ঢাকা, শনিবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১, ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ০১ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

‘স্বপ্নচারী সিনহার’ মিথ্যাচার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮২৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১, ২০১৮
‘স্বপ্নচারী সিনহার’ মিথ্যাচার ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ/ফাইল ফটো

সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা স্বপ্নচারী এক মানুষ, এই ব্যাপারে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। আবার স্বপ্ন যে সত্য হতে হবে এমন কোনো কথাও কিন্তু নেই। স্বপ্নের অলি-গলিতে ঘুরে বেড়াতে কার না ভালো লাগে বলুন? কিন্তু স্বপ্নভঙ্গ হলে সেটাকেও স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে শিখতে হয়।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো এমন অবস্থায় ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’ লিখেই ফেললেন। কিন্তু আমাদের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা লিখলেন এক বই – ‘ব্রোকেন ড্রিম’।

এই বই নিয়েই যত হইচই! এখন কথা হলো ‘ব্রোকেন ড্রিম’–এ তিনি এমন কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছেন যার বৃত্তান্ত নিছক সাংঘর্ষিকই নয় বরং ডাহা মিথ্যাচার।
 
সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার লেখা বই ‘ব্রোকেন ড্রিম’–এ উল্লেখ করেছেন যে যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করতে  তিনি একবার ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে দেখা করতে চান। বিচারপতি সিনহা লেখেন –
 
“... I decided to approach the Prime Minister. Accordingly, I requested a meeting with the Prime Minister at a secret place. I got a favorable reply within few hours.”
 
অর্থাৎ বিচারপতি সিনহা সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে দেখা করবেন। তো সেই উদ্দেশ্যে তিনি ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে একটি ‘গোপন জায়গায়’ দেখা করার জন্য অনুরোধ জানালেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাকে সম্মতি জানানো হয়।
 
কী আশ্চর্য ব্যাপার! যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করতে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে দেখা করার জন্য বিচারপতি সিনহাকে একটি ‘গোপন জায়গায়’ যেতে হবে কেন? কোন আইনে লেখা আছে যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেশের প্রধান বিচারপতি দেখা করলে মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? এটাকে লোকচক্ষুর আড়ালে করতে হবে কেন? সরকারের তিনটি অঙ্গ: আইন বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ আর বিচার বিভাগ। তিনটি বিভাগের সমন্বিত প্রয়াসেই তো সরকার চলবে, তাই না? তো এতে এতো ঢাক ঢাক গুড় গুড়ের কি আছে?
 
এছাড়া, সুপারিশগুলোর কথা তিনি নিজেই তাঁর বইয়ে উল্লেখ করেছেন। এই যেমন, যুদ্ধাপরাধ-বিচারে গতি সঞ্চার করার জন্য দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনাল গঠনের সুপারিশ, একই উদ্দেশ্যে অতিরিক্ত বিচারপতি এবং প্রসিকিউটর নিয়োগের সুপারিশ, ইত্যাদি। এর সবকিছুই নাকি তৎকালীন আইনমন্ত্রী ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’কে সুপারিশ করেছিলেন কিন্তু ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ তাতে রাজী হননি বলে বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা বইয়ে উল্লেখ করেছেন। আর সে কারণেই নাকি তৎকালীন আইনমন্ত্রী বিচারপতি সিনহার শরণাপন্ন হন যেন বিচারপতি সিনহা নিজে একবার এই ব্যাপারে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’কে অনুরোধ করেন।
 
সবই বুঝলাম, কিন্তু ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে ‘গোপন জায়গাতে’ দেখা করার বিষয়টি বোধগম্য হচ্ছে না। ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’কে যেই প্রটোকল মেনে চলতে হয় সেখানে তিনি আদৌ কোনো ‘গোপন জায়গাতে’ যেতে পারেন কিনা সন্দেহ! তাঁর উপরে একজন বিচারপতির সাথে দেখা করার জন্য তিনি প্রটোকল ভেঙে ‘গোপন জায়গাতে’ দেখে করতে যাবেন সেটা আসলে কতোখানি বিশ্বাসযোগ্য?
 
এরপর বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা বইয়ে উল্লেখ করেছেন ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে তথাকথিত  সেই ‘গোপন জায়গাতে’ দেখা করার পর কি কি কথা হয়েছে। যেহেতু ‘গোপন জায়গাতে’ দেখা হয়েছে, তাই বুঝে নিতে হবে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ এবং বিচারপতি সিনহার কথাবার্তার কোনো সাক্ষী কিন্তু নেই! সেই গোপন সাক্ষাৎকালে  ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ যদি কিছু বলে থাকেন, তাহলে তার একমাত্র সাক্ষী হয়ে আছেন বিচারপতি সিনহা। তো সেই বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা বইয়ে এই ব্যাপারে উল্লেখ করেছেন:
 
“When we met I told the Prime Minister the purpose of my meeting. The moment I raised the point, I felt she reacted sharply.
 
অর্থাৎ যখন ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র সঙ্গে দেখা হলো তখন বিচারপতি সিনহা তাঁর দেখা করার উদ্দেশ্য ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’কে জানালেন। আর শোনামাত্রই ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ ভীষণ প্রতিক্রিয়া দেখালেন বলে বিচারপতি সিনহার মনে হল। খেয়াল করুন, এটা কিন্তু নিতান্তই বিচারপতি সিনহার মনে হওয়া ব্যাপার। কারণ ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র এই “ভীষণ প্রতিক্রিয়া” দেখার তো আর কোনো সাক্ষী নেই!
 
এরপর বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা বইয়ে উল্লেখ করেছেন:
 
“Then she became emotional and explained to me the suffering she had undergone in getting justice for the trial of those who had murdered her parents and younger brothers. She told me how much money she spent for collecting and safeguarding witnesses and said the mental pressure she withstood was beyond comprehension. She was intensely interested in putting the offenders to justice, but she had to cross a lot of hurdles. Given that backdrop she straightaway rejected the proposal of the Ministers.”
 
অর্থাৎ বিচারপতি সিনহার মতে‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ তাঁর এই “ভীষণ প্রতিক্রিয়া” দেখিয়ে পরক্ষণেই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লেন। একেবারেই ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ বিচারপতি সিনহাকে বোঝানো শুরু করলেন যে তাঁর নিজের (‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’) বাবা-মা এবং ছোট ভাইদের বিচার করতে তাঁকে কত অর্থকষ্ট, মানসিক যন্ত্রণা, বাধা-বিপত্তি সইতে হয়েছে। আর এই কারণেই নাকি ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে কোনো সুপারিশ শুনতে রাজী নন।
 
আচ্ছা, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ যে বিচারের কথা বলছেন সেটা কি শুধুই তাঁর পারিবারিক বিষয়? জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর তাঁর পরিবার কি আমাদের কেউ নন? এটা ঠিক যে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ তাঁর ঔরসজাত কন্যা। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির জনক আর তাই তাঁর হত্যার বিচার আমরা সবাই চেয়েছি। এই রাষ্ট্র চেয়েছে। আর সেই বিচার হয়েছে এই বাংলার মাটিতে। কিন্তু বিচারপতি সিনহা যেভাবে ঘটনা বর্ণনা করলেন তাতে তো মনে হচ্ছে, বাংলাদেশে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ ছাড়া আর কেউই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচার চায়নি। কত বড় মিথ্যাচার!
 
এরপর বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা বই-এ উল্লেখ করেছেন:
 
“She frankly conceded that corruption was rampant, and since the offenders were powerful persons having money and muscle, and they could influence any official or witness and this could not be tackled by the administration all the time. Moreover, forty years had elapsed in the meantime, and it was extremely difficult to collect witnesses as most of them are not alive now. She had set up the tribunal chiefly to meet her election pledge and there was nothing more than that she was prepared to do.”
 
অর্থাৎ, বিচারপতি সিনহার মতে‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ তাঁকে জানালেন যে যুদ্ধাপরাধের বিচার করার বিষয়টি অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার, এর সফলতা নিয়ে তাই ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ সন্দিহান বিভিন্ন কারণে। প্রথম কারণ বাংলাদেশে সবাই দুর্নীতিবাজ, ন্যায়বিচার তাই করা যাবে না। এর মধ্যে ৪০ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সুতরাং, জীবিত সাক্ষী খুঁজে পাওয়া ভার। তাই তিনি এই বিচার নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নন। আর এছাড়া, বিচারপতি সিনহার কাছে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ নাকি অকপটে বললেন যে তিনি ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছেন মূলতঃ তাঁর নির্বাচনী প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার উদ্দেশ্যে, সুতরাং ট্রাইব্যুনাল নিয়ে আর কিছু করার জন্য তিনি প্রস্তুত নন।
 
বিচারপতি সিনহা তাঁর লেখা বইয়ে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র সাথে তাঁর এই সাক্ষাতের কথাবার্তা থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার করার বিষয়টি ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র কাছে যেন কোনো গুরুত্বই রাখে না। এটা শুধু একটা লোক দেখানো পদক্ষেপ সরকারের।  

সত্যি কি তাই? যদি সত্যি হয়েই থাকে তাহলে আমরা ২০১০ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত এতো কাঠখড় পোড়ালাম কেন? এতোগুলো মামলার রায় হলো কী করে? এরই মধ্যে ৬টি ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হল কী করে? সরকার এতো  বৈরী-সহিংস পরিবেশের মধ্য দিয়ে এই বিচারকে এগিয়ে নিয়ে গেল কেন? আন্তর্জাতিক বিশ্বে সরকারকে এতো প্রতিকূলতা আর ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করতে হলো কেন? 
 
যুদ্ধাপরাধ বিচার বিষয়ে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র ভুমিকা নিয়ে বিচারপতি সিনহা যে জঘন্য মিথ্যাচার করেছেন তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। আর সেজন্যই তিনি ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’র সাথে ‘গোপন জায়গাতে’ দেখা করার বিষয়টির অবতারণা করেছেন।  এই আলাপচারিতার কোনো সাক্ষী নেই। ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ আদৌ এ ধরনের কথা বলেননি বা বলতে পারেন না।  আমরা যারা যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিভিন্ন দায়িত্বে রয়েছি তাহলে আমরা কাজ না করে বসে থাকলেও তো পারতাম। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি, নানা সমালোচনার মোকাবিলা করেছি, নানা ষড়যন্ত্র প্রতিহত করেছি এবং এখনও করে যাচ্ছি।
 
যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর সরাসরি সম্পৃক্ত আছি। আমি ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’কে দেখেছি যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিষয়ে অটল থাকতে, আপসহীন থাকতে। ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’কে দেখেছি ন্যায় বিচারের পক্ষে সোচ্চার থাকতে। তিনি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে কখনো খাটো হতে দেননি আন্তর্জাতিক মোড়লদের হাতে অথবা দেশের ভিতরে চেতনা ব্যাবসায়ীদের কাছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে কখনই তিনি যুদ্ধাপরাধ বিচারের রায় কার্যকরের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। জন কেরি, বান কি মুন, হিলারি লবি গ্রুপের চিঠি, ফোনকল বা চাপের মুখে হার মানেননি। যুদ্ধাপরাধ বিচারের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যেতে পারলে তাঁর সরকার আরও স্বস্তিতে দিনাতিপাত করতে পারতো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক মেরুকরণ অন্যরকমও হতে পারতো। কিন্তু না, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ সেটা হতে দেননি ।
 
উল্টো আমি দেখেছি বিচারপতি সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধ বিচার বন্ধ করতে চেয়েছেন। ট্রাইব্যুনাল স্থানান্তর করতে চেয়েছেন। বিচার নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। প্রকাশ্য আদালতে নিজেকে শান্তি কমিটির সদস্য বলে দাবি করেছেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধাপরাধ বিচারের প্রক্রিয়াকে বন্ধ করতে পারেননি। আর তাই তাঁর স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। এ কারণে এখন তিনি ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী’ সহ নানাজনকে নিয়ে নানা উদ্ভট ও অবিশ্বাসযোগ্য কথা রটিয়ে ভগ্ন-স্বপ্নের অলিগলিতে মিথ্যাচারের বেসাতি করে বেড়াচ্ছেন।

ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ
আইনজীবী ও আইনের শিক্ষক


বাংলাদেশ সময়: ১৪১৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ০১, ২০১৮
জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।