ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ মে ২০২৪, ০০ জিলকদ ১৪৪৫

রাজনীতি

রাজাকারপুত্র পাচ্ছেন স্বাধীনতা সম্মাননা!

আবদুল্লাহ আল মামুন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২১৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৪
রাজাকারপুত্র পাচ্ছেন স্বাধীনতা সম্মাননা!

চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের স্বাধীনতা স্মারক সম্মাননা পাচ্ছেন একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তায় দেশীয় রাজাকারদের নিয়ে গঠিত ‘শান্তি কমিটি’র চেয়ারম্যান মাহমুদুন্নবী চৌধুরীর ছেলে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। বুধবার বিকালে নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউটে এ-সম্মাননা পদক প্রদানের সব আয়োজন সম্পন্ন করেছে সিটি কর্পোরেশন।



স্বাধীনতাদিবসে একজন চিহ্নিত রাজাকারের পুত্রকে সম্মাননা পদক দেওয়ার ঘোষণায় ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা তথা চট্টগ্রামের সচেতন মহল।

সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ও কর্মকর্তাদের মধ্যেও এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।   তবে মেয়র এম মনজুর আলমের নিজস্ব পছন্দের কারণে কেউ এ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো কথা বলছেন না।  

এ প্রসঙ্গে করপোরেশনের সমাজকল্যাণ বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য হাসান মুরাদ বাংলানিউজকে বলেন, ‘সমাজে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদানের জন্য এ সম্মাননা পদক দেওয়া হয়। সমাজকল্যাণ স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যরা নাম প্রস্তাব করেন। ফাইনালি মেয়র মহোদয় এর অনুমোদন দেন। তবে আমীর খসরু মাহমুদের স্বাধীনতা সম্মাননা পদক পাওয়া নিয়ে মেয়র মহোদয় ভালো বলতে পারবেন। ’

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী, বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা এবং নগর বিএনপি’র সভাপতি। শীর্ষ স্থানীয় ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

করপোরেশন সূত্র জানায়, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদযাপন উপলক্ষে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ছাড়াও বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম, সাবেক গণ পরিষদ ও সংসদ সদস্য মোহাম্মদ ইসহাক মিয়া, সাবেক কমিশনার মোহাম্মদ রাজা মিয়া (মরণোত্তর), বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রয়াত সাধন কুমার ধর (মরণোত্তর) এবং  হাজী রফিক আহমদকে ‘মহান স্বাধীনতা স্মারক সম্মাননা’ পদক দিচ্ছে সিটি করপোরেশন। ২৬ মার্চ বিকালে চট্টগ্রাম থিয়েটার ইনস্টিটিউটে এ সম্মাননা তুলে দেওয়া হবে।

২০১০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) তদন্ত দল নগরীতে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী ও রাজাকারদের ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত বিভিন্ন ভবন ও বধ্যভূমি পরিদর্শন এবং বিভিন্ন জনের সাক্ষ্য নিতে চট্টগ্রাম আসে। তদন্ত দল যায় খুলশী থানার পাহাড়তলী বধ্যভূমিতে।

সেখানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গাজী সালেহউদ্দিন আইসিটি তদন্ত দলকে বলেন, একাত্তরের ১০ নভেম্বর পাঞ্জাবি লেনের বাড়ি থেকে তার বাবা আলী করিম, চাচা আলী হোসেনসহ চার জনকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। ওই পাড়া থেকে মোট ১২০ জনকে ধরে আনা হয়েছিলো।
 
‘এটি (বধ্যভূমি) টিলার মতো জায়গা ছিলো। রক্ত জমে এখানকার মাটি কালো হয়ে গিয়েছিলো’, বলেন তিনি।

সালেহউদ্দিন জানান, বধ্যভূমির কাছের ঝাউতলা রেল স্টেশনের নাজিরহাট এবং দোহাজারী লাইনের ট্রেন থামিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে এনে এখানে জবাই করা হতো।

তিনি তদন্ত দলকে বলেন, ‘বাবাকে বাঁচানোর জন্য আমার ছোট ভাই আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর (বিএনপি নেতা) বাবা তৎকালীন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মাহমুদুন্নবী চৌধুরীর কাছে যাই। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। ’
 
২০১১ সালের ১১ এপ্রিল একাত্তরের নির্যাতনকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত চট্টগ্রামের শান্তি কমিটির আরেক চেয়ারম্যান ও মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাসভবন (গুডস হিল) পরিদর্শনে আসেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দুই সদস্যের তদন্ত দল। এসময় একাত্তরে গুডস হিলে নির্যাতনের শিকার চট্টগ্রামের প্রবীণ ব্যবসায়ী নেতা ম.সলিমুল্লাহ নির্যাতনের বর্ণনা দেন। এসময় তিনি তদন্ত দলকে বলেন, চট্টগ্রামে দু’জন শান্তি কমিটির দায়িত্বে ছিলেন। একজন বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরী। অন্যজন বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বাবা মাহমুদুন্নবী চৌধুরী।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাকেন্দ্রের চেয়ারম্যান ডা. মাহফুজুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন,‘আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বাবা একাত্তরে শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এটা সবাই জানে। তার ছেলে কোন যুক্তিতে স্বাধীনতা সম্মাননা স্মারক পাবেন এটা বোধগম্য নয়। একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে আমীর খসরুর কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না। পরেও কখনোই স্বাধীনতার স্বপক্ষে ছিলেন না। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ-পদক দেওয়া হচ্ছে। এটা স্বাধীনতার প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞাও বটে। ’

এ প্রসঙ্গে করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আলী আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন,‘একটা কমিটি রয়েছে। কাদেরকে সম্মাননা পদক দেওয়া হবে সে ব্যাপারে কমিটি নাম প্রস্তাব করেন। প্রস্তাবের ভিত্তিতে কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেন। ’ তবে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সম্মাননা পদক পাওয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এ বিষয়ে সিটি মেয়রের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

এ প্রসঙ্গে সিটি করপোরেশনের মেয়র এম মনজুর আলমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

কর্পোরেশন সূত্র জানায়, ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র ও মুক্তিযোদ্ধা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং বিএনপি নেতা ও সাবেক মন্ত্রী ও মুক্তিযোদ্ধা আবদুল্লাহ আল নোমানকে একুশে সম্মাননা পদক দেয় সিটি কর্পোরেশন। চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নোমানের বিপরীত মেরুর নেতা আমির খসরুকে স্বাধীনতা সম্মাননা দিয়ে মেয়র ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করছেন বলে কর্পোরেশনের কাউন্সিলর এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা চলছে।

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিচয়ে তিনবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়া এম মনজুর আলম ২০১০ সালে মেয়র নির্বাচনের আগে আকস্মিকভাবে বিএনপিতে যোগ দেন। নির্বাচনে মেয়র পদে তিনি বিএনপির সমর্থনও আদায় করে নেন এবং জিতে আসেন।

এম মনজুর আলমকে বিএনপির সমর্থন পাইয়ে দিতে এবং মেয়র পদে জেতাতে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে বলে মনে করেন দলের নেতাকর্মীরা।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৩৫ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।