ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

মিশুক মুনীরের স্ত্রী মঞ্জুলি কাজী লিখেছেন টরন্টো থেকে

স্বজন হারানোর ব্যথা নিয়েইতো সেদিন গিয়েছিলাম!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১১
স্বজন হারানোর ব্যথা নিয়েইতো সেদিন গিয়েছিলাম!

তিনটি মাসও পার হতে পারলো না, মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদসহ পাঁচটি মানুষের প্রাণ কেড়ে নেওয়া হন্তারক চুয়াডাঙ্গা ডিলাক্সের কুখ্যাত সেই চালক জমিরের মুক্তির দাবি উঠেছে। কেবল দাবি নয় তার মুক্তির জন্য দেশের গোটা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা স্থবির করে রাখা হয়েছে দুই দিন ধরে।

খবরটি জেনে  বুক ভেঙ্গে কান্না আসে, স্তব্ধ-অবাক হয়ে যাই। এ কোন্ দেশের সন্তান আমি, কোন‌ সরকারের অধীনে আমার,আমাদের বাস। কান্না আসে, দুঃখ হয়, ক্ষোভ জমে, ঘৃণায় নীল হয়ে ওঠে অন্তরের ভেতরটা।

মিশুককে হারিয়েছি, আমি জানি তার কষ্ট। যেমনটা জানেন বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কারণ তিনিও স্বজনহারা। কিন্তু সেই প্রধানমন্ত্রীর দেশে এ কোন্ দৃশ্য আজ দেখি! শাজাহান খান, আবুল হোসেনরা দেশটাকে নিয়ে, দেশের মানুষগুলোকে নিয়ে এ কোন্ খেলায় মেতেছেন?

কোরবানির ঈদ সামনে রেখে পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ে লাগাতার ধর্মঘট ডাকিয়ে দেশের মানুষকে জিম্মি করে তবেই মুক্তি দাবি করা হয়েছে চালক জমিরের।

জমির যে মাত্র ৭৫ দিন আগে দেশের দুই মেধাবী সন্তানসহ পাঁচ পাঁচটি প্রাণ কেড়ে নিলো তার বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কায়, সেকথা কি সবাই ভুলে গেছে?

সুদুর কানাডায় থেকেও আমি বুঝি শাজাহান খান তার পরিবহন শ্রমিকদের হাতে রাখতেই তাদের দিয়ে এই আন্দোলন করিয়ে পেছন থেকে ইন্ধন যোগাচ্ছেন। এই কাজে তিনি সঙ্গে রেখেছেন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনকে।  

আমার প্রশ্ন, প্রধানমন্ত্রী কি দেখেন না, তিনি কি জানেন না?

আমি বুঝি তিনিও সব জানেন।  

শাজাহান খান যতটা না মন্ত্রী, যতটা না দেশের জনগণের প্রতিনিধি তার চেয়ে বেশি তিনি শ্রমিকনেতা। শ্রমিকনেতা হওয়া তো দোষের কিছু নয়, অনেকাংশে গর্বের। কিন্তু যে শ্রমিকদের হাতে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স তুলে দিয়ে দেশের সাধারণ মানুষকে হত্যার লাইসেন্স তিনি তুলে দিয়েছেন তাদের নেতা হওয়া নিঃসন্দেহে বিপদের।

বাংলাদেশের শ্রমিক ইতিহাসের গৌরবের অধ্যায়ও রয়েছে; কিন্তু শাজাহান খানের নেতৃত্বে গৌরব করার মতো কিছু নেই তা তার বক্তব্যে তিনি নিজেই প্রমাণ করেছেন। তিনি বলেছেন, `গরু ছাগল চিনলেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া যায়। ` প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির চালকও অতিশিক্ষিত নয় বলে তিনি আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন। আর অশিক্ষিত চালকের হাতে লাইসেন্স তুলে দেওয়ার জোরে দেশের জনপ্রিয় চিত্রতারকার (ইলিয়াস কাঞ্চন), যিনি সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীকে হারিয়ে নিরাপদ সড়কের জন্য দীর্ঘ আন্দোলন করে যাচ্ছেন, ছবিতে জুতোপেটা করতে কিংবা মাটিতে ফেলে পদদলিত করতে ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছেন।  

এসব দিয়ে কী বোঝাতে চান শাজাহান খান ও তার দোসররা? তিনি কী দেখাতে এমন শো-ডাউন করছেন। একজন চালককে জেল থেকে বের করে আনতে তার যে নিরলস প্রচেষ্টা, শ্রমিক নেতাদের দিয়ে ধর্মঘট ডাকিয়ে ঘাতক গাড়ির চালককে মুক্ত করানোর কৌশল জনগণের জানা আছে। কিন্তু জেনেই কি লাভ? যে দেশে জনগণ সরকারের প্রতিপক্ষ সেদেশে জনগণ আসলেই জিম্মি। ঠিক যেমন জিম্মি দুই দিন ধরে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের কোটি মানুষ।

মিশুক মুনীর ও তারেক মাসুদ মারা যাবার পর অনেকের মধ্যেই একটি সাড়া পড়ে যায়। অনেকেরই সোচ্চার ভূমিকাও আমরা দেখি । কিন্তু সে উদ্যোগেও এখন কিছুটা ভাটা পড়েছে। আমি তখনই বলেছিলাম সাতদিনের মাথায় চিৎকার করতে করতে জোর কমে যাবে। কিন্তু জনগণকে কিংবা নাগরিক সমাজকে কেন এত দায়িত্ব নিতে হবে? 

নাগরিক সমাজ তো কম করেনি। ঈদের দিনটি পর্যন্ত কাটিয়েছে শহীদ মিনারে। কিন্তু তার প্রতি প্রধানমন্ত্রী কি সাড়া দিলেন তা আমাদের জানা। তিনি বলে দিলেন, `যারা ওখানে ঈদ করছে তারা কেউ বাড়িতে যায় না!`

কিন্তু আমি যদি প্রশ্ন করি. প্রধানমন্ত্রী নিজেও কি কখনো বাড়িতে যান? তারতো বিশাল গাড়ির বহর কড়া নিরাপত্তায় ফাঁকা রাস্তায় সাঁ সাঁ করে ছোটে। সে রাস্তায় জমিরদের মতো বেপরোয়া চালকের দেখা মেলে না। তাই তিনি জানেন না।

মিশুক-তারেকরা মারা যাবার পর প্রধানমন্ত্রীর ডাকে তার দপ্তরে গিয়েছিলাম। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমার মনে হয়েছিলো: এ কোথায় এসে পড়লাম!

প্রধানমন্ত্রীকে সেদিন একটি কথাই বলেছিলাম, আমি মিশুকের জন্য আসিনি, সাধারণ মানুষের জন্য এসেছি। তাকে অনুরোধ করেছিলাম নিরাপত্তার উদ্যোগ নিতে তাতে সাধারণ মানুষের প্রাণরক্ষা হবে।

প্রধানমন্ত্রী আমাকে বললেন, `আমি ডিজিটাল লাইসেন্স করার জন্য চিৎকার করছি। কিন্তু কেউ রাজি হচ্ছে না। এতে যে কারো কারো ব্যবসা নষ্ট হয়ে যাবে!`

আমি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিলাম, একটি জিরো টলারেন্স আইন প্রণয়ন করে তার কঠোর প্রয়োগের জন্য।

তিনি উল্টো আমাদেরই দুষলেন। দুষলেন মিশুক মুনীর-তারেক মাসুদকেও। বললেন ওরা সচেতন থাকলেই এভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাতো না। প্রধানমন্ত্রী আমাদের আরও সচেতন হতে বলছেন; কারণ  সচেতনতার অভাবে আমরা ডিভাইডার ভেঙ্গে ফেলি, আমরা ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করি না, দেখে রাস্তা পার হই না বলেই গাড়িচাপা পড়ি।  

আমি এও বললাম, বিদেশে গিয়ে এই মানুষগুলোই কিন্তু ট্রাফিক আইন মেনে চলে। প্রধানমন্ত্রী তাতে সায় দিয়ে বললেন, `সত্যিই মানুষের এই অসচেতনতা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। `

মোদ্দা কথা, প্রধানমন্ত্রীর কথায়ও সেদিন মনে হয়েছিলো যারা অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেলেন তারাই যেন দায়ী। তখন আমার মনে হচ্ছিলো... আমি ভুল যায়গায় এসেছি... কেন এসেছি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম।

আর এদিকে, প্রধানমন্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদের সঙ্গে তাদের চলচ্চিত্র বিষয়ে দু-চারটি কথা বলে দ্রুত তারেক মাসুদের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার সম্পর্কের প্রসঙ্গ টেনে সচ্ছন্দে সেই আলোচনা করছিলেন।

ওই দিন আইভি রহমানের মৃত্যুদিবসের মিলাদ মাহফিল থাকায় কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীকে সেকথা জানালে দ্রুত তিনি সেখানে অংশ নেওয়ার জন্য চলে যান। আর মনোব্যথা নিয়ে ফিরে আসি সেই দপ্তর থেকে।

আইভি রহমানের জন্য মিলাদ মাহফিল বা আলোচনা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। তিনিও নিহত হয়েছেন ঘাতকের হাতে। প্রধানমন্ত্রী স্বজন হারাবার ব্যথা জানেন বলে দাবি করেন, সে কারণেই অতি ঘনিষ্ঠ আইভি রহমানের মৃত্যু তাকে ব্যথিত করবে। কিন্তু আমরাওতো স্বজন হারানোর ব্যথা নিয়েই সেদিন গিয়েছিলাম!

বাংলাদেশ সময় ১৯৩৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।