র অনুযায়ী নায়েবে আমীরদের মধ্য থেকে একজনকে ভারপ্রাপ্ত আমীর নিয়োগ দেওয়া হবে। ভারপ্রাপ্ত আমীর ছয় মাসের মধ্যে নতুন আমীর নির্বাচনের ব্যবস্থা নেবেন। তবে মজলিসে সুরা ভারপ্রাপ্ত আমীরের মেয়াদকাল আমীরের বাকি মেয়াদ পর্যন্ত বাড়াতে পারবেন।

ওই নেতা আরও জানান, মতিউর রহমান নিজামী সর্বশেষ গত ডিসেম্বরে আমীর নির্বাচিত হওয়ায় ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত তার মেয়াদ রয়েছে। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে আর কাউকে আমীর নিয়োগ দেওয়া হবে না। তবে সেক্রেটারি জেনারেল, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের শূন্য পদগুলো পূরণ করা হবে।

অপর এক সূত্র জানায়, মকবুল আহমাদ গ্রেপ্তার হলে দুই নায়েবে আমীর নাজির আহমেদ ও রফিউদ্দিন আহমদের মধ্য থেকে একজনকে ভারপ্রাপ্ত আমীরের দায়িত্ব দেওয়া হবে। আর ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেলের দায়িত্ব পেতে পারেন দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুজিবুর রহমান ও শফিকুর রহমানের যে কেউ।

তবে কেন্দ্রীয় জামায়াতের সঙ্গে মিলছে না সাবেক শিবির নেতাদের হিসাব। যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আছে তাদের ছাড়াই দল এগিয়ে নিতে চাইছেন তারা। প্রয়োজনে নিজেরাই ধরতে চাইছেন জামায়াতের হাল।

বাংলাদেশ সময় ১২২৪ ঘণ্টা, আগস্ট ০৮, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।