ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

চিরবিদায়: মুজিব কোটের মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম

তোফায়েল আহমদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৮, ২০২১
চিরবিদায়: মুজিব কোটের মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম।

সাতাত্তর বছর বয়সের মানুষটি টানা একান্ন বছর পার করে দিয়েছেন মুজিব কোট গায়ে দিয়ে। কি গরম আর কি ঠাণ্ডা- বছরের বারটি মাসই তার কাছে এক রকম।

মুজিব কোট গায়ে থাকবেই। মুজিব কোট ছাড়া ঘরের বাইরে যান না তিনি। এমনকি মুজিব কোটবিহীন অবস্থায় তার দেখা মেলাও ভার।  

খুব কম মানুষেই তাকে দেখেছে মুজিব কোট ছাড়া। এমনকি ঈদ-কোরবানের পোশাকের সাথেও থাকে সেটি। এই মানুষটির নাম আলহাজ্ব মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। প্রবীণ রাজনীতিবিদ, সমাজকর্মী ও সাংবাদিক- এই লোকটি আপাদমস্তক একজন প্রকৃত বঙ্গবন্ধু ভক্ত। রাজনীতিতে ‘আওয়ামী লীগার’ মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম কক্সবাজার জেলার প্রথম দৈনিক সংবাদপত্র ‘দৈনিক কক্সবাজার’ এর সম্পাদক ও প্রকাশক।

যে মুজিব কোট ১৯৬৪ সালে তার গায়ে চড়েছিল সেটি গত ৫১ বছরেই আর ছাড়া হয়নি (২০১৫ সাল পর্যন্ত)। মুজিব কোটের কাহিনী বলতে গিয়ে মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেছিলেন- ১৯৬২ সালে তার সভাপতিত্বে কক্সবাজারের আদালত মাঠে ন্যাশন্যাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (এনডিএফ) একটি সভা হয়। সেই সভায় সোহরাওয়ার্দ্দী, শেখ মুজিবুর রহমান ও চট্টগ্রামের রাজনীতিবিদ নবী চৌধুরী এসেছিলেন। সভা শেষে রাতে কক্সবাজার সী বীচ রেষ্ট হাউজে শেখ সাহেবের (বঙ্গবন্ধু) সাথে একান্তে রাজনৈতিক আলাপ হয় মোহাম্মদ নুরুল ইসলামের। সেই আলাপেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন এনডিএফ দিয়ে হবে না- আওয়ামী লীগ গঠন করতে হবে। একথা বলেই বঙ্গবন্ধু তার হাতে হাত রেখে কথা পাকাপাকি করেন।

তারপর ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধু কক্সবাজার আসলেন। সেই ১৯৬৪ সালে প্রথম একটি মুজিব কোট তিনি সেলাই করেছিলেন। তাও বঙ্গবন্ধুর কক্সবাজার আগমন উপলক্ষে। এখনো মনে আছে তার সেই ডিসেন্ট টেইলার্সের কথা। কক্সবাজার শহরের পাবলিক লাইব্রেরীর উত্তর পার্শ্বে প্রধান সড়কেই ছিল মরহুম মোহাম্মদ আলীর টেইলারিং দোকানটি। সেই ডিসেন্ট টেইলার্স কালের সাক্ষী হয়ে এখনো আছে। তখনকার দিনে ডিসেন্ট টেইলার্সই এ শহরের একমাত্র বনেদি লোকের কাপড় সেলাইয়ের নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান ছিল। মুজিব কোট গায়ে দিয়ে যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে মঞ্চে উঠলেন তখন বঙ্গবন্ধু নাকি মুচকি হেসে বলেছিলেন-‘সত্যিইতো তোকে বেশ মানিয়েছে, সব সময় পড়বি কিন্তু...। ’ এই মঞ্চেই কক্সবাজার মহকুমা আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়। তিনি মহকুমা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হন। তার সেই মুজিব কোট সেই থেকে আর ছাড়া হয়নি।  

আলহাজ্ব মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম কক্সবাজার জেলা শহরের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র দৈনিক কক্সবাজার এর সম্পাদক ও প্রকাশক হলেও তিনি আওয়ামী লীগার হিসাবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। কেননা তিনি আওয়ামী লীগের ক্রান্তিকালেও এক মুহুর্তের জন্যও মুজিব কোট খুলেননি। মুজিব কোটের সাথে আপোষও করেননি কোনদিন। মুজিব কোট নিয়ে বিব্রত বোধ করেননি কোন সময়। বরং রীতিমত গর্ব করেন তিনি। তিনি বলেছেন-‘ মুজিব কোট নিয়ে আমি দেশের একজন রাষ্ট্রপতি এবং একজন প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়ে বার বার বাধার সম্মুখিন হয়েছিলাম। তবুও আমি মুজিব কোট খুলিনি। এমনকি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভয়াল দিনেও ঢাকার রাজপথে আমি মুজিব কোট গায়ে দিয়ে চলাচল করেছি। ’

এসব ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘আমি কক্সবাজার প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কক্সবাজার সফরে এলে সার্কিট হাউজে প্রেস ক্লাব সভাপতি হিসাবে আমারও ডাক পড়েছিল। আমি গেলাম, কিন্তু সেখানে বিধি বাম। আমার গায়ে মুজিব কোট দেখে রাষ্ট্রপতির কয়েকজন সফরসঙ্গীও একপ্রকার হতবাক। তাদের অনেকেই এসময় বলাবলিও করছিলেন-লোকটার কেমন সাহস ?’ তিনি বলেন- আমার গায়ে মুজিব কোট দেখে রাষ্ট্রপতির দেহরক্ষীরা সার্কিট হাউজের ফটকেই থামিয়ে দেন। তারা আমাকে বললেন, গায়ের মুজিব কোট খুলে যেন রাষ্ট্রপতির সাথে বসি। তাতেও আমি রাজি হলাম না। অগত্যা মুজিব কোট গায়ে আমাকে ঢুকার অনুমতি দেওয়া হল।  

পুরো অনুষ্ঠানে ছিলেন কেবল তিনি একাই মুজিব কোট গায়ে। ফলে সবারই দৃষ্টি ছিল তার ওপর। মুজিব কোট দেখে রাষ্ট্রপতিও বার কয়েক তাকালেন তার দিকে। একসময় মোহাম্মদ নুরুল ইসলামকে রাষ্ট্রপতি জিয়া কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন- ‘আসুন আমার সাথে দল করি। জবাবে মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বললেন, আমার গায়ে মুজিব কোট-আমি দল করি বঙ্গবন্ধু মুজিবের। প্রতিউত্তরে রাষ্ট্রপতি জিয়াও নাকি বলেছিলেন-আমরাওতো বঙ্গবন্ধুর...কিন্তু তিনিতো এখন নেই’।  

মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বললেন আরেকবারের কথা। সেই সময় রাজধানী ঢাকায় গণভবনে ডাক পড়েছিল। তখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। সেবার দৈনিক কক্সবাজার পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার পালা ছিল। জাতীয় প্রেস ক্লাব থেকে তাদের গাড়িতে তুলে নেওয়ার সময় আপত্তি উঠল মুজিব কোট নিয়ে। সংশ্লিষ্টরা তাকে অনুরোধ করলেন, গায়ের মুজিব কোটটি খুলে গাড়িতে রেখে দিতে। তিনি বলেছিলেন-তাহলে আপনারা আমাকে নামিয়ে দিন। শেষ পর্যন্ত তাকে মুজিব কোট নিয়েই সেই অনুষ্ঠানেও যাবার অনুমতি দেওয়া হয়।  

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের কথা বলতে গিয়ে মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেন, তখন আমরা কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়নের গ্রামের বাড়িতে। পশ্চিমা হায়েনারা এলাকায় এসে গেছে। তাই আত্মগোপনে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। গায়ে মুজিব কোট। তার ওপর শীতের চাদর গায়ে দিয়ে পথে বের হব। সাথে চকরিয়ার ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা এবং আমার স্ত্রীর বড় ভাই মোজাম্মেল হক। মোজাম্মেল ভাই আমার গায়ে মুজিব কোট দেখে প্রথমে অনুরোধ করলেন-যাতে এটি খুলে রেখে দিই। কেননা পথে ঘাটে রাজাকাররা যদি মুজিব কোট দেখে ফেলে তাহলে শেষ করে দেবে। আমি বললাম, মরলে মুজিব কোট গায়ে দিয়েই মরব।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডিতেও রাজধানী ঢাকায় ছিলেন কক্সবাজারের বঙ্গবন্ধু ভক্ত মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। ছিলেন তোপখানা রোডের হোটেল সম্রাটে। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর কারফিউ জারি করা হয়েছিল সেদিন। ১৫ আগস্ট শুক্রবার জুমার নামাজের সময় কারফিউ শিথিল করা হয়েছিল। এসময় তিনি হোটেল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন সাংবাদিক আবুল ফজল হাজারির বাসায়। সাথে ছিলেন কক্সবাজারের যুবলীগ নেতা সালাউদ্দিন মাহমুদ। সালাউদ্দিন মাহমুদ অনেক আকুতি জানিয়েছিলেন-গায়ের মুজিব কোট খুলে রাখার জন্য কিন্তু তাও সম্ভব হয়নি। এমনকি সেদিন অনেক দলীয় নেতাই খুলে রেখেছিলেন মুজিব কোট। অনেকেই নাকি সেদিন তার সাথে থাকা নিরাপদ মনে না করে তাকে ছেড়েও দিয়েছিলেন। ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির এমন ক্রান্তিলগ্নেও গায়ে মুজিব কোট নিয়ে তিনি ঢাকা থেকে কক্সবাজার এসে পৌঁছেন। তিনি বলেন-‘জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে মুজিব কোট গায়ে দিতেন সেটি আমিও দিই। ’

প্রয়াত নেতা ফণীভুষণ মজুমদার যখন বাংলাদেশ কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তখন মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম ছিলেন দলের পলিট ব্যুরোর সদস্য। তিনি বর্তমানে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি। আশির দশকে মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার মগনামা ইউনিয়ন পরিষদে দুইবার চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন। আপাদমস্তক একজন আওয়ামী লীগার এবং বঙ্গবন্ধু ভক্ত আলহাজ্ব মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘মৃত্যুর সময়ও যাতে মুজিব কোটটি আমার গায়ে থাকে-এটাই আমার কাম্য। ’ 

[উল্লেখ্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, কক্সবাজারের সাংবাদিকতার দিকপাল মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মঙ্গলবার (৭ সেপ্টেম্বর) রাত ৮টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রামের পার্কভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে, দুই মেয়ে, আত্মীয়-স্বজনসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। ]

(লেখা ও ছবি: তোফায়েল আহমদ, বিশেষ প্রতিনিধি, কালের কন্ঠ। )

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।