ঢাকা, বুধবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

একুশে আগস্ট: ইতিহাসের আরেকটি রক্তাক্ত অধ্যায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪০৪ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৯
একুশে আগস্ট: ইতিহাসের আরেকটি রক্তাক্ত অধ্যায়

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। যা ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত অধ্যায়। এরপর আরেকটি রক্তাক্ত ও কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচিত হয় ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। 

সেই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও সেই বিকেলটির রক্তের ক্ষত প্রতিটি বাঙালির মনে এখনও দগদগে। ওইদিনের আওয়ামী লীগের সন্ত্রাস বিরোধী সমাবেশে এ গ্রেনেড হামলায় অল্পের জন্য বেঁচে যান তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ এই হামলা কেড়ে নেয় ২৪ জনের প্রাণ। তাদের মধ্যে ছিলেন তখনকার মহিলা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী আইভি রহমান। এর বাইরে গ্রেনেডের স্লিন্টারে  ক্ষতবিক্ষত হন কয়েকশ’ নেতা-কর্মী, যার যন্ত্রণা তারা এখনো বয়ে চলেছেন।  

স্লিন্টারের যন্ত্রণার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতেই ঘটনার দেড় বছর পর মারা যান ঢাকার প্রথম নির্বাচিত মোহাম্মদ হানিফ। গ্রেনেডের বিকট শব্দে ক্ষতিগ্রস্ত কানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এখনো ব্যবহার করতে হয় ‘হিয়ারিং এইড’।  

কিন্তু বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সেদিনের রক্তগঙ্গায় অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও নানা সময় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ওপর হামলা চালানো হয়েছে। কিন্তু তিনি দমে যাননি, পিতার অসমাপ্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।  

সেদিন কিছু হয়ে গেলে হয়তো দেশ এক ভয়ংকর পরিণতিতে পড়তে পারতো। যাই হোক সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় রক্ষা পান বঙ্গবন্ধুকন্যা। তার বদৌলতে আমরা এখন সমৃদ্ধি বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছি।  

ওইদিনের ভয়াবহ হামলার পরপরই আওয়ামী লীগকে দায়ী করে বিভিন্ন সময় বক্তব্য দিয়েছেন তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা।  

হামলায় অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, প্রাণ হারান আইভি রহমানসহ ২৪জন।  ফাইল ফটো এমনকি এও বলা হচ্ছিল যে, আওয়ামী লীগ জনগণের সহানুভূতি পেতেই নাকি গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে নানা তথ্য-উপাত্ত এবং আক্রমণে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের জবানবন্দিতে বেরিয়ে আসে যে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি বি) নেতা মুফতি আবদুল হান্নানই এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী।  

তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে শেষ করে দিতে এই ঘৃণ্য পথ বেছে নিয়েছিলেন। এর আগেও মুফতি হান্নান ও তঁর সংগঠন হুজি বি একাধিকবার শেখ হাসিনাকে হত্যার অপচেষ্টা চালায়।  

এরপরও সেদিন ক্ষমতাসীন মন্ত্রী-নেতারা আক্রান্ত মানুষের পক্ষে না দাঁড়িয়ে জঙ্গিদের পক্ষ নিয়েছিলেন। সরকারের বিভিন্ন বাহিনী, প্রশাসন, গোয়েন্দা সবাই একই সুরে কথা বলেছে। এমনকি বিচারপতি জয়নুল আবেদিনের নেতৃত্বে গঠিত বিচার বিভাগীয় কমিশনও দাবি করে, এই হামলার পেছনে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী নেই। সীমান্তের ওপারের শক্তিশালী দেশটির গোয়েন্দা সংস্থা সেখানে পলাতক সন্ত্রাসীদের দিয়ে এই হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে।  

এমনকি জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়েও বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ওপর দোষ চাপাতে দ্বিধা করেননি তৎকালীন সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা (এমপি)। সাজানো হয় জজ মিয়া নাটকের। কিন্তু ২০০৬ সালের আগস্টে এই নাটকের পেছনের ঘটনা ফাঁস করে দেন নোয়াখালীর জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন।

আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক মাঠে কত কথাই বলেন একে অপরকে। কিন্তু পুরো প্রশাসনকে ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করে এ রকম একটি মিথ্যাকে সত্য বলে চাপিয়ে দেওয়া কোনো সভ্য সমাজে সংস্কৃতি হয়ে উঠতে পারে না।  

পত্র-পত্রিকা মারফতে জানা গেছে, তৎকালীন ক্ষমতাসীনদের এমন এহেন অপতৎপরতার বিষয়টি পরবর্তীকালে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। যদিও তাদের এমন আচরণ কোনো মতেই কাম্য ছিল না। হতাশার বিষয় এটা যে, তৎকালীন সরকার প্রধানও এ বিষয়ে তদন্ত করতে নিষেধ করেছিলেন বিভিন্ন সংস্থাকে।  

যাই হোক, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। ইতিহাসের জঘন্যতম এই হামলার বিচার হয়েছে, যা নতুন করে মোড় নেয় ২০০৭ সালে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে।  

২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর মামলার রায় হয়। এই ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।  

এই মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, সাবেক সাংসদ কায়কোবাদসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্য দিয়ে অবসান ঘটেছে যারা শরীরে স্লিন্টার নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন বিচারের দিকে, তাদের অপেক্ষার। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের বিচারের অপেক্ষার। পুরো জাতি এই কলঙ্কের দায় থেকেও মুক্তি পেয়েছে। আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার আরেকটি ধাপে এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।

হামলার পর আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।  ফাইল ফটো ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। সময় বিকেল ৫টা ৪০ মিনিট। স্থান আওয়ামী লীগ অফিসের সামনের সড়ক বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ। মাত্রই শেষ হলো হলো দলীয় সমাবেশ। খোলা ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শেষ করলেন সেই সময়ের বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনা। সমাবেশস্থলে ট্রাকের চারপাশে তখনো কয়েক হাজার কর্মী-সমর্থকের ভিড়।

ট্রাকের শেষ মাথায় মই লাগানো। নামার জন্য সেদিকে এগিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা। তারপর যা ঘটল, তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে নৃশংস ও নিকৃষ্টতম অধ্যায়। বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো গ্রেনেড। একের পর এক গ্রেনেড। যেন রক্তগঙ্গা।

এর মধ্যদিয়ে রক্তের স্রোত বয়ে গেল আরেক আগস্টে, এই বাংলাতেই। গ্রেনেড, বিস্ফোরণ, ধোঁয়া, স্লিন্টার, আর্তনাদ! নেতা-নেত্রীরা ঘিরে ধরলেন সভানেত্রীকে, রচনা করলেন মানববর্ম। এই মানববর্ম গড়ে ওঠুক দেশজুড়ে, মানুষে মানুষে-এই কামনা। আর দীর্ঘজীবী হোন একজন শেখ হাসিনা, যিনি আমাদের সমৃদ্ধ বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাওয়ার নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন।  

...লেখক: উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জামালপুর।  

বাংলাদেশ সময়: ১০০৩ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১৯
এমএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।