ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

রাজনীতি

রাজনীতির মাঠ থেকে সরে যাচ্ছেন তিন শতাধিক প্রবীণ নেতা

মান্নান মারুফ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪৫৬ ঘণ্টা, আগস্ট ৫, ২০১০
রাজনীতির মাঠ থেকে সরে যাচ্ছেন তিন শতাধিক প্রবীণ নেতা

ঢাকা: আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ বিভিন্ন ছোট-বড় রাজনৈতিক দলের বেশিরভাগ অভিজ্ঞ ও প্রবীণ নেতা রাজনীতির মাঠ থেকে নীরবে সরে যাচ্ছেন। অতীতে দেশের নানা আন্দোলন-সংগ্রাম, উত্থান-পতন, সংকট, প্রতিকুলতা আর নানা ঐতিহাসিক ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক জীবন অতিবাহিত করেছেন এসব নেতা।

এদের অনেকের অর্জনের পাল্লা ভারী। নিজেদের দলের যেমন,তেমনি দেশের দু:সময়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভ’মিকা। কিন্তু এখন তাদের অনেকেই দলে আগের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে আর নেই। সে কারণেও আগের মতো ভ’মিকা পালনের সুযোগও তারা আর পাচ্ছেন না। দলে শারীরিক উপস্থিতির বাইরে তাদের নেতৃত্বের ভ’মিকাটি তাই হয়ে উঠেছে গৌণ। এক কথায়,বঞ্চিত ও অবহেলিত এসব নেতা যেন থেকেও নেই।

রাজনৈতিক অঙ্গনে এ রকম অবহেলিত প্রবীণ নেতাদের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। হিসেব কষে দেখা গেছে, এদের সংখ্যা তিন শ’ ছাড়িয়ে যাবে।

এই নেতারাই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়ে, কষ্ট, লাঞ্ছনা, জেল-জুলুম সহ্য করে দলকে সংগঠিত করেছেন।

এক সময় এই নেতাদের চারপাশে ছিল কর্মীদের ভিড়। কি বাসা, কি দলীয় কার্যালয় সর্বত্র তাদের ঘিরে থাকতেন াণুগামী আর অনুসারীরা। জনপ্রিয়তারও কমতি ছিল না। কিন্তু এখন তাদের কেউ খোঁজ রাখে না। তারা অবহেলা আর মর্যদাবঞ্চিত হয়ে এখন হয় ঘরের চার দেয়ালবন্দি, নয় ব্যক্তিগত ব্যবসা বাণিজ্যেই বেশি সময় কাটাচ্ছেন।

বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি এর জন্য প্রধানত দায়ী বলেই মনে করছেন রাজনীতিবিদরা।

দলের গ্রুপিংয়ের কারণে এবং ওয়ান ইলেভেনের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তিন শতাধিক নেতা একযোগে কোনঠাসা হয়ে পড়েন। এছাড়া বার্ধক্য, দলবদল, দুর্নীতির অভিযোগে মামলার শিকার হওয়া , বার বার নির্বাচনে হার, দলের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং ইত্যাদি কারণেও রাজনীতির মাঠ থেকে অনেকে এরই মধ্যে ছিটকে পড়েছেন বা ছিটকে পড়ার পথে।

এছাড়া ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে অতিথি পাখির মত অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের আসন দখল করাকে কেন্দ্র করেও দলের ‘ত্যাগী’ নেতাদের অনেকেই নিজে থেকেই ক্ষোভে-দুঃখে-অভিমানে দূরে সরে গেছেন এমন উদাহরণও কম নয়।

ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্যে রাজনৈতিক আদর্শ ও বিশ্বাসের দিক থেকে আকাশ-প্রমাণ অমিল থাকলেও এই দিকটায় দু’দলের চ্ত্রি প্রায় এক।

এক সময়ের দোর্দণ্ড প্রতাপ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম এ প্রসঙ্গে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে বলেন, ‘দলে অবহেলিত ঠিক না, তবে আমরা ওয়ান ইলেভেনের যড়যন্ত্রের স্বীকার। আমাদের নির্যাতন করা হয়েছে। ’  
ওয়ান ইলেভেনে নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলে আরো বিপদে পড়ে এখন বাসায় সময় কাটাচ্ছেন আব্দুল জলিল। তিন বছর আগেও তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যাক্তি। কিন্তু আজ ঘরেই কাটছে তার দিন। তার কাছে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি’র পক্ষ থেকে ‘কেমন আছেন’ জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘ভাল আছি। বয়স হয়ে গেছে, আর কত!’  

নীতিনির্ধারকের পর্যায়ে থাকা এইসব প্রবীণ নেতা একসময় যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দিতেন দলীয় প্রধান পর্যন্ত তা অনেক সময় মেনে নিতেন। অথচ আজ এদের অনেকের সঙ্গে দলীয় প্রধানের দেখা-সাক্ষাৎটুকুও নেই। অন্যরাও তাদের খুব একটা খোঁজ খবর নেন না।

বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন এর সাথে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলেও ও-প্রান্ত থেকে নাম প্রকাশ না করে এক জন বললেন, ‘উনি ব্যস্ত। পরে ফোন করুন। ’

বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ক্ষমতার আসল কেন্দ্র বলে আলোচিত ‘হাওয়া ভবনের’ এক প্রভাবশালী ছিলেন চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জেড এ খান। এখন তার সময় কাটছে অনেকটাই পারিবারিক পরিমন্ডলে।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে তিনি বলেন, ‘আমরা বেকায়দায়, এমনিতেই দল থেকে বহিষ্কার অবস্থায় আছি, আমাদের প্রিয় নেতা আব্দুল মান্নান ভুঁইয়া আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, মনটা এখন ভাল না। বাসায় সময় বেশি কাটছে। তবে দু’একটা পারিবারিক অনুষ্ঠানে যাই। ’

তবে এখনো নিরাশ নন বিএনপি’র এই নেতা। তিনি বলেন, ‘কি হয় দেখি, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। ’

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের মধ্যে যারা কোনঠাসা হয়ে রয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন- আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, অমল বোস, আব্দুল জলিল, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ, তালুকদার আব্দুল খালেক, মোহাম্মদ নাসিম, সাবেক মন্ত্রী নূর উদ্দিন খান, সাবেক সেনা প্রধান কে এম শফিউল্লাহ, কাজী সিরাজ, শামিম ওসমান, অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল নুরউদ্দিন খান, হাজি মোহাম্মদ সেলিম, ডা: এইচ বি এম ইকবাল, সাঈদ খোকন, খ ম জাহাঙ্গির হোসাইন, মোস্তফা মহসিন মন্টু, হেমায়েতউল্লাহ আওরাংঙ্গ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, মাহমুদুর রহমান মান্না, আসাদুজ্জামান নুর, সাবের হোসেন চৌধুরী, শেখ শহিদুল ইসলাম জাফরুল্লাহ চৌধুরী, রফিকুল ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক নুরুল মজিদ হুমায়ুন, আলহাজ্ব মকবুল হোসেন ।

বিএনপি’র নেতাদের মধ্যে রয়েছেন- আবদুর রহমান বিশ্বাস, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, আকমল ইবনে ইউসুফ, আব্দুল মতিন চৌধুরী, মীর শওকত আলী, আশরাফ হোসেন, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল জেড এ খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত মেজর আব্দুল মান্নান, হারিছ চৌধুরী, এম মোরশেদ খান, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা, সালাউদ্দিন আহম্মেদ, তৈমুর আলম খোন্দকার, সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল, অবসরপ্রাপ্ত মেজর আখতারুজ্জামান রঞ্জন, অবসরপ্রাপ্ত  উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ, গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী, সানাউল হক নীরু, নুরুল ইসলাম মনি, ফজলুল হক আসফিয়া, এবাদুর রহমান চৌধুরী, কবির হোসেন, সাবেক স্পিকার শেখ রাজ্জাক আলী, নুরুল ইসলাম দাদু ভাই, ডা: এম এ মতিন, মোফাজ্জল করিম, আবুল হাসেম, গৌতম চক্রবর্তী, কাজী জাফর আহমেদ, মাইদুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আমছা আমিন, কাজী ফিরোজ রশিদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মোসাদ্দেক আলী ফালু, অ্যাডভোকেট খোন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমাদ, ,অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মাহমুদল হাসান, ড. ওসমান ফারুক, মুসফিকুর রহমান, উকিল আব্দুস সাত্তার, সুনীল গুপ্ত, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আনোয়ার হোসেন চৌধুরী, ব্যারিস্টার আবুল হাসনাত, অধ্যক্ষ আবাদুল রশিদ, ফজলুর রহমান পটল, হাসানউদ্দিন সরকার, মোশাররফ হোসেন শাজাহান, খালেদুর রহমান টিটো প্রমুখ।

এছাড়াও তালিকায় রয়েছেন বিভিন্ন সময়ে দলছুট গুরুত্বপূর্ণ নেতা ডক্টর কামাল হোসেন, ডা: এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু প্রমুখ।

এদের বেশির ভাগ নেতাই নিজস্ব ব্যবসা ও পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ছাড়া আর কোন কাজ করছেন না বলে জানা গেছে।
 
রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে পড়ে অবহেলার শিকার হয়ে মানসিক কষ্টে থেকে শেষ পর্যন্ত ফুসফুসের ক্যান্সারের কাছে হার মেনে চিরবিদায় নিয়েছেন বিএনপির সাবেক মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভুইয়া।

বাংলাদেশ সময় ১৬৩৪ ঘণ্টা, আগস্ট ০৫, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।