ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

প্রধানমন্ত্রী এ চিঠি পাবে কিনা জানি না

জাকিয়া আহমেদ, সাংবাদিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১২
প্রধানমন্ত্রী এ চিঠি পাবে কিনা জানি না

সাংবাদিকরা সবাই মিলে এখন আন্দোলনে নেমেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘গণমাধ্যম এখন মুক্ত-স্বাধীন। তারা স্বাধীনভাবে কাজ করছে।

সেভাবেই লিখছে আবার মিথ্যা তথ্যও পরিবেশন করছে। তারা এখন আন্দোলন করছে। কিন্ত সরকারের পক্ষে তো সম্ভব না কারও বেডরুম পাহারা দেওয়া। এ ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। বাচ্চাকে (মেঘ) যেভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে সেটা ঠিক হয়নি। সাংবাদিকদের কাজ জিজ্ঞাসাবাদ করা না। জিজ্ঞাসাবাদ করা গোয়েন্দাদের কাজ। ’

এখনও খুনীদের ধরা না পড়া প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জীবিত ব্যক্তির ইন্টারভিউ নেওয়ায় (সাগর-রুনির সন্তান মেঘ) খুনীরা পালিয়ে গেছে। ’

প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই আমাদের দেশে বড় বড় হত্যাকাণ্ডগুলো বেডরুমেই ঘটেছে। আপনি ক্ষমতায় এসে এমন হত্যকাণ্ডের বিচার করেছেন। নাগরিক হিসেবে আমরা তাতে অত্যন্ত আনন্দিত। কিন্তু এ আপনি কি বললেন? এ হত্যকাণ্ডের তদন্ত চলছে। আপনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বেধে দেওয়া ৪৮ ঘন্টার মধ্যে খুনীদের সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তারপর থেকেই আমরা আপনার আইনশৃংক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভানুমতির খেল দেখে আসছি। আপনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, বিষয়টি এতোটাই স্পর্শকাতর যে প্রধানমন্ত্রী নিজেই তদন্তের তদারকি করছেন এবং ব্যাপারটি তার নজরে রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তিনি আমাদের সেদিন এই কথাটি জানিয়েছিলেন। নয়তো আমরা কি করে বুঝতাম আপনার নজরদারীর পরে আপনার কাছে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে বেডরুমের নিরাপত্তা দেয়া আপনার পক্ষে সম্ভব না। এবং সেই সাথে আপনি এও জানেন মেঘের ইন্টারভিউ নেয়ায় খুনীরা পালিয়ে গেছে।

বাহ!কি চমৎকার কথা! তো খুনীরা যে পালিয়ে গেল সেই কথাটি আপনি কিভাবে জানলেন, কবে জানলেন? আপনার নাকের ডগা দিয়ে তারা চলে গেল আপনি কিছুই করতে পারলেন না? তাহলে যে আপনার পুলিশবাহিনী বলেছিলো সন্দেহভাজনদের দেশত্যাগের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে! বঙ্গবন্ধুদের আত্মস্বীকৃত খুনীদের ফিরিয়ে আনতে আপনি, আপনার পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় তৎপর। আপনি নাকি স্বজন হারানোর ব্যাথা বোঝেন, মেঘও তার পরম দুই স্বজনকে হারিয়েছে। মেঘের স্বজন হারানোর ব্যাথা উপলব্ধি করেই না হয় আপনি পালিয়ে যাওয়া খুনীদের ফিরিয়ে আনুন।

প্রধানমন্ত্রীর জ্ঞ্যাতার্থে বলতে চাই, তার শাসনামলে বেডরুমের বাইরেই মানুষ বেশি খুন হয়েছে।

২০১১  সালে পুলিশ একদল মানুষকে উষ্কানি দিয়ে হত্যা করা হয়েছে ১৬ বছরের কিশোর শামসুদ্দিন মিলনকে। সীমান্তে বিএসএফ ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানীসহ ৩১ জনকে হত্যা করেছে।

২০০৯ থেকে ২০১১ এই তিন বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছেন ৩৬৫ জন, বিএসএফ’র হাতে নিহত হয়েছে ২০৩ জন, রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছে ৬০৬ জন, গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ৪৬২ জন, গুম হয়েছেন ৫০ জন, কারাগারে মৃত্যু হয়েছে ২১৫ জন। সাংবাদিকের প্রতি আক্রমনের ঘটনা ঘটেছে ৫২৯টি। পুলিশের হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২০২ জন, এসিড সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২০১ জন, যৌতুকের কারনে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১২১৩ জন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১৭২৬ জন। তথ্যসূত্র: অধিকার

অধিকার নামের মানবাধিকার সংস্থাটির দেওয়া এসব তথ্য এটাই প্রমান করে, মানুষগুলো তাদের বেডরুমে নয় রাস্তাঘাটেই বেশি খুন হচ্ছে।

বিষয়টি নিয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বলেও তাদের একই ধরনের মনোভাব জানতে পারলাম।

সাংবাদিক ইকবাল সোবহান চৌধুরী বললেন, ‘আলামতের স্থান ঘেরাও করে রাখা পুলিশের দায়িত্ত্ব ছিলো। আলামত নষ্ট হওয়া পুলিশেরই ব্যর্থতা। আলামত যদি নষ্টই হয়ে থাকে তাহলে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

হত্যকারীদের গ্রেফতার এবং বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করতে চাই প্রধানমন্ত্রী যেহেতু হত্যাকারীদের গ্রেফতারের ব্যাপারে ঘোষণা দিয়েছিলেন তার সেই ঘোষণা বাস্তবায়ন হবে।

ইকবাল সোবহান চৌধুরী আরও বলেন, ৪৮ ঘন্টা সময় আমরা বেধে দেইনি, দিয়েছিলেন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সময় বেধে দিয়ে আমরা চাপ সৃষ্টি করতে চাইনি। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সময় বেধে দেয়ার পরেও যদি তদন্তে দীর্ঘ সময় লাগে তখন জনগণের মনে সংশয় দেখা দেওয়াটিই স্বাভাবিক।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যরিস্টার এম বদরুদ্দোজা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া জানানোর ভাষা নেই এবং আমার মনে হয় কোন সচেতন নাগরিকেরই এই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ভাষা থাকবে না। একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি এই কথা বলেন তাহলে মানুষ রাষ্টের কাছে কি আশা করবে? এ বক্তব্যের পর মানুষ কোথায় গিয়ে দাড়াবে?

সুপ্রীম কোর্টের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক কর্মকর্তা বলেন, দেশের প্রধানমন্ত্রীর মুখে এ ধরনের মন্তব্য দেশের জনগণ প্রত্যাশা করে না। শেখ হাসিনার কাছে জানতে চাই, তিনি দয়া করে বলবেন কি কোথায় মানুষের নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ত্ব?

মানবাধিকার সংগঠন অধিকার এর নির্বাহী পরিচালক নাসিরউদ্দিন এলান বাংলানিউজকে বলেন, শুধু বেডরুমে কেনো, কোথায় না মানুষ খুন হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাব কি প্রধানমন্ত্রী দেবেন? আজকের এই বক্তব্য বিভ্রান্ত করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

আমি জানি না, আমার এই লেখা প্রধানমন্ত্রী বা তার আশে পাশের কারো নজরে পড়বে কিনা। যদি পড়ে তাহলে তাকে বলতে চাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শুধু “বেডরুম” নয়, আপনার সরকার সব জায়গাতেই জনগণের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ।

জাকিয়া আহমেদ, সিনিয়র করসপন্ডেন্ট, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাংলাদেশ সময় ১৩৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।