ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

রাজনীতি

রক্ত ঝরিয়ে হলেও স্বৈরাচারকে হটাতে হবে: খালেদা

আহমেদ রাজু, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ও মান্নান মারুফ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৪ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১০
রক্ত ঝরিয়ে হলেও স্বৈরাচারকে হটাতে হবে: খালেদা

খালেদা জিয়ার গাড়ি বহর থেকে: বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘আমাদের রক্ত তো এমনিতেই ঝরছে। আমরা জানি, আরও রক্ত ঝরাতে হবে।

তবুও জেহাদের আদর্শ সামনে রেখে গণতন্ত্রের নামধারী স্বৈরাচারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। ’

সোমবার বিকেলে সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদে বিএনপি’র গণজমায়েতে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এ কথা বলেন।

দেশ রক্ষার সংগ্রামে ছাত্রদের প্রস্তুত হওয়ার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘অত্যাচারী, স্বৈরাচার, নারী নির্যাতনকারী সরকারকে ক্ষমতা থেকে সরাতে হবে। তোমরা প্রস্তুত হও। ’

জনবিরোধী সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করার পর জনগণের অধিকার ও গণতন্ত্র ফিরে আসবে বলেও মন্তব্য করেন খালেদা।

বক্তব্য শেষ করেই নাটোরের উদ্দেশে রওয়ানা হয় খালেদা জিয়ার গাড়ি বহর।

এর আগে সয়দাবাদে চরম বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতার মধ্যেই বিএনপির গণজমায়েতে শুরু হয়। যমুনা রিসোর্ট থেকে খালেদা জিয়া নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত হয়ে সেখানে গিয়ে পৌঁছেন।

তিনি বলেন, ‘এ সরকার শুধু দেশেই নয়, বিদেশে গিয়েও দেশের সুনাম নষ্ট করে। সম্প্রতি জাতিসংঘের অধিবেশনে গিয়ে এ সরকারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যে কাণ্ড ঘটিয়েছে তাতে দেশের সুনাম ুণœ হয়েছে। ’

খালেদা জিয়া বলেন, ‘এ সরকার হিন্দুদের জমি-জায়গা দখল করছে। লুটপাট করছে। তারা নিজেরাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এর কারণ দলের নেতৃত্বে যারা আছে তারা অসৎ, দুর্নীতিবাজ। ’

বিনাটেন্ডারে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য নতুন যে  আইন করা হয়েছে সরকার পরিবর্তন হলে সে আইনও পরিবর্তন হয়ে যাবে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এ অন্যায় কাজে যেসব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সহযোগিতা করবে তারাও পার পাবে না। ’

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্যায় কাজে সহযোগিতা না করার আহবান জানিয়ে তিনি বরেন, ‘যারা এ অন্যায় কাজে সহযোগিতা করবে তাদেরও বিচার করা হবে। ’

বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘এ সরকার ক্ষমতায় এসেছিল তিনটি ওয়াদা নিয়ে। তারা বলেছিল ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবে, ঘরে ঘরে চাকরি দেবে ও বিনা পয়সায় সার বিতরণ করবে। কিন্তু তারা তাদের ওয়াদা পুরণ করেনি। বরং ডিজিটাল দেশ গড়ার কথা বলে ক্ষমতায় এসে হত্যা, গুম, নির্যাতন, ধর্ষণ, মিথ্যা মামলা দায়ের ও নির্যাতন চালাচ্ছে। ’

তিনি বলেন, ‘এ সরকারের পায়ের নিচে আর মাটি নেই। তারা দেশের জন্য কিছু করতে না পারলে যাদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে ক্ষমতায় এসেছে সেই প্রভূদের সঙ্গে দেশবিরোধী চুক্তি করে দেশকে তাদের হাতে তুলে দিতে চায়। কিন্তু এ দেশের জনগণ গোপন চুক্তি কখনোই মেনে নেবে না। ’

বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘চারিদিকে বিদ্যু, পানি ও গ্যাসের জন্য হাহাকার চলছে। গ্যাস না থাকায় শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। দ্রব্য মূল্য বাড়ছেই। সরকারের লুটপাটের দেশ শাসনে দেশের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ’

তিনি বলেন, ‘এ সরকারের চরিত্র মানুষ জানে। ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত কর্মকাণ্ডের জন্য দেশের মানুষ তাদের প্রত্যাখান করেছিল। ষড়যন্ত্র করে তারা আবারও ক্ষমতায় এলেও চরিত্র বদলায়নি। ছাত্রলীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের অত্যাচারে মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। ’

খালেদা জিয়া বলেন, ‘২০০৮ সালে যেভাবে লগি-বৈঠার তাণ্ডবে তারা মানুষ হত্যা করেছিল, একইভাবে নাটোরে বিএনপি নেতা বাবুকে হত্যা করেছে। এরকম নিষ্ঠুর ও নির্মম হত্যাকাণ্ড দেশের মানুষ কখনও কল্পনা করে না। ’

সরকারের ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

তার আগে তার গাড়ি বহর যমুনা সেতু পার হয়েই আটকা পড়ে। সমাবেশ স্থলের কাছে ট্রেনের চাকায় বেশ কয়েকজন কাটা পড়ার ঘটনায় ভাঙচুর, ইটপাটকেল ও ফাঁকা গুলির আওয়াজে বহরে দেখা দেয় চরম অরাজকতা। অনেক যাত্রীই তাদের গাড়ি বা চালককে হারিয়ে ফেলেন।

তবে খালেদা জিয়া গাড়ি ঘুরিয়ে যমুনা রিসোর্টে ফিরে যেতে সক্ষম হন।

ওদিকে গাড়ি বহরের একটি অংশ পৌঁছে যায় জনসভাস্থলে। সেখানে ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর সভাপতিত্বে শুরু হয় সভা।

সভায় বক্তৃতা করেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান মিনু, ইলিয়াস আলী, ফজলুল হক মিলন, স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা হাবিব উন নবী খান সোহেল প্রমুখ। এক পর্যায়ে নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত খালেদা জিয়া মঞ্চে পৌঁছান।

যমুনা রিসোর্টে যাত্রাবিরতি ও মধ্যাহ্ন ভোজনের পর বিকেল ৩টার পর বহরটি যমুনা সেতু পার হয়। এ সময় সিরাজগঞ্জের জনসভাস্থলের কাছে ট্রেনে কাটা পড়ে কয়েক জনের মৃত্যু হলে বিুব্ধ জনতা ভাঙচুর শুরু করে। এতে গাড়ি বহরটি উভয় পাশে কয়েক কিলোমিটার যানজটের মাঝে আটকা পড়ে।

এর আগে গাড়ি বহরটি দুপুর দেড়টার দিকে যমুনা রিসোর্টের সামনে থামে। ওখানেই আয়োজন করা হয় মধ্যাহ্নভোজনের। বিএনপি প্রধান এবং তার সফরসঙ্গী নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও নিরাপত্তা কর্মীদের জন্য এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু ওই আয়োজন করেন। গাড়ি বহরকে সেখানে অভ্যর্থনাও জানান তিনি।

মধ্যাহ্নভোজনে ভেতো বাঙালির জন্য ভাতের সঙ্গে মুরগির ঝাল ফ্রাই, রুই মাছ ভাজা, সবজি আর মুগডালের আয়োজন করা হয়। সঙ্গে ছিলো শসা-টমাটোর সালাদ।

ঘণ্টা দেড়েকের যাত্রাবিরতি শেষে বিকেল ৩টার পরপর গাড়ি বহর আবারো চলতে শুরু করে।

এদিকে হোটেল র‌্যাডিসনের সামনে থেকে সকাল ১১টায় রওয়ানা হওয়া শ’ খানেক গাড়ির বহরটি টঙ্গী-গাজীপুর-কালিয়াকৈর-মির্জাপুর-টাঙ্গাইল পেরিয়ে এসে আকারে প্রায় দ্বিগুণ হয়।

টঙ্গী থেকে ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, চেরাগ আলী থেকে স্থানীয় বিএনপি নেতা হাসান উদ্দিন সরকার ও গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, টাঙ্গাইল থেকে ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর নেতৃত্বে আরও প্রায় অর্ধশত গাড়ি বহরে যোগ হয়।

যমুনা সেতুর অ্যাপ্রোচ সড়কে ওঠার আগে আগে ভূয়াপুর থেকে এসে বহরে যোগ হয় ১৮টি বাস।

ঢাকা থেকে যাত্রা শুরুর পর এ পর্যন্ত টঙ্গী ব্রিজ, বোর্ড বাজার, গাজীপুর চৌরাস্তা, কড্ডা, কোনাবাড়ী, কালিয়াকৈর, মির্জাপুর, সখিপুর, টাঙ্গাইল ইত্যাদি স্থানে বিএনপি প্রধানকে স্বাগত জানিয়ে বানানো কয়েক ডজন সুদৃশ্য তোরণ চোখে পড়ে। এছাড়া রাস্তার দু’পাশে হাজার হাজার নেতাকর্মীর হাতে দেখা যায় জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি সম্বলিত ফেস্টুন, নানা স্লোগান সম্বলিত ব্যানার।

গাজীপুর চৌরাস্তায় নেতাকর্মীরা ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে গাড়ি বহরকে শুভেচ্ছা জানান।

অফ-হোয়াইট রঙের শাড়ী পরিহিত সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে শতাধিক গাড়ির বহরটি হোটেল র‌্যাডিসনের সামনে থেকে রওয়ানা হয় সকাল ১১টায়।

টঙ্গী ব্রিজ পার হওয়ার পর থেকেই রাস্তার দু’পাশে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে দেখা যায়। খালেদা জিয়া হাত নেড়ে তাদের অভিবাদনের জবাব দেন।

বহরে স্থায়ী কমিটি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা রয়েছেন। তবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন এ সফরে শরিক হননি।

প্রসঙ্গত, এ সফরে খালেদা জিয়ার কেবল সিরাজগঞ্জ যাওয়ার কথা ছিলো।

কিন্তু রোববার রাতে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন খালেদা জিয়া। টেলিফোনে কথা বলেন বর্তমানে নাটোরে অবস্থানকারী দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান ও সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে। এরপর সফরসূচিতে  পরিবর্তন আনেন তিনি।

সয়দাবাদ মূলাবাড়ীতে পূর্ব নির্ধারিত গণজমায়েতে অংশগ্রহণ শেষে নাটোরের বনপাড়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

নাটোরে গত শুক্রবার আওয়ামী লীগ কর্মীদের হামলায় নিহত বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবুর স্ত্রী মহুয়া নূর কচি এবং তিন মেয়ে পূনম (১৬), পরমা (১৪) ও সূরাইয়াকে (৭) সান্ত্বনা দিতেই বিরোধী দলীয় নেত্রীর নাটোর সফর বলে জানিয়েছে দলীয় সূত্র।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।