ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

রাজনীতি

কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে টাওয়ার হ্যামলেটস এর নতুন মেয়র

কঠোর অবস্থানে লেবার পার্টি, বসে নেই মৌলবাদীরাও

সৈয়দ আনাস পাশা | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১, ২০১০
কঠোর অবস্থানে লেবার পার্টি, বসে নেই মৌলবাদীরাও

লন্ডন: সদ্য সমাপ্ত ২১ অক্টোবরের প্রথম নির্বাহী মেয়র নির্বাচনকে ঘিরে বাঙালি অধ্যুষিত টাওয়ার হ্যামলেটস ব্রিটিশ রাজনীতিতে যে তোলপাড় তুলেছিল, তার রেশে এখনও কমেনি। লেবার পার্টির নিরাপদ এলাকা হিসেবে পরিচিত দুটো সংসদীয় আসন নিয়ে গঠিত টাওয়ার হ্যামলেটস সংশ্লিষ্ট সংবাদ প্রায় প্রতিদিনই মূলধারার কোনও না কোন সংবাদপত্রের অন্যতম আইটেম বা ফিচার প্রতিবেদন হিসেবে প্রকাশ হচ্ছে।



আর এইসব প্রতিবেদন-ফিচার আর আলোচনায় ঘুরে ফিরে বারবার আসছে সদ্য লেবার পার্টিচ্যূত নবনির্বাচিত মেয়র লুৎফুর রহমানের নাম।

ইসলামি চরমপন্থি ও রেসপেক্ট পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ততার পুরোনো অভিযোগ এখনও তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত হচ্ছে মূলধারার পত্রপত্রিকায়। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর একটি খোলা চিঠিতে দায়িত্ব পালনে লেবার কাউন্সিলারদের সহযোগিতা চাইলেও কোনও সহযোগিতাই পাচ্ছেন না নবনির্বাচিত মেয়র।

পরিস্থিতি সামাল দিতে ‘আমি লেবার পার্টিরই লোক’ ঘোষণা দিয়ে লেবার পার্টিতে আবারও ফিরতে চান বলে আকুতি প্রকাশ করলেও, তাতে সারা দিচ্ছে না লেবার পার্টি।

উপরন্তু দুই লেবার এমপি’র নেতৃত্বে হাউস অব কমন্সে অনুষ্ঠিত টাওয়ার হ্যামলেটস লেবার কাউন্সিলরদের সাম্প্রতিক এক সভায় নবনির্বাচিত মেয়রের কেবিনেটে যোগদান না করে বিরোধী ভূমিকা পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সভায় কাউন্সিলরদের মেয়রের কেবিনেট বা উপদেষ্টা পরিষদে যোগদান না করার জন্যে সতর্ক করে দিয়ে বলা হয়, পার্টির সিদ্ধান্ত বিরোধী অবস্থান কোনও মতেই গ্রহণযোগ্য হবে না।

এদিকে, লেবার পার্টির পাশাপাশি কনজারভেটিব পার্টিও মেয়র লুৎফুরের কেবিনেটে না গিয়ে বিরোধী ভূমিকা পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইসলামিক চরমপন্থি ও রেসপেক্ট সম্পৃক্ততার অভিযোগে তারাও লেবারের কাউন্সিলরদের সঙ্গে একযোগে মেয়রের বিরোধীতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

রাজনৈতিক পর্যবেকদের ধারণা, ব্রিটেনের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির টাওয়ার হ্যামলেটস অঞ্চলের কাউন্সিলাররা নবনির্বাচিত মেয়রের বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত না নিলেও তাদের কোনও সদস্যই হয়তো শেষ পর্যন্ত মেয়রের কেবিনেটে যাবেন না।

এ অবস্থায় দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই কেবিনেট সদস্যদের নাম ঘোষণা করার কথা থাকলেও মেয়র লুৎফুর রহমান এখনও কেবিনেট গঠন করতে পারেননি। নির্বাচনের সময় তার পক্ষ নেওয়া আটজন কাউন্সিলারের মধ্যে কাউন্সিলার অহিদ আহমদের নাম ডেপুটি মেয়র হিসেবে ঘোষণা করলেও কেবিনেটের বাকি পদগুলো পুরণ করতে এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন মেয়র লুৎফুর রহমান।

একটি সূত্রে জানা গেছে, এক টাওয়ার হ্যামলেটস স্লোগান দিয়ে নির্বাচনে জিতে আসা লুৎফুরের ইচ্ছে ছিল শ্বেতাঙ্গ একজন কাউন্সিলরকে ডেপুটি মেয়র নির্বাচিত করে তিনি প্রমাণ করবেন ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার মেয়র তিনি।

কিন্তু শ্বেতাঙ্গ কোনও কাউন্সিলার তার কেবিনেটে আসতে আগ্রহী না হওয়ায় তার ইচ্ছে অপূর্ণই রয়ে গেছে। এ অবস্থায় কেবিনেট গঠনে এখন একমাত্র ভরসা নির্বাচনে তার পক্ষ নেওয়া আটজন লেবার কাউন্সিলর। কিন্তু এই সহজ সমাধানও এখন অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র বাংলানিউজকে জানিয়েছে, পার্টি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে কেবিনেট সদস্য হওয়ার ঝুঁকি নিতে লেবারপন্থি ওই আটজনের মধ্যেও দেখা দিয়েছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব।

সব মিলিয়ে মোট ভোটারের মাত্র ১৩% এর সমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হওয়া মেয়র লুৎফুর তার রাজনৈতিক ভবিষ্যত নিয়ে পড়েছেন এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে।
এদিকে, মূলধারার পত্র-পত্রিকাগুলো লুৎফুরের ইসলামিক চরমপন্থি সম্পৃক্ততার অভিযোগ সম্পর্কে ব্রিটেনের জনগণকে বারবার স্মরণ করিয়ে দেওয়ার পরও বিষয়টি নিয়ে লুৎফুর কতটুকু সতর্কতা অবলম্বন করছেন তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে।

মেয়র নির্বাচনের পর কয়েকটি পত্রিকায় ১০১ জন আলেমের নামে তাকে অভিনন্দন জানানো বিবৃতিতে চরমপন্থি মৌলবাদী সংগঠনের কোনও কোনও নেতার নাম থাকায় লুৎফরের বিরুদ্ধে চরমপন্থি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ যেন আরও মজবুত ভিত্তি পেয়ে গেছে। মোট কথা, এতে করে পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করছে।

টাওয়ার হ্যামলেট এলাকার অনেকে বাংলানিউজকে  বলেছেন, এ মূহুর্তে লুৎফুরের উচিত ছিল মৌলবাদী কোনও সংগঠনের নেতাদের নামে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বিবৃতি দেওয়ার মত বিষয়কে  নিরুৎসাহিত করা।

কিন্তু বিষয়টির প্রতি কেন তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন না তা বোঝা যাচ্ছে না। পর্যবেকরা বলছেন, বাঙালির পরিবর্তে ইসলামিক চরমপন্থি সমর্থক পরিচয়টাই এখন মেয়র লুৎফুরের জন্যে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কঠোর অবস্থান লেবার পার্টির

লেবার পার্টিতে আবার ফিরে যেতে নবনির্বাচিত মেয়র লুৎফুর রহমান আকুতি প্রকাশ করলেও তাকে পার্টিতে ফিরিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধেও শক্ত অবস্থান নিয়েছে স্থানীয় লেবার পার্টি। দুই এমপি রোশনারা আলী ও জিম ফিট্জপ্রেট্রিক এ উদ্যোগে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বলে জানা গেছে।

শুধু লুৎফুরই নন, খোদ লন্ডন মেয়র ক্যান লিভিংস্টোনের নির্বাচনকালীন ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে লেবার পার্টির জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে। নির্বাচনে পার্টির মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে গিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী লুৎফুর রহমানের পক্ষে প্রচারণার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে লিভিংস্টোন জানান, যেহেতু তিনি মনে করেন লুৎফুর রহমান লেবার পার্টিরই লোক, তাই ভোটারদের তিনি আহবান জানিয়েছিলেন অন্তত দ্বিতীয় পছন্দে যেন তারা লুৎফুরের নাম বিবেচনায় নেয়, এটুকুই। তার এ ভূমিকাকে দলীয় প্রার্থীর বিরোধীতা বলতে নারাজ লিভিংস্টোন।

লেবার পার্টির জাতীয় নির্বাহী কমিটি আপাতত তার বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণে সম্মত না হলেও পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ডের সিদ্ধান্তের দিকে এখনও চেয়ে আছেন লেবার পার্টির লিভিংস্টোন বিরোধী সমর্থকরা। কেইন লিভিংস্টোনের মত প্রবীণ নেতাকে নিয়েই যেখানে পার্টিতে চলছে মতবিরোধ, সেখানে  লুৎফুরের লেবারে ফিরে যাওয়ার চেষ্টাকে অনেকটা অসাধ্য বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেকরা।

এ অবস্থায় মেয়র নির্বাচিত হলেও দল পরিচয়হীন অবস্থায় লুৎফুরের রাজনৈতিক ভবিষ্যত অনেকটা অনিশ্চিত বলেই ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে লুৎফুরের উচিত ইসলামি চরমপন্থি সম্পৃক্ততার অভিযোগ মুছে ফেলার চেষ্টা করা। লুৎফুরের প্রতি রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের পরামর্শ- যে মৌলবাদী সংগঠনটির সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার অভিযোগ করা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি করে দ্রুত এ অভিযোগ মুছে ফেলার চেষ্টা অন্তত শুরু করা উচিৎ তার।

বসে নেই মৌলবাদী  গ্রুপ

এদিকে, মৌলবাদী যে গ্র“পটির সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে মেয়র লুৎফুর রহমানকে আজ বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে সেই গ্র“পটিও বসে নেই বলে জানা গেছে। তাদের চূড়ান্ত মিশনে সফলতার আশায় আবারও তারা লুৎফুরকে ব্যবহার করার চিন্তা করছে।

তারা এখন লুৎফুরকে সামনে নিয়ে আগামী পার্লামেন্ট নির্বাচনে রোশনারাকে মোকাবেলা করার পরিকল্পনা তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছে বলে জানা গেছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যুক্তরাজ্যের বাংলা মিডিয়াকে ব্যবহার করার একটি চেষ্টাও তারা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।

রোশনারার সঙ্গে বাংলা মিডিয়ার সম্পর্কে ফাটল ধরিয়ে তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার ষড়যন্ত্র করছে বলে জানা গেছে।

তবে ‘কী এই ষড়যন্ত্র’ তা উদঘাটন করতে বাংলানিউজ এর অনুসন্ধান অব্যাহত আছে।

বাংলাদেশ সময়: ২১৪১ ঘণ্টা, নভেম্বর ০১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।