ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

তথ্য জানার অধিকার ও মুক্ত সাংবাদিকতার ব্যাখ্যা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩২৮ ঘণ্টা, মে ৩, ২০২০
তথ্য জানার অধিকার ও মুক্ত সাংবাদিকতার ব্যাখ্যা

বিশ্ব মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস ৩ মে। জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুক্ত, স্বাধীন ও বহুমাত্রিক সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে ১৯৯৩ সালে এ দিবসটিকে ঘোষণা করা হয় ‘মুক্ত সাংবাদিকতা দিবস’ হিসেবে। সাংবাদিকদের স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে সংশ্লিষ্ট মহল ও বিশ্বের দেশগুলোর সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই প্রবর্তন করা হয় এ দিবসটির।

মত প্রকাশের অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে আগেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার ১৯ নম্বর ধারায়। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা সেভাবে না থাকায় সত্য কথা লিখতে গিয়ে দিনদিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে এ পেশা।

সংবাদপত্র তথা মিডিয়াও স্বাধীন কই?

আছে ডিজিটাল আইনের মতো অনেক আইন। এতে পান থেকে চুন খসতেই হুমকি, হামলা, মামলা। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বা আরএসএফের মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫১, যা গতবারের তুলনায় এক ভাগ পেছনে।

একটি দেশের অবাধ তথ্যপ্রবাহের চিত্রই সে দেশের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তুলে ধরে। স্বৈরাচার ও অসহিষ্ণু শাসনকালে তথ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। যতটুকু জানা প্রয়োজন ততটুকু জানতে দেওয়া হয় না। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন তথ্য গোপন রাখা হয়, যাতে জনগণ জানতে না পারে সরকারের ব্যথর্তা।

এ ব্যাপারটা শুরু হয় ১৯২৩ সাল থেকে। যখন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকেরা অফিসিয়াল 'সিক্রেট অ্যাক্ট' তৈরি করে সত্য লুকানোর জন্য। এর সঙ্গে সঙ্গে দ্য এভিড্যান্স, ওথ অব সিক্রেসি, গভর্নমেন্ট রুলস অব বিজনেস এবং কনটেম্পট অব কোর্ট- আইনগুলো অবাধ তথ্য প্রবাহের পথে বসে আছে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ফলে কীভাবে সরকার, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ এবং সাংবিধানিক পদে বহাল ব্যক্তিবর্গ তথ্য প্রকাশ করবেন 'ওথ অব সিক্রেসি' আইন শপথ নেওয়ার পর?

অবাধ তথ্যপ্রবাহের আরও শর্ত হলো- ব্যতিক্রমী আইনি দফা। সংশ্লিষ্ট অফিস এই আইনি দফার কারণে তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষার অজুহাতে। যেখানে তারা বলতে পারে জনস্বার্থ, অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, নৈতিকতাবোধ, আদালত অবজ্ঞা ইত্যাদির কথা। যার শেষ কথা বা উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে জনগণের জানার আগ্রহ এবং অধিকারকে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া। মাত্র একটা দফার আওতায় সংশ্লিষ্ট অফিস তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানাতে পারে।

সমাজ ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানার অধিকার। তাদের জানতে পারার উপরই নির্ভর করে তাদের মত বা প্রতিক্রিয়া প্রকাশের অধিকারটি।

একটি শিশু জন্মায় বিশ-বাইশ হাজার টাকা রাষ্ট্রীয় ঋণ কাঁধে নিয়ে। জনগণ জানতে চায় সমাজ, রাষ্ট্র, সরকার, দেশের অর্থনীতি, রাজনীতিতে কী হচ্ছে। জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের টাকা কোথায় যায়, ব্যয় হয় কীভাবে? সেনা সমর্থিত গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বাংলাদেশের আয়কর পরিশোধকারীরা কী পরিমাণ কর দিলেন সরকারের হাতে থাকা এ তথ্যটা গোপন করা হলো 'অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্টের’ বরাত দিয়ে।

অন্যদিকে গণতন্ত্র তথ্য অধিকার নিশ্চিত করে, যা জনগণকে শক্তিশালী করে। গণতন্ত্রে অবাধ তথ্যপ্রবাহ আইনের দ্বারা একটা অধিকার নিশ্চিত করে। মত প্রকাশের অধিকার যে কারণে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অধিকার, যা 'ইউনিভার্সাল ডিক্লারেশন অব হিউম্যান রাইটসের ১৯ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের সবদেশের সরকার স্বাক্ষর করেছে এখানে। তা সত্ত্বেও সাংবিধানিকভাবে রেখেছে সীমাবদ্ধ করে।

এই জাতীয় প্রতিবন্ধকতার যে সকল যুক্তি তা পর্যালোচনা ও পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন রয়েছে। কেননা, আইনজ্ঞরা সীমাবদ্ধ প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রে বলে থাকেন, 'অসীম স্বাধীনতা বলে কিছু নেই। '

এক্ষেত্রে এমনি একটা গল্প চাউর রয়েছে যে, জনৈক ভদ্রলোক লন্ডনে বাসে ভ্রমণের সময় তার হাত স্বাধীনভাবে এদিক-ওদিক ছোড়াছুঁড়ি করছিলেন। হঠাৎ তার হাত একজন সহযাত্রীর নাকে আঘাত করে বসল। আঘাতকারী ভদ্রলোক নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে বললেন, কাউকে আঘাত করার ইচ্ছা তার ছিল না এবং নেই। তিনি শুধু তার স্বাধীনতার চর্চা করছেন। শেষমেশ ঘটনাটি আদালত পর্যন্ত গড়াল এবং আদালত মন্তব্য করল, ‘হ্যাঁ তোমার স্বাধীনতা আছে হাত ছোঁড়ার; কিন্তু সেই স্বাধীনতার সীমানা সেখানেই শেষ, যেখানে উনার নাকের সীমানা শুরু। ’ এটাই স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা, যা অবাধ তথ্যপ্রবাহে প্রতিবন্ধকতা।

সুতরাং একটা পরামর্শ, যদি সত্যিই অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিশ্চিত করতে হয়, তাহলে এসব সীমাবদ্ধ আইন রদ করা অতীত জরুরি।

মুক্ত সাংবাদিকতার ব্যাখ্যা:
অবশ্যই তথ্য জানতে দিতে হবে জনগণকে। যদি মানুষ না জানতে পারে যে কী ঘটছে, তাহলে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না এবং পারবে না কোনো কাজ করতে। তথ্য ঘাটতি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ও দুর্নীতি প্রতিরোধ পিছিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে পালন করে বড় ভূমিকা। মুক্ত ও অবাধ তথ্যপ্রবাহে জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে। কাজেই জনগণ যদি তথ্য পেতে পারে, সেখান থেকে শুরু করতে পারে ক্ষমতার চর্চা।

সাংবাদিকরা আইনের উর্ধ্বে নয়। তবে নিজের জীবন শতভাগ ঝুঁকির মধ্যে রেখে তাকে সব আইন ভেঙেই কাজ করতে হয় সময় ও যুগের তাগিদে; দেশ, জাতি ও মানুষের বৃহত্তর কল্যাণে।

মাত্র দু'জন সাংবাদিকের প্রতিবেদন 'ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারি' প্রেসিডেন্ট নিক্সনের মতো বিশ্ব ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টকে বাধ্য করেছিল পদত্যাগে। এই একটি ঘটনাই ভাবার জন্য যথেষ্ট যে, তথ্য কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। একজন আমেরিকান সাংবাদিক ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটপরিবর্তন করে দিয়েছিলেন আমেরিকার জনগণকে আসল ঘটনা ও তথ্য অবহিত করে। এছাড়া শায়েস্তা খানের পর বাংলার সুবাদার হয়েছিলেন সম্রাটপুত্র শাহজাদা মুআজ্জম। সুবাদার হওয়ার পর শাহজাদা মুআজ্জম কর্মবিমুখ হওয়ার পাশাপাশি অহঙ্কারী, বিলাসী ও অপব্যয়ী হয়ে পড়েন। ঢাকায় নিযুক্ত একজন ওয়াকিয়ানবিস (রিপোর্টার) সুবাদারের এসব দোষত্রুটি সম্পর্কে রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন আওরঙ্গজেবের কাছে। সম্রাট ওয়াকিয়ানবিসকে (রিপোর্টার) তার সাহসিকতা ও তথ্যনিষ্ঠার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠি পাঠান। অন্যদিকে আরেকটি চিঠিতে সংশোধিত হওয়ার জন্য তিনি সতর্ক করে দেন শাহজাদাকে। যে কারণে বিশ্বব্যাপী এই সত্য স্বীকৃত যে, 'তথ্যই শক্তি'।

সুতরাং যদি অবাধ তথ্যপ্রবাহ থাকে কোথাও, সেই সমাজে স্বচ্ছতা থাকবে। যদি জনগণের মাঝে তথ্যের অবাধ চলাচল থাকে, তারা লড়তে পারবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও খারাপ কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে। কাজেই এটা অবধারিত সত্য যে, অবাধ তথ্যের প্রবাহ সত্যিকারভাবেই জনগণকে শক্তিশালী করে এবং জনগণ সেই শক্তির দ্বারা বদলে দিতে পারে সমাজকে।

বর্তমান সমাজকে অবহিত করা হয় তথ্যসমাজ হিসেবে। কারণ তথ্যই আজকের বিশ্বের প্রধান চালিকাশক্তি। তথ্যবিপ্লব আজ এক পরম বাস্তবতা। দুনিয়া আজ বিশ্বপল্লীতে রুপান্তরিত। তথ্যসমৃদ্ধ স্বাধীন গৌণমাধ্যমের ভূমিকা যে কতো বিপ্লবাত্মক হতে পারে ইতিহাসের বিবর্তনে আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। জনমত গঠন করে গণমাধ্যম। সুস্থতার জন্য মানব দেহের রক্ত সঞ্চালনের ন্যায় সামাজিক সমৃদ্ধির জন্য মানব সমাজের সর্বত্র তথ্য সঞ্চালন অপরিহার্য।

যেহেতু তথ্য চাওয়া, তথ্য পাওয়া ও তথ্যে অংশীদার হওয়া একটি অবিচ্ছেদ্য অধিকারেরই ভিন্ন ভিন্ন উপাদান, তাই এসব অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে আন্তর্জাতিক নানা দলিলে। আমাদের সংবিধানে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কোনভাবেই অর্থবহ হবে না, যদি এই অধিকারের মধ্যে তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার না থাকে। রয়েছে তথ্যপ্রবাহ আইন এবং তা কার্যকর আছে বিশ্বের প্রায় ৭১টি দেশে। বাংলাদেশেও তথ্য অধিকার ২০০৮ অধ্যাদেশ চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়েছে।

সুতরাং বাংলাদেশ সংবিধানে রক্ষিত কথা বলা ও মত প্রকাশের অধিকার অন্য যে কোনো লিখিত সংবিধানের মতোই একটা নিশ্চিত অধিকার। মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য প্রদত্ত তথ্য লাভের অধিকার নিহিত রয়েছে সকল আন্তর্জাতিক ও জাতীয় নিশ্চিতিপত্রের মধ্যে। 'তথ্যপ্রাপ্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা' কথাগুলো নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। যদিও এগুলো প্রত্যয়গতভাবে অখন্ড এবং বাস্তবে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তবুও তারা সম্পূর্ণ অভিন্ন নয়।

যদিও ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ কথাটি প্রথমে বলা হয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, কিন্তু তা সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল ১৯৬৬ সালে সুইডেনে প্রণীত এক আইনে। সেটিকে বলা হয়, ‘সুইডিশ ফ্রিডম অব প্রেস অ্যাক্ট’। তাছাড়া বিভিন্ন আদালতের প্রণীত আইনসমূহে এই অধিকার স্বীকৃতি পেতে শুরু করে।

সরকারি যে কোনো তথ্য জানার অধিকার আছে জনগণের- এটাই মুক্ত সাংবাদিকতার ব্যাখ্যা।

লেখক: সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা

বাংলাদেশ সময়: ১১২৮ ঘণ্টা, মে ০৩, ২০২০
ওএফবি
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।