ঢাকা, শনিবার, ১৬ চৈত্র ১৪৩০, ৩০ মার্চ ২০২৪, ১৯ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে করণীয়: প্রেক্ষাপট উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২০
দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে করণীয়: প্রেক্ষাপট উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা

একটা সময় ছিল যখন প্রযুক্তির দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে ছিল।  কিন্তু এখন বহির্বিশ্বের প্রযুক্তির ছোঁয়া বাংলাদেশেও লেগেছে। একসময়ের স্বল্প উন্নত দেশ বাংলাদেশ, এখন সবক্ষেত্রেই উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে। বেড়েছে শিক্ষার হার। 

কিন্তু এখনও সেভাবে বাড়েনি কর্মসংস্থানের সংখ্যা। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ‘এশিয়া-প্যাসিফিক এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে (২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত) বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের উচ্চশিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে, যা  ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ।

বাংলাদেশে এ হার ১০ দশমিক ৭ শতাংশ, যা এ অঞ্চলের ২৮টি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। প্রতিবছর শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়েই চলেছে । মানুষ চাকরি তো পাচ্ছে কিন্তু যে বিষয়ে ডিগ্রি অর্জন করেছে সেই বিষয়ের সঙ্গে তাদের কর্মক্ষেত্রের কোনো প্রকার সংযোগ থাকছে না। বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য দেশের বাইরে থেকে বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করা হচ্ছে যাতে কোটি কোটি অর্থ দেশের বাইরে যাচ্ছে।  

দেশের জনশক্তি দেশের বাইরে কাজ পাচ্ছেনা ভাষাগত অজ্ঞতার কারণে। এসব সমস্যার একটি সমাধান তা হল দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা যারা শিক্ষিত হবার সঙ্গে সঙ্গে কর্মেও দক্ষ হবে। এরই সঙ্গে বাড়াতে হবে যথেষ্ট কর্মসংস্থান, যাতে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা না বাড়ে ।  

সরকারকে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে এই সমস্যার সমাধানে। প্রয়োজন উপযুক্ত পরিকল্পনার। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে ২০১৮ সালে প্রযুক্তি/কারিগরী শিক্ষায় স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর  ডিগ্রিধারী জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যথাক্রমে ৭ হাজার ৮১০ এবং ১ হাজার ৬১৫জন। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮ হাজার ৩৪৩ এবং ৭০০ জন।  
 
পরিসংখ্যানপ্রায় সব ইউনিভার্সিটিতেই কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং, ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং এবং আরও নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগ করে দিচ্ছে। যা আইটি ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।  

দীর্ঘ চারবছরের ডিগ্রি অর্জন করে যখন এসব শিক্ষার্থী কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছে , তাদের অনেকের অদক্ষতার জন্য উপযুক্ত চাকরি হচ্ছে না আর যদি চাকরি হয়েও যায় তারা তাঁদের পুঁথিগত বিদ্যাকে বাস্তবিক জীবনে কাজে লাগাতে পারছে না। এখনও শিক্ষার্থীদের এমন অবস্থা যে তারা চাকরির সাক্ষাতকারেও যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী হতে পারে না। যে কাজগুলো করতে পারা তাদের জন্য খুব স্বাভাবিক ছিল যার পুঁথিগত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও সেই জ্ঞানের প্রয়োগ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।  

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই চাকরিদাতাদের অভিযোগ থাকে যে, তারা দক্ষ কর্মী পাচ্ছেন না। ঠিক তেমনি এই সব সদ্য ডিগ্রি প্রাপ্ত জনগোষ্ঠীও কর্ম ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে উঠতে হিমশিম খাচ্ছে। তাদের আলাদা করে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে চাকরিদাতাদের। এ কারণেই বেশিরভাগ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা থাকার কথা বাধ্যতামূলক করা হয়।  

ফলে অনেক ভালো ফলাফল থাকা সত্ত্বেও চাকরি পাওয়া দুষ্কর হয়ে যায়। এবার আসা যাক কর্মসংস্থানের বিষয়ে। প্রতিবছর যত সংখ্যক শিক্ষার্থী ডিগ্রি লাভ করছেন, তত সংখ্যক উপযুক্ত চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে না। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ  ডিগ্রি প্রাপ্ত শিক্ষার্থী কোনো আইটি কোম্পানিতে চাকরি না করে চাকরি করছে একটি স্বল্প বেতনের কল সেন্টারে। এর কারণ হচ্ছে যথেষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকা ।  

যখন তার ডিগ্রি সম্পর্কিত চাকরির জন্য সে যাচ্ছে তার কাছে অভিজ্ঞতা চাওয়া হচ্ছে কিন্তু সে চাকরিপ্রার্থীর অভিজ্ঞতা তো থাকছে কিন্তু তা কল সেন্টারের, যা কল সেন্টার ছাড়া অন্য কোথাও কাজে লাগবে না । কেউ কেউ আইটি ক্ষেত্রে লেখাপড়া করেও বিভিন্ন সরকারি চাকরি, ব্যাংক বা নানা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কাজ করছেন।  

এসবই হচ্ছে যথাযথ কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে। অনেককেই দেখা যায়, হয়তো কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তি হচ্ছেন কিন্তু ভবিষ্যৎ চাকরি জীবনের কথা চিন্তা করে পরবর্তীতে তাদের লেখাপড়ার সাবজেক্ট পরিবর্তন করে বিবিএ-তে ভর্তি হয়ে যাচ্ছেন। কারণ এ বিষয়ে লেখাপড়া করলে চাকরি পাবার সম্ভাবনা বেশি মনে করছেন তারা।  

খুব কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষার্থীদের পুঁথিগত শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগের শিক্ষা দেওয়া হয়। যেহেতু শিক্ষার বাস্তব প্রয়োগ শিক্ষার্থীদের শেখানো হচ্ছে না, সে কারণেই শিক্ষার্থীরা যথাযথ জ্ঞান লাভ করতে পারছেন না এবং অদক্ষ কর্মী হয়ে উঠছে। ফলে তারা দেশের উন্নতিতে আশানুরূপ ভূমিকা রাখতেও ব্যর্থ হচ্ছেন।  

বর্তমানে অনেক শিক্ষার্থী কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বা ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা কোনো আইটিনির্ভর বিষয়ে লেখাপড়া করছে। কারণ তাদের অনেকেরই লক্ষ্য থাকে দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার্থে যাওয়া।  দেশের বাইরে গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করে দেশের বাইরে বসবাস করাও অনেকের ইচ্ছা থাকে। এখানেও রয়েছে বিপত্তি।  

অনেক দেশেই শিক্ষাগত কারণে যেতে হলে বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী হতে হয়। ইংরেজি ভাষায় তো অবশ্যই পারদর্শী হতে হবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, অনেক স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা লাভ করতে পারে না। দেশের বাইরে লেখাপড়া বা কাজের জন্য যেতে চাইলেও দিতে হবে ভাষাগত বিভিন্ন পরীক্ষা। যা ভাষার দক্ষতা পরিমাপ করবে।  

যেমন- ইংরেজি ভাষা দক্ষতা পরিমাপ করা হয় আইইএলটিএস পরীক্ষার মাধ্যমে। এই পরীক্ষায় নির্দিষ্ট পয়েন্ট অর্জন করতে পারলেই শিক্ষার্থীরা দেশের বাইরে উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদন করতে পারে। ঠিক তেমনি চাকরি ক্ষেত্রে দেশের বাইরে আবেদন করতে চাইলেও এই পরীক্ষার প্রয়োজন হয়।  তবে কিছু দেশে চাকরি ক্ষেত্রে  ইংরেজি ছাড়াও অন্য ভাষায় পারদর্শী হওয়া প্রয়োজন।  

অধ্যাপক ড. মো. সাজ্জাদ হোসেন।  যেমন- জাপান বা চীনে চাকরি প্রার্থীদের অবশ্যই জাপানি ভাষা বা চাইনিজ ভাষায় পারদর্শী হতে হয়। এসব ভাষার দক্ষতা পরিমাপ করার জন্যও রয়েছে পরীক্ষার ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট ভাষাগত লেভেল অর্জন করার পরই চাকরির জন্য আবেদন করতে পারে।  

কিন্তু দুঃখজনক বিষয় আমাদের দেশের খুব কম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভাষা শিক্ষার বিভিন্ন কোর্সের ব্যবস্থা থাকে। ফলে যথেষ্ট যোগ্যতা সম্পন্ন থাকা সত্ত্বেও অনেকেই জাপান, কোরিয়া বা চীনের মতো দেশে চাকরি করার সুযোগ হারায়। আর এ কারণেই উন্নত বিশ্বের উচ্চশিক্ষার তুলনায় বাংলাদেশে সেই তুলনায় সুযোগ্য শিক্ষকও বাড়ছে না, না শিক্ষার্থীরা আশানুরূপ শিক্ষা লাভ করে দেশের উন্নতিতে অবদান রাখতে পারছে।  
দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তাই প্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলোর সহায়তা নিতে হচ্ছে। হোক মেট্রো রেল বা যমুনা সেতু বা পদ্মা সেতু , সব ক্ষেত্রেই উন্নত বিশ্বের দেশ থেকে বিশেষজ্ঞ আনা হয়েছে অত্যন্ত বেশি বিনিয়োগ করে।  

কোটি কোটি অর্থ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। অথচ দেশের মেধাকে উপযুক্ত উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করে দিলে এই বিনিয়োগ অনেক গুণ কমে যেত এবং দেশের অর্থ দেশেই থেকে যেত।  যেসব মেধা দেশে এবং দেশের বাইরে থেকে যথাযথ উচ্চশিক্ষা লাভে সক্ষম হয়, তারা দেশের বাইরেই থেকে যায় উন্নতমানের জীবন-যাপন করার লক্ষ্যে।  

এই যে দেশের মেধা দেশে ফিরছে না তার একটি প্রধান কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে প্রযুক্তি খাতে যথেষ্ট কর্মসংস্থানের অভাব থাকা। প্রযুক্তি গত দিক থেকে উন্নত দেশগুলোর কথা বলতে গেলে বেশ কিছু দেশের নাম সামনে চলে আসে।  

এর মাঝে আছে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েল, জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং আরও অনেক দেশের নাম। কেন এই দেশগুলো এত উন্নত তা একটু ভাবলেই সবার আগে তাদের প্রযুক্তির কথাই মনে পড়বে।  

জাপানের কথাই ধরি, জাপানের বিশেষজ্ঞদের উন্নতমানের গবেষণা তাদের প্রযুক্তিতে অভাবনীয় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বিভিন্ন খাতে জাপান উন্নতি সাধন করেছে যেমন- অটোমোবাইল, ইলেক্ট্রনিক্স, মেশিনারি, অপটিক্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবটিক্স এবং আরও নানা ক্ষেত্রে উন্নতি লাভ করেছে।  

তাদের এই উন্নতির কারণ খুঁজলে সর্বপ্রথম বলতে হয় শিক্ষাব্যবস্থার কথা। Shoji Murata  ও Sam  Stern তাদের আর্টিকেল  ‘JTE v5n1-Technology Education  in  Japan’ এ উল্লেখ করেছেন, ১৯৫৮ সাল থেকেই জাপানে নিম্ন মাধ্যমিক লেভেলেই প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক  করা হয়।  

পরবর্তীতে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে বৃত্তিমূলক প্রযুক্তি শিক্ষাকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়। নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রযুক্তি শিক্ষার উদ্দেশ্যই ছিল শিক্ষার্থীদের বাস্তবিক অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তিকে হাতে কলমে শেখা এবং বাস্তবিক অর্থেই আধুনিক মেশিন তৈরি এবং চালনা করার মাধ্যমে জীবন এবং প্রযুক্তির মাঝের  সম্পর্ক বোঝা এবং আধুনিক প্রযুক্তির উন্নতি সাধন করা যাতে দৈনন্দিন জীবনের মান বৃদ্ধি পায়।

শুধু স্কুল এ নয়, অভিজ্ঞ শিক্ষক গড়তে তিন বছর মেয়াদি প্রযুক্তি শিক্ষা প্রশিক্ষণ নেবার জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এমনকি তাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একজন পাঠক্রম বিশেষজ্ঞকে যুক্তরাজ্যে প্রেরণ করা হয়  প্রযুক্তি শিক্ষার বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে।  

পরবর্তীতে বৃত্তিমূলক কোর্সের সঙ্গে সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা বাড়ানোর লক্ষ্যে বিভিন্নও কর্মকাণ্ডেরও ব্যবস্থা করা হয় যাতে শিল্প খাতে শিক্ষার্থীরা তাদের জ্ঞানের যথাযথ ব্যবহার করতে পারে। তারা আরও উল্লেখ করেছেন যে, পরবর্তীতে ১৯৮০ সালে নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে কম্পিউটার শিক্ষা কোর্সের প্রচলন করা হয়। আবার উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে আছে ‘mechatronics’ কোর্স যা কিনা ‘mechanics’ এবং ‘electronics’ এর সমন্বয়ে গঠিত।  

এভাবেই দিনের পর দিন জাপানের শিক্ষা ব্যবস্থা সংস্কার লাভ করেছে। তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় শুধু পুঁথিগত জ্ঞান নয়, হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান করা হয়। শিক্ষার্থীরা নিজেরাই যন্ত্র তৈরি থেকে শুরু করে, চালনা এবং নানা সমস্যা সমাধানের কাজও করে থাকে।  

এরাই ভবিষ্যতে প্রযুক্তির উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। জাপান যে প্রযুক্তিতে এত উন্নতি লাভ করেছে তার অন্যতম প্রধান কারণই হচ্ছে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা।  

এবার আসা যাক বাংলাদেশে কীভাবে প্রযুক্তি শিক্ষার বিকাশ ঘটানো যায় সেই বিষয়ে। জাপানের মতো আমরাও মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে প্রযুক্তিনির্ভর বৃত্তিমূলক কোর্সের ব্যবস্থ্যা করতে পারি। এতে শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে।  

শুধু পুঁথিগত বিদ্যা নয়, থাকতে হবে বাস্তবিক প্রয়োগ। এসব কোর্সের  মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা যাতে সহজেই প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে তার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে বৃত্তিমূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা উচিত। যে  বিষয়েই ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি নেওয়া হোক না কেন, শিক্ষার্থীরা চাইলে যেন  এসব কোর্সের মাধ্যমে প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে পাস করার পরেই কোন  চাকরি পেতে পারে বা নিজের আয়ের উৎস নিজেই তৈরি করতে পারে।  

এখন প্রতিনিয়ত অসংখ্য শিক্ষার্থী কম্পিউটার সায়েন্স বা ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বা আরও বিভিন্নও প্রযুক্তি নির্ভর বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করছে। কিন্তু ডিগ্রি নিলেও তাদের সঙ্গে সঙ্গেই চাকরি হয়ে যাচ্ছে না। বেশ কিছু সময় তার বেকার থাকছে। যা পুরো জাতির অর্থনীতির জন্য একটি বোঝা স্বরূপ।  

অথচ কিছু বাস্তবিক প্রশিক্ষণ থাকলে খুব বেশিদিন চাকরি ছাড়া থাকার প্রয়োজন পড়ে না। ইউনিভার্সিটিগুলোতে অনেক কোর্সই বিদ্যমান আছে যা আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষায় শিক্ষিত করতে পারে কিন্তু, হাতে কলমে শিক্ষার ব্যবস্থা কোনটাতেই নেই।  

হাতে কলমে শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলে আমরাও প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কারে ভূমিকা রাখতে পারবো। তারাও বিভিন্ন মেশিন আবিষ্কার ও পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। বিভিন্ন বৃত্তিমূলক কোর্স বিদ্যমান, এর মাঝে কিছু কোর্সের নাম হচ্ছে- কম্পিউটার স্পেসিয়ালিস্ট, ওয়েব ডেভেলপার, অটোমেশন কন্ট্রোল, মেডিকেল ট্র্যান্সক্রিপ্সন,  অরাগানাইজেশনাল স্কিল, মেশিনিস্ট ইত্যাদি।  

এছাড়াও ভাষাগত জ্ঞান অর্জনের জন্য বিভিন্নও বিশ্ববিদ্যালয়ে জাপানিজ, স্প্যানিশ, রাশিয়ান, ফ্রেঞ্চ ইত্যাদি ভাষা শিক্ষা  এবং আন্তর্জাতিক মানের টেস্টের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। যাতে শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই দেশের বাইরে শিক্ষা বা চাকরি লাভের জন্য যেতে পারে। এছাড়া বেকারত্ব দূর করতে  ২৮ টি হাইটেক পার্কের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সংযুক্তির  ব্যবস্থা করা উচিত। যাতে ডিগ্রি লাভের পর তরুণ-তরুণীরা সহজেই চাকরি লাভ করতে পারে।  

প্রযুক্তিনির্ভর ও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা:

সময় বদলে যাচ্ছে। লোকেরা নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং প্রযুক্তি গ্রহণ করছে, ঠিক তেমনি উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও তাল মিলিয়ে তা বজায় রাখতে হবে। বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক কর্মীশক্তি প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে শুধু নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির ভবিষ্যৎ ও ছাত্রদের হাতেই রয়েছে।  
 
উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে নানা পদক্ষেপএটি অবশ্যই ছাত্রদের তালিকাভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাস্তব জীবনের কাজের পরিবেশ অনুভব করার একটি সুযোগ প্রদান করবে। বাধ্যতামূলক বিশেষায়িত কোর্স, প্রয়োজনীয় ভাষা শিক্ষা, প্রজেক্ট ও ইন্টার্নশিপগুলোও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই স্নাতক হওয়ার আগে তারা বিশেষ যে বিষয়ে পড়াশোনা করেছে তার ওপর দক্ষতা দেখাতে হবে। এগুলি যথেষ্ট নয় যে, তারা স্নাতক।  

তাদের অবশ্যই উচ্চ দক্ষ স্নাতক হতে হবে। শিক্ষার্থীদের অবশ্যই তাদের শ্রেণিকক্ষের বাইরে জীবনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ক্রমাগত শ্রেণীকক্ষ পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং এমন পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করবে যা পরিবর্তিত আধুনিক ও সমসাময়িক প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।  

একটি দেশের ভবিষ্যত তার উত্পাদিত কর্মীদের মানের ওপর নির্ভর করে। উন্নত মান আনয়নকারী কর্মীরা তারা, যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জ্ঞান এবং দক্ষতায় সুনিপুণ এবং বিশ্বের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে প্রস্তুত। বর্তমানে জাতীয় শিক্ষানীতিকে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে মিল রেখে উচ্চশিক্ষার কৌশল  নির্ধারণ করা হয়।

সুপারিশমালা:
যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ যেমন- সারে, লিসেস্টার, লিভারপুল ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে নিয়োগের যোগ্য করে গড়ে তুলতে ছাত্রদের শেখায় কিভাবে একটি চাকরি পাবে, এমনকি পোশাক, সাক্ষাৎকার এবং বায়োডেটা কীভাবে তৈরি করা যায় তাও শেখানো হয়।
 
প্রচলিত স্নাতক প্রোগ্রামসমূহের জন্য সুপারিশমালা:

প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বা কলেজগুলোতে একটা মাল্টিমিডিয়া ডিসিপ্লিনারি সেন্টার থাকবে। সেই সেন্টার থেকে নন-একাডেমিক কোর্স যেমন- প্রশিক্ষণ, ভাষা শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় প্রতিনিয়ত অফার করবে যা থেকে শিক্ষার্থীরা তাদের পছন্দমত কোর্স বিভিন্ন সময়ে গ্রহণ করবে এবং এসবের সবগুলো কোর্স অবশ্যই বাধ্যতামূলক হবে। এই সেন্টারের কাজই হবে যুগের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন কোর্স চালিয়ে যাওয়া। যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা চাকরির দুনিয়ায় নিজেদের প্রস্তুত করবে। ভাষার জন্য ২ ক্রেডিট এবং বিশেষায়িত কোর্সের জন্য ৬ ক্রেডিট। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়নের কথা মাথায় রেখে বিভিন্ন বিজ্ঞানভিত্তিক চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে কেন্দ্র করে শেষবর্ষে গিয়ে একটা প্রকল্প/ ইন্টার্নশিপ করতে হবে। এসব কিছু সম্পন্ন করলেই কেবল একজন শিক্ষার্থী ডিগ্রিপ্রাপ্ত হবে।  

সুপারিশমালাএছাড়াও-
১। শিক্ষকদের নতুন নতুন বিষয় ও প্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান।
২। মাল্টিডিসিপ্লিনারি এডুকেশন সেন্টার স্থাপন।
৩। বাধ্যতামূলক কোর্স হিসেবে: 
ক) বিশেষায়িত কোর্স (প্রোগ্রামিং, নেটওয়ার্কিং, আই ও টি, এ আই, এম এল, ট্রেড কোর্স) 
খ) ভাষাঃ যেমন জাপানিজ, চাইনিজ, কোরিয়ান ইত্যাদি।
৪। ইনকিউবেশন সেন্টার স্থাপন।
৫। বাধ্যতামূলক প্রজেক্ট অথবা ইন্ডাস্ট্রিয়াল এটাচমেন্ট।

চিত্র: দক্ষতামূলক কোর্স সমুহ নিয়ে ডিগ্রি প্রোগ্রাম

বাংলাদেশ যেমন সম্ভাবনার দেশ ঠিক তেমনি সম্ভাবনাময় এদেশের তরুণ তরুণীরা। শুধুমাত্র শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন এবং শিক্ষার্থীদের ভোকেশনাল কোর্সের সুযোগ করে দিলে তারা দক্ষ জনশক্তি হিসেবে পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে।  

আর আমাদের নতুন প্রজন্মের উন্নতি মানেই দেশের সার্বিক উন্নতি।  এদেশের তরুণেরা যত প্রযুক্তিতে উন্নত হবে, বাংলাদেশেও তত উন্নতি সাধন করবে। সেদিন খুব বেশি দূরে থাকবে না যখন আমরাও পৃথিবীর বড় বড় দেশের সমকক্ষ হতে পারবো। এর জন্য প্রয়োজন চেষ্টা এবং সুপরিকল্পিত শিক্ষা ব্যবস্থার।

লেখক: শিক্ষাবিদ; সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৫, ২০২০
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।