ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

মানবতা যেন ‘ভয়ঙ্কর’ হয়ে না ওঠে

টিটু আহমেদ, নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১, ২০২০
মানবতা যেন ‘ভয়ঙ্কর’ হয়ে না ওঠে

ঢাকা: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছি, সংবাদমাধ্যমে দেখছি, খেটে খাওয়া মনুষজনকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনী চাল-ডালসহ বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী দিচ্ছেন জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংগঠন, এমনকি ব্যক্তি উদ্যোগেও। নিঃসন্দেহে এটি আমাদের মানবতা। এমনকি এ সময় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি অসহায়, হতদরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এক কথায় ‘দিন আনে দিন খায়’ মানুষের সহায়তা করা হোক, না হলে তারা না খেয়ে মরবেন, কষ্ট পাবেন, এই স্লোগানই এখন রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মুখে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই সহায়তা করতে গিয়ে আবার যেই ভাইরাসের কারণে এমন পরিস্থিতি অর্থাৎ কার্যত লকডাউন চলছে দেশজুড়ে, সেই প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসই ছড়িয়ে পড়ছে না তো?

বিশ্বজুড়ে মহাবিপর্যয়ে নামানো ভাইরাসটি প্রতিরোধের একমাত্র উল্লেখযোগ্য উপায় ‘সঙ্গনিরোধ’ (কোয়ারেন্টিন)। জনসমাগম এড়িয়ে চলে যতটা সম্ভব একা থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।

তাদের মতে, করোনা ভাইরাস খুব ইগোওয়ালা! একে নিজে দাওয়াত না দিলে আপনার ঘরে আসবে না! এমনকি আপনি যদি গিয়ে না আনেন, সে ইগো নিয়েই বসে থাকবে! (Coronavirus has a very big ego, he will not come to your house unless you go out and invite him) তাইতো গোটা বিশ্ব আজ ‘লকডাউন’। কেউ কারও কাছে যাচ্ছেন না খুব প্রয়োজন ছাড়া। থাকছেন স্বেচ্ছায় কোয়ারেন্টিনেই। এ দেশেও একই অবস্থা। সরকার ঘোষণা দিয়েছে সাধারণ ছুটির, দোকানপাট বন্ধের। যান চলাচল বন্ধ রেখেছে সমিতি। প্লেনগুলোও গ্রাউন্ডেড। অর্থাৎ ঘোষণা করেনি কিন্তু বলতে গেলে ‘লকডাউন’ পরিস্থিতি।

সম্প্রতি কক্সবাজারে ছাত্রদলের ত্রাণ বিতরণের একটি দৃশ্যএসব করার কারণ একটাই, সবাই যেন ঘরে থাকে, ভাইরাসমুক্ত নিরাপদ জীবনযাপন করে। অবশ্য প্রায় সবাই এটা মানছেন নিজ তাগিদে, না হয় নিরাপত্তা বাহিনীর তদারকিতে। কিন্তু একটা বিষয়ে প্রায়ই দেখছি জনসমাগম। যারা এই পরিস্থিতিতে কাজ করতে পারছেন না, আয়-উপার্জন বন্ধ, সুযোগ নেই কোনো কাজের, অথচ এটার ওপরই তার গোটা সংসার, এখন অনাহারে দিন পার করছেন, পথের দিকে তাকাচ্ছেন কেউ আসে কি-না কিছু দেবার জন্য, তাদের সহায়তা করার মতো মহৎ কাজের মধ্যে হচ্ছে এই জনসমাগম। যেখান থেকে সহজেই ছড়াতে পারে করোনা আক্রান্ত একজনের পর দুইজন, তিনজন, পরিশেষে চক্রবৃদ্ধি হারে।

রাজধানীর বিভিন্ন জোনে বেশ কয়েকজন এসিল্যান্ড দিচ্ছেন সরকারি সহায়তা। জনপ্রতিনিধিরাও দিচ্ছেন। নিরাপত্তা বাহিনীও দিচ্ছে। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, বিত্তবান ও ধনীরাও ত্রাণসামগ্রী দিচ্ছেন খেটে খাওয়া দিনমজুর ও অসহায় মানুষকে। বাদ নেই দেশের অন্যান্য প্রান্তও। যে যেখান থেকে যেভাবে পারছেন, দিচ্ছেন মানবতার হাত বাড়িয়ে। এসব উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও ‘সামান্য’ সচেতনতার অভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। অনেকে অভিযোগ করছেন, যে ভাইরাস ঠেকাতে ঘরে থাকার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, মানুষজন অসহায় হয়ে পড়েছে, সেই করোনা ভাইরাসই আবার ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে অসহায়দের ত্রাণ বিতরণের সমাগমের মধ্যে।

হিরো আলমের ত্রাণ বিতরণের সময় কয়েকশ মানুষের সমাগম ছিল

অনেক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, ত্রাণ নিতে আসা মানুষের মুখে মাস্ক নেই। একেবারে অনিরাপদ অবস্থায় তাদের গায়ে গা লাগিয়ে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে যা খুবই ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। বেঁচে থাকার জন্য ত্রাণ নিতে এসে চলে যেতে পারে জীবন, এমনকি কারো পুরো পরিবার সঙ্কটে পড়তে পারে।  

একটু সচেতন হলেই মহৎ কাজটি শুধু কল্যাণই বয়ে আনবে। ভাইরাস ছড়াবে না মানবতা। যারা ত্রাণ দিচ্ছেন, তাদেরও সচেতন থাকতে হবে যেন করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে না পড়ে কারও সংক্রমণ থেকে। আবার যারা নিচ্ছেন, তাদেরও সচেতন হতে হবে অন্য কারও সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে। ত্রাণ বিতরণে মুখে সবারই মাস্ক থাকবে, সম্ভব হলে হাতে গ্লাভসও, করা যাবে না ভিড়। সমগম না করে একে একে ত্রাণ নেবেন সবাই, পাশাপাশি দেওয়া-নেওয়ার আগে-পরে হাত ধোয়ার নীতি হতে পারে একটি প্রশ্নাতীত মনবতা।

এছাড়া ঘরে ঘরে গিয়েও ত্রাণ দেওয়া যেতে পারে কর্মহীনদের। এতে তাদের সম্মানের দিকটাও বেঁচে যায়। আবার করোনা মোকাবিলায় ঘোষিত পদক্ষেপও বাস্তবায়ন হয়। সঙ্গে সব অসহায় পরিবারই নিশ্চিত হয় সমান ত্রাণসমগ্রী পেতে। অবশ্য অনেকে এভাবেও দাঁড়াচ্ছেন হতদরিদ্র মানুষের পাশে। এমনকি অনেকে রাতের আঁধারে গোপনে গোপনেও করছেন এই মানব সেবা।

কিন্তু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা সংবাদমাধ্যমে যা দেখছি, তাতে মনে হচ্ছে, বিষয়টি অনেকটা ‘যার জন্য করলাম চুরি সেই বলে চোর’ প্রবাদ বাক্যের মতো। যে ভাইরাস দূরে রাখার জন্য এতকিছু করা হয়েছে, সেই করোনা ভাইরাসই আবার নাগালে আসার শঙ্কা দেখাচ্ছে ত্রাণ বিতরণের জনসমাগমে। শত মানুষের ভিড় ঠেলে অসহায় দরিদ্র মানুষ ত্রাণদাতার নজরে আসছেন। আবার ত্রাণদাতাও সহকর্মীদের, নেতাকর্মীদের বা অন্যান্যদের সঙ্গে নিয়ে সমাগম করে আছেন মঞ্চে কিংবা কোনো স্পটে। আবার এও দেখছি, অনেকে ত্রাণ বিতরণের ছবি তোলার জন্য ভাইরাস মোকাবিলা বাধাগ্রস্ত করছেন।

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম ভেঙে রাজধানীর নগরভবনে মেয়র সাঈদ খোকনের ত্রাণ কার্যক্রম। ছবি তুলতেই পারেন। কাজ দৃশ্যমান রাখতে। এতে আরেকজন উৎসাহী হবেন ত্রাণ দিতে। পাশাপাশি আপনারও উৎসাহ জাগবে যদি এটা প্রচার হয়; সুনাম বয়ে আনে। তবে সবকিছুরই নিয়ম জেনে করা উচিত। সমাগম না হলে বাধা নেই। যদিও ক্যামেরা ডেকে সেবা দেওয়ার সময় এটা না। বিবেচনায় নেওয়া উচিত, যিনি ত্রাণ নিচ্ছেন, তার সম্মানহানী হচ্ছে কি-না। এই সংকটে অনেকেই খাদ্যাভাবে পড়েছেন, যাদের সামাজিক একটা মর্যাদা আছে। কষ্টে ভোগেন, তবু লজ্জা পান ত্রাণ নিতে।

এছাড়া কয়দিন ধরে দেখছি, যারা ত্রাণ নিতে আসছেন, অনেক জায়গায় তাদের ঠিকই একটা দূরত্ব বজায় রেখে বসানো হচ্ছে। কিন্তু যারা দিতে আসছেন, তারা এই নিয়ম মানছেন না। ক্যামেরার ফ্রেমে আসার তাগিদে একটা জায়গায় জটলা বেঁধে, মাস্ক খুলে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করছেন।

এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এগিয়ে আসা দরকার। ত্রাণ বিতরণের সময় করোনা সংক্রমণ রোধে যা করা প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করা উচিত। না হলে এই মানবসেবার মধ্য দিয়েই আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।

লেখক: সংবাদকর্মী
 
বাংলাদেশ সময়: ১৪১৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০২০
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।