ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

রাজনীতি

বেসামাল বিএনপি নিয়ে বেকায়দায় খালেদা

মান্নান মারুফ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৯ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১১
বেসামাল বিএনপি নিয়ে বেকায়দায় খালেদা

ঢাকা: সরকারকে মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাধ্য করার হুঙ্কার দিয়ে দলীয় কোন্দল সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

একদিকে কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রভাব বিস্তারের লড়াই সকল পর্যায়ের কর্মীদের বহুধাবিভক্ত করে রেখেছে, অন্যদিকে প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে সহযোগী সংগঠনগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্ব।



সম্প্রতি ঢাকা মহানগর বিএনপির আহবায়ক কমিটি ঘোষণার পর রাজধানীর নেতা-কর্মীদের মধ্যে অস্থিরতা যেমন বেড়েছে, তেমনি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দলীয় বিভাজন।

এ অবস্থা সামাল দিতে দলটির চেয়ারপারসনও গলদঘর্ম হচ্ছেন বলে আলোচনা চলছে দলীয় পরিম-লে।

দলীয় সূত্রমতে, খালেদা জিয়া রোববার দেশে ফিরেই দলের নীতি নির্ধারকদের জানিয়েছেন,  দলীয় কোন্দল মেটানোর জন্য শিগগিরই বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন তিনি।  

দলীয় সূত্রমতে, দলের ভাইস-চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকাকে আহবায়ক করে গত ১৫ মে মহানগর কমিটি ঘোষণার পর থেকেই স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং সাবেক সাংসদ সালাউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মহানগর বিএনপির একাংশের নেতাকর্মীরা এর তীব্র বিরোধীতা করে আসছেন।

মহানগর কমিটির ঘোষণার পরদিন ১৬ মে ভাসানী মিলনায়তনে আয়োজিত মহানগর বিএনপির সংবর্ধনায় দেখা যায়নি শ্যামপুর, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, খিলগাঁও, সবুজবাগ, মতিঝিল ও পল্টনসহ ১০ থানার নেতাকর্মীদের। গত ১৯ মে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে ফুল দেওয়ার সময়েও খোকার সঙ্গী হননি ওই ১০ থানার নেতা-কর্মীরা। মহানগর বিএনপির এ বিভক্তি দেখে কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জিয়ার মাজারেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।

খোকাকে মহানগর বিএনপির আহবায়ক করায় কেবল আব্বাস ও গয়েশ্বরই নন, স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গনি ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ এবং যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ সিনিয়র নেতাদের অনেকেই নাখোশ হন।

ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপিতে শুরু হওয়া সংস্কারপন্থি আন্দোলনের অন্যতম হোতা হিসেবে তারা চিহ্নিত করেন খোকাকে। ওই সময় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের চাবি আটকে রাখার জন্য তারা দায়ী করেন সদ্য ঘোষিত মহানগর কমিটির সদস্য সচিব আব্দুস সালামকে।

এসব নিয়ে মির্জা আব্বাস, হান্নান শাহ ও গয়েশ্বর রায়রা প্রকাশ্যে কথা বলতেও শুরু করেছেন।

এদিকে রাজপথে আন্দোলন জমানোর অন্যতম শক্তি ঢাকা জেলা বিএনপি নিয়েও চলছে বহুমুখী দ্বন্দ্ব।

দ্বিপাক্ষিক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছেন আমান উল্লাহ আমান-আবদুল মান্নান, ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা-আবদুল মান্নান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়-আমান উল্লাহ আমান, ডা. দেওয়ান সালাহ উদ্দিন-মেজর মিজান প্রমুখ।

তিন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, রফিকুল ইসলাম মিয়া ও নাজমুল হুদার ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব নিয়েও বেশ বেকায়দায় আছেন দলীয় প্রধান।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্যানেলের নিরঙ্কুশ জয়ের পর তাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও রফিক-হুদার দ্বন্দ্বের প্রকাশ্য মহড়া অনুষ্ঠিত হয়।

এদিকে হবিগঞ্জ-৩ আসনের উপ-নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থীর নিরঙ্কুশ জয়ের পর সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর দাপট অনেক বেড়ে গেছে বলে জানিয়েছে দলীয় সূত্র।

সূত্রমতে, হবিগঞ্জে জয়ের অন্যতম কৃতিত্ব ইলিয়াস আলীকে দিয়ে প্রকাশ্যেই তার প্রশংসা করেন খোদ চেয়ারপারসন। এর পর থেকেই সিনিয়র নেতাদের অবজ্ঞা করতে শুরু করেন ইলিয়াস।

গত ২৯ এপ্রিল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে দু’জন ভাইস-চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে থাকলেও ইলিয়াস আলী কিছুতেই চেয়ার ছাড়ছিলেন না। পরে মির্জা ফখরুলের হস্তক্ষেপে সিনিয়র নেতাদের বসার ব্যবস্থা হয়।

এ ঘটনায় দলের সিনিয়র নেতারা ক্ষুব্ধ হন।

গত ৯ মে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশে স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু ও সাংসদ শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী গ্রুপের হাতাহাতিতে অন্তত আট জন আহত হন।

এতে জনসভাই প- হয়ে যায়।

সূত্রমতে, গত তত্ত্বাবধায়ক আমল থেকেই সাংগঠনিকভাবে সুসংহত হয়ে ওঠায় স্বেচ্ছাসেবক দলের বর্তমান সভাপতি হাবিব উন নবী খান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক মীর শরফত আলী সপুর দম্ভ বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ আছে। তাই এ্যানীকে লাঞ্ছিত করতেও দ্বিধা করেননি সপু।

আর গত কয়েক মাসে বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচিতে সোহেল সমর্থকদের সঙ্গে যুবদলের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম নিরব সমর্থকদের অন্তত ১১ দফা হাতাহাতি হয়। এতে দুই গ্রুপের বিশ জনেরও বেশি কর্মী আহত হন।

সর্বশেষ মে মাসের প্রথম দিকে মুক্তাঙ্গনের সমাবেশে সায়েম নামে স্বেচ্ছাসেবক দলের এক কর্মীর মাথা ফেটে যায়।

এদিকে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের মৃত্যুর পর মহাসচিব পদে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেওয়ায় সিনিয়র নেতাদের অনেকেই নাখোশ হন।

দলীয় সূত্রমতে, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও হান্নান শাহসহ স্থায়ী কমিটির ৯ জন সদস্য মির্জা ফখরুলকে এ দায়িত্ব দেওয়ার চরম বিরোধী। এছাড়া যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও বিষয়টিকে  কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি।  

এছাড়া ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদকের পদ নিয়ে আবদুস সালাম ও আবুল খায়ের ভূঁইয়া, ছাত্রদলের কমিটি নিয়ে আমিরুল ইসলাম আলিম ও হাবিবুর রশিদ হাবিব, মহিলা দলের কমিটি নিয়ে  শিরিন সুলতানা ও হেলেন জেরিন খানের দ্বন্দ্ব দিনদিনই বাড়ছে।

রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলা গাজীপুরে অধ্যাপক এমএ মান্নান ও ফজলুল হক মিলনের দ্বন্দ্বের কারণেও ঢাকার আন্দোলন জমাতে পারছে না বিএনপি।
 
এসব নিয়ে বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি একটি বড় দল। এখানে কোটি কোটি মানুষের সমর্থন রয়েছে। দলের সব সিদ্ধান্ত সকলের সমানভাবে ভাল নাও লাগতে পারে। ’

মির্জা আব্বাস বাংলানিউজকে বলেন, ‘দলের সঙ্গে যারা বেঈমানি করেছে তাদের পক্ষে কখনোই ছিলাম না। থাকার প্রশ্নই আসে না। ’

তিনি আরো বলেন, ‘জিয়ার আর্দশে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি করি, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত করব। কিন্তু কোন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করবো না। ’

মহানগর বিএনপির একাংশের বিরোধীতা প্রসঙ্গে সাদেক হোসেন খোকার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, ‘দু’এক জনে দু’একটি কথা বলেছে বলে শুনেছি। হান্নান শাহ আমার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তবে এটা কোন বিষয় নয়। বিএনপিকে ভালবাসলে সবাই দলের সিদ্ধান্ত মেনেই কাজ করবে। ’

বিভিন্ন সময়ে দলীয় সমালোচনা করে বহু বিতর্কের জন্ম দেওয়া স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বাংলানিউজকে বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের পর মান্নান ভূঁইয়ার সঙ্গে তার বাসায় বসে সংস্কারের খসড়া তৈরি করেন মির্জা ফখরুল। তাকে করা হয়েছে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব। আর সংস্কার তৎপরতার মহানায়ক মান্নান ভূঁইয়ার অন্যতম সহযোগী সাদেক হোসেন খোকাকে করা হয়ে হয়েছে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহবায়ক। সংস্কারপন্থিদের দোসর লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবকে করা হয়েছে স্থায়ী কমিটির সদস্য, ড. এম ওসমান ফারুক চেয়ারপারসনের সঙ্গে সঙ্গেই থাকছেন। মেজর (অব.) হাফিজকে এতো কিছুর পরও ভাইস- চেয়ারম্যান করা হলো। এতেই বোঝা যায় দল এখন কারা চালাচ্ছে। ’

এ নিয়ে দলের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিয়েছে বলে দাবি করে ওই নেতা আরো বলেন, ‘সামনের দিনগুলোতে এজন্য বেশ বেকায়দায় পড়তে হবে খালেদা জিয়াকে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।