ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

মানবদেহে সীসা দূষণের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই

সৈয়দ আশিকুজ্জামান আশিক ও সামিয়া জাহান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২১
মানবদেহে সীসা দূষণের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই

সীসা একটি নীরব ঘাতক, যার প্রভাব আজ বাংলাদেশের সাড়ে তিন কোটিরও বেশি শিশুর বিকাশ, সুস্বাস্থ্য এবং বেঁচে থাকার জন্য হুমকি। সীসার বিষক্রিয়া এখনও বাংলাদেশে শিশুদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ।

বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ শিশু সীসার বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত, যা আক্রান্ত শিশুর সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে চতুর্থ অবস্থানে নিয়ে গেছে।

ইউনিসেফ এবং পিওর আর্থ সীসা অ্যাসিড ব্যাটারির অনানুষ্ঠানিক পুনর্ব্যবহারসহ বিপজ্জনক পদ্ধতিগুলো বাতিল করার জন্য জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশে মানবদেহে সীসা দূষণের প্রভাব সম্পর্কে কোনও নির্দিষ্ট ক্লিনিক্যাল গবেষণা নেই। সীসা দূষণের উৎস যেমন হলুদ, রং, পেট্রল, সীসা-অ্যাসিড ব্যাটারি ইত্যাদির ওপর পৃথক গবেষণা প্রয়োজন যাতে সীসার উপস্থিতি প্রমাণস্বরূপ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যায়। সীসা একটি নীরব ঘাতক, যার প্রভাব আজ বাংলাদেশের সাড়ে তিন কোটিরও বেশি শিশুর বিকাশ, সুস্বাস্থ্য  এবং বেঁচে থাকার জন্য হুমকি।

সর্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বিষাক্ত ধাতুগুলির মধ্যে সীসা নীরব ঘাতকের মতো; বিশেষ করে শিশুদেরকে তাদের স্বাস্থ্য এবং বিকাশের ওপর সীসার দীর্ঘস্থায়ী এবং বহুমুখী প্রভাব বহন করতে হয়। ইউনিসেফ এবং পিওর আর্থের একটি বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বব্যাপী ৩ জনের মধ্যে ১ জনের রক্তে সীসার মাত্রা প্রতি ডেসিলিটারে (µg/dL) ৫ মাইক্রোগ্রাম বা তার বেশি। বাংলাদেশে  আনুমানিক ৩ কোটি ৫৫ লাখ শিশুর রক্তে এই মাত্রার সীসা বিদ্যমান, যা ক্ষতিগ্রস্ত শিশুদের সংখ্যার দিক থেকে বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে চতুর্থ অবস্থানে নিয়ে গেছে।

খাদ্য শৃঙ্খল, প্রসাধনী, টিনজাত পণ্য, গোলাবারুদ, সীসা পেইন্টিং, এমনকি হলুদ এবং মরিচের গুঁড়ার মতো মসলাগুলোর মাধ্যমেও মানুষ সীসার সংস্পর্শে আসে। হলুদের মান নির্দেশক হিসেবে রঙ ও ওজন বাড়াতে সীসা ক্রোমেট ব্যবহার করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, সীসা শ্বাস-প্রশ্বাস, ত্বক, মাটি, পানি এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঘর থেকেও শরীরে প্রবেশ করতে পারে।

সীসা-অ্যাসিড ব্যাটারির অনানুষ্ঠানিক এবং নিম্নমানের পুনর্ব্যবহার সীসা বিষক্রিয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। অনিরাপদভাবে পুনর্ব্যবহৃত গাড়ির ব্যাটারি ব্যবহার, সীসাযুক্ত পাইপ, সক্রিয় শিল্প থেকে সীসা, সীসাযুক্ত পেট্রল এবং সীসার মতো শক্তিশালী নিউরোটক্সিনের ধ্বংসাত্মক প্রভাব সম্পর্কে অজ্ঞতাও এর জন্য দায়ী। বাংলাদেশে বসবাসকারী শিশুদের সীসাজনিত বিষক্রিয়ার আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখে হল সীসা-অ্যাসিড ব্যাটারিগুলোর অত্যন্ত নিম্মমানের পুর্নব্যবহার পদ্ধতি।

সীসার নীরব বিষক্রিয়া শিশুদের স্বাস্থ্য ও বিকাশের ওপর মারাত্মক ও দীর্ঘস্থায়ী  প্রভাব ফেলে এবং এর কারণে তাদের জীবনের সুযোগের সর্বোচ্চ ব্যবহারের সক্ষমতা প্রভাবিত হয়। এই শক্তিশালী নিউরোটক্সিন বিশেষ করে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনে, কারণ এটি তাদের মস্তিষ্ক পুরোপুরি বিকশিত হওয়ার সুযোগ পাওয়ার আগেই এর ক্ষতি করে, যার ফলস্বরূপ তাদেরকে সারা জীবনের জন্য স্নায়বিক, মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হয়।

এছাড়া শৈশবকালীন সীসার সংস্পর্শের ফলে মানসিক স্বাস্থ্য এবং আচরণগত সমস্যা হয় যা অপরাধ প্রবণতা এবং সহিংসতা বাড়ায়। বয়স্ক শিশুরাও পরবর্তী জীবনে কার্ডিওভাসকুলার রোগ, কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় ভোগে। সীসা গর্ভাবস্থার জন্য নিরাপদ নয়। এটি গর্ভের ভ্রূণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। গর্ভাবস্থায় সীসার উচ্চ মাত্রা গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ, গর্ভপাত এবং মৃত শিশুর জন্মদানের মতো ব্যাপার ঘটাতে পারে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানবদেহে সীসা দূষণের কোনো নিরাপদ মাত্রা নেই। এ বছরের আন্তর্জাতিক সীসা প্রতিরোধ সপ্তাহ-২০২১ আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী সীসার রঙের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ওপর নজর দেয়। সীসার রঙের উচ্চ মাত্রা মানবদেহে সীসা দূষণের একটি প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে। সীসার বিষক্রিয়া শিশুদের বুদ্ধিমত্তা নষ্ট করে, অসাবধানতা, শ্রবণশক্তি হ্রাস এবং আচরণগত সমস্যার দিকে পরিচালিত করে। তাই সীসার দূষণ কমাতে সব ধরনের সীসা রঞ্জক নিষিদ্ধ করা এবং যথাযথ আইনি ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি।

লেখক: সৈয়দ আশিকুজ্জামান আশিক, গবেষণা সহকারী, সিআরআইডি , ঢাকা, 
E-mail: [email protected]
সামিয়া জাহান, এইচএসসি পরীক্ষার্থী; রাজবাড়ী সরকারি কলেজ
E-mail: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ১০, ২০২১
নিউজ ডেস্ক 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।