ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

ডিজিটাল দেশ অ্যানালগ মন

রোকনুল ইসলাম কাফী, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১২
ডিজিটাল দেশ অ্যানালগ মন

ঢাকা: আমাদের দেশের রাজনীতিকদের অভিধানে বোধ করি লজ্জা-শরম বলে কোনো শব্দ নেই। বরং মন্ত্রী-এমপি-নেতাদের বেহায়াপনায় শরমিন্দা হয়ে জনগণকেই নিজেদের মুখ লুকানোর জায়গা তালাশ করতে হয়।



যদিও তাতে শেষ রক্ষা হয় না। উজির-নাজিরদের তুষ্ট করার জন্য প্রখর রোদে কোমলমতি শিশুদের পড়ালেখা বাদ দিয়ে রাস্তার দু’পাশে সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করতে হয়। মন্ত্রী বাহাদুরদের যাত্রাপথ নির্ঝঞ্ঝাট করতে যানজটে দীর্ঘসময় আটকে গলদঘর্ম হয়ে, কখনও বা মফস্বলে তাদের সফরকে রাজসিক করতে তোরণ নির্মাণের জন্য মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে দায়মুক্ত হতে হয়।

কীসের দায়? ভোট দিয়ে ‘সম্মানিত মন্ত্রী’ বানিয়েছো। এখন মন্ত্রীকে ‘সম্মান’ দেখিয়ে সেই দায় সারতে হবে না...! এমনিতে পরস্পর জানি-দুশমন হলেও এসব ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে চমৎকার সাযুজ্য।

ওদের কী দোষ!

পরিণত বয়সের নাগরিকরা না হয় ভোট দিয়ে মন্ত্রী-এমপি বানিয়ে দায়ে ঠেকেছে। এখন নানাভাবে তাদের সেই খেসারত দিতে হচ্ছে। কিন্তু স্কুলের ছোট ছোট শিশুদের কী দোষ! তারা কোন দায়ে পড়েছে!

হায় আফসোস! মায়া-মমতা, সন্তান বাৎসল্যের মতো মানবীয় বিষয়গুলোও কি খোয়াতে বসেছেন আমাদের নেতা-নেত্রীরা! শনিবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) ও গত বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজে কয়েকটি প্রতিবেদন এবং ছবি দেখে বার বার মনে এ প্রশ্নটি জাগে।

একটি ছবিতে দেখা যায়, উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকার কসাইখানায় আনা গরুর পালের মতো একদল স্কুলছাত্রীকে গাদ-গাদি করে উঠানো হয়েছে পিকআপে। তাও আবার পিকআপটির পেছনের ডালা খোলা। চলন্ত গাড়িতে অঘটন এড়াতে ওরা একে অপরকে আঁকড়ে ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে থাকার চেষ্টা করছে।

অন্য ছবিতে তপ্ত দুপুরে মহাসড়কের দু’ধারে ইউনিফর্ম পরা শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। আর একটি ছবিতে মঞ্চের সামনে রোদের মধ্যে চেয়ারে বসে আছে একঝাঁক শিশু।

মন্ত্রী আসবেন তাই...

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ প্রতিনিধির পাঠানো ‘মন্ত্রীর সংবর্ধনা: ক্লাস বাতিল, পিকআপ ভ্যানে ছাত্রী পরিবহন’ শিরোনামের প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ওইদিন সকাল ১০টায় আশুগঞ্জ উপজেলার সোনারামপুর গ্রামে চাতাল শ্রমিকদের উন্নয়নে ডে-নাইট কেয়ার সেন্টার উদ্বোধন করতে যান মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী।

প্রতিমন্ত্রীকে স্বাগত জানানোর জন্য স্থানীয় রওশন আরা জলিল উচ্চ বিদ্যালয়ের শতাধিক ছাত্রীকে ক্লাস বাদ দিয়ে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সোনারামপুর অংশে সকাল ১০টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত প্রখর রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ দু’টি পিকআপে গাদাগাদি করে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয় শিক্ষার্থীদের।

দ্রুত গতির গাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রীরা ভারসাম্য বজায় রাখতে না পেরে একে অন্যের গায়ে ছিটকে পড়ে। গাড়ির ডালায় লেগে তাদের অনেকেই শরীরে আঘাত পায়। এতো গেল ঝুঁকির কথা। কিন্তু ওদের পড়ালেখার ক্ষতি!

সে ব্যাপারে স্কুলটির প্রধান শিক্ষক বাংলানিউজকে জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইসমাইল হোসেনের নির্দেশে তিনি ছাত্রীদের সেখানে পাঠিয়েছিলেন। আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জেলা প্রশাসকের নির্দেশের কথা বলে দায় সারেন।

কিন্তু শিক্ষার্থীদের অভ্যর্থনা গ্রহণে ধন্য প্রতিমন্ত্রী মহোদয় কী বলবেন? তাও আবার ‘মহিলা ও শিশু’ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী। গরুর পালের মতো ঝুঁকিপূর্ণভাবে শিশুদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো কার স্বার্থে!

অন্যদিকে, শনিবার পাবনার চাটমোহর প্রতিনিধির পাঠানো ‘৩ ঘণ্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা হলো ২ সহস্রাধিক শিক্ষার্থীকে’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি পড়ে জানা যায়, নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান আসবেন তাই শুক্রবার ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষার্থীদের রাস্তার দু’ধারে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়।

স্থানীয় হাণ্ডিয়াল ইউপি চেয়ারম্যানের নির্দেশে ১৭ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী নিয়ে তাদের শিক্ষকরাও এসে লাইনে দাঁড়ান। যদিও হাণ্ডিয়াল ইউপি চেয়ারম্যান নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে দাবি করেন, তিনি মন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে এলাকাবাসীর সহযোগিতা চেয়েছিলেন মাত্র।

সেখানে মন্ত্রীর অপেক্ষায় রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাইমারি স্কুলের অনেক শিক্ষকই জানতেন না রোদের মধ্যে কেন তারা সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। অপেক্ষাকৃত বড়রা শুধুই ক্ষোভে ফুঁসছিল।

একইদিন ‘ডিসির জন্য শিক্ষার্থীরা আড়াই ঘণ্টা রোদে’ শিরোনামে নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদনটি ছিল আরও কৌতূহল জাগানিয়া। এতে দেখা যায়, আমলারাও আর পিছিয়ে থাকতে রাজি নন। মন্ত্রী-এমপিদের মতো তাদেরও শখ-সৌখিনতা আছে।

নারায়ণগঞ্জের জেলা প্রশাসক বইমেলা উদ্বোধন করবেন। তাই স্কুলগুলোতে আগেভাগে চিঠি দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের জিয়া হলের সামনে জড়ো করা হয়। আড়াই ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে ক্ষুধায়-পিপাসায় কাতর শিশুরা রীতিমতো প্রলাপ বকছিল।

গতবছরের ১১ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ঠিক একইভাবে ট্রাকে করে স্কুলছাত্রদের খেলার মাঠ থেকে নিয়ে আসার সময় তা উল্টে মারা যায় ৪৩ জন। মিরসরাই ট্রাজেডির সেই বিয়োগান্ত ঘটনা এখনও ফিকে হয়নি।

এমন কোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলে তার দায় কে নিতো! কার বুক খালি হতো! ওই চিত্র দেখলে যে কোনো অভিভাবকের মনেই এ প্রশ্নগুলো জাগবে। লেখাপড়া বাদ দিয়ে প্রখর রোদে শিশুদের দাঁড় করিয়ে রাখলে তা দেশের কোন স্বার্থে লাগে সে প্রশ্নও জাগে। আর শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক ক্ষতির প্রসঙ্গতো আমদের নজরেই আসে না।

অভিভাবকদের এতোসব প্রশ্নের কোনো সদুত্তর যে কর্তাব্যক্তিদের কাছে নেই, তা বলাই বাহুল্য। তাহলে এই সস্তা অভ্যর্থনা পাওয়ার অমানবিক বাতিকটির সযতœ চর্চা কি চলতেই থাকবে? এটি কি কোনো কমপ্লেক্স থেকে সৃষ্ট? দুর্ভোগে-নাকাল জনগণ গ্রহণ করবে কিনা সেই সংশয় থেকেই কি মন্ত্রী-এমপিদের অনুষ্ঠানস্থলে স্কুল শিক্ষার্থীদের দিয়ে স্বাগতম-অভ্যর্থনা আদায়ের রেওয়াজ চালু রাখা হয়েছে?

সংবাদকর্মী হিসেবে জেলা শহরে প্রায় এক যুগের কাজের অভিজ্ঞতায় এই অমানবিক বিষয়টির কিছু কুফল নিজ চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে। মন্ত্রী-এমপির গাড়ি বহরের প্রতীক্ষায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে থেকে অনেক স্কুল শিক্ষার্থীকে অজ্ঞান হয়ে রাস্তায় ঢলে পড়তে দেখেছি। জ্বরে আক্রান্ত হয়ে অনেক শিশুকেই রোদে পোড়ার ধকল সইতে হয় কয়েকদিন ধরে।

এ বিষয়ে অভ্যর্থনাপ্রিয় মন্ত্রী-এমপিরা হয়তো বলবেন, আমরাতো কাউকে বলি না শিক্ষার্থীদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখতে। খুবই সত্য কথা; কিন্তু যদি সবিনয়ে জানতে চাই- এ অমানবিক কাণ্ড বন্ধ করার কথা কি কোনো মন্ত্রী মহোদয় কাউকে বলেছেন? না...।

শিক্ষার্থীদের রাস্তার দু’ধারে দাঁড় করিয়ে রাখার সংবাদ ও ছবি যে এদেশের মিডিয়ায় কতোবার প্রকাশিত হয়েছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কিন্তু তাতে কারও টনক নড়েছে বলে মনে হয় না। বরং অভ্যর্থনাপ্রেমী চক্ষুতৃপ্তিতে বুঁদ হয়ে থাকার অনুভুতিটি বড়ো মিষ্টি!

পুনশ্চ

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ ভিশন বাস্তবায়নে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষে অনেক পরিকল্পনা গ্রহণ ও ইতোমধ্যে তার বাস্তবায়নও চলছে। আর এ উদ্যোগে মন্ত্রী-এমপিরাই প্রথমত প্রধানমন্ত্রীর সহযোগী। কিন্তু ‘এনালগ’ মানসিকতার মন্ত্রী-এমপিরা ‘ডিজিটাল’ ভিশন বাস্তবায়নে কতটুকু সহযোগিতা করতে পারবেন, তা নিয়ে সংশয় জাগে বৈকি!

আমরা মনে করি, সামন্ত যুগের ভূস্বামীদের মতো জনভোগান্তির মধ্যে বিনোদন খোঁজার দিন শেষ হওয়া উচিৎ। অভ্যর্থনা আদায়ের জন্য রাস্তায় দাঁড় করিয়ে নয়; শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমে রেখে মেধায়-মননে তাদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মধ্য দিয়েই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।

বাংলাদেশ সময়: ২১১৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১২

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।