ঢাকা, শনিবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

পদ্মাসেতু না ঠিকাদারী ব্যবসায়ী মন্ত্রী আবুল?

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিংএডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১১
পদ্মাসেতু না ঠিকাদারী ব্যবসায়ী মন্ত্রী আবুল?

পদ্মাসেতুর দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের ব্যাপারটি আর কানাঘুষার পর্যায়ে নেই। বিশ্বব্যাংক এর মাঝে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, তাদের দুর্নীতির অভিযোগটি সরাসরি যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে।

মন্ত্রীর পারিবারিক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সাকো ইন্টারন্যাশনালের তরফে পদ্মাসেতুর ঠিকাদারী টেন্ডারে অংশগ্রহণকারীর কাছে কমিশন চাওয়া হয়েছে! সাকোর পাশাপাশি তদবির করা হয়েছে পছন্দের আরও একটি প্রতিষ্ঠানকে কমিশন এজেন্ট করার বিষয়েও! মন্ত্রী নিজে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ভয়ভীতি দেখিয়েছেন! অভিযোগটি পাওয়ার পর এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট ওয়াকিবহাল ১২ জনের ইন্টারভ্যু-সাক্ষ্য নিয়ে তারা দুর্নীতির বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে। এরপর ঋণ স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিয়ে তারা সমুদয় বক্তব্য লিখিতভাবে জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে।
 
আর আবুল মন্ত্রী এখন বলছেন বিশ্বব্যাংকের করা দুর্নীতির অভিযোগ তার বিরুদ্ধে না। সরকারের বিরুদ্ধে। এর মানে কী দাঁড়ায়? সরকার মানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে? শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের সরকার যদি আবুল মন্ত্রীর দাবি মতো দুর্নীতিগ্রস্ত হয়, তাহলে এর জবাবটিও তাদের দিতে হবে। কারণ আবুলকে তারা শুধু মন্ত্রী করেননি, সকল মহলের অভিযোগ সত্ত্বেও তারা আঁকড়ে ধরে আছেন।
 
আবার সেতুর টাকার ব্যাপারে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে বিশ্বব্যাংক মুখের ওপর ‘না’ বলে দিলেও  কোন ভরসায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি নিঊইয়র্ক ছাড়ার আগে কী করে ভরসা দিলেন তা তিনিই জানেন। দেশের মানুষ অবশ্য জানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেন, এর উল্টো হয়! মনমোহনের সফরে জোর দিয়ে বললেও তিস্তা চুক্তি হয়নি।
 
পদ্মাসেতুর দুর্নীতি নিয়ে সম্প্রতি দুদকের চিঠির জবাবেও বিশ্বব্যাংকের তরফে একই তথ্য দেওয়া হয়েছে। এখন মোটামুটি স্পষ্ট প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্ক সফরে যাওয়ার আগেই ঋণ স্থগিতের অফিসিয়াল চিঠি পেয়েছে সরকার। এরপর পুরো বিষয়টির চুপচাপ ফয়সালার আশায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেনদরবারের চেষ্টা করেও কামিয়াব হতে পারেননি। উল্টো দুর্নীতি কবুল তথা সরকার বিষয়টির তদন্ত করবে এমন প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন।
 
বিশ্বব্যাংকের ঢাকার কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা স্থগিত ঋণের বিষয়টির ফয়সালার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আভাসে-ইঙ্গিতে বলে দিয়েছেন, ফয়সালা মানে দুর্নীতির ইঙ্গিতকৃত আবুল মন্ত্রীর অপসারণ! কিন্তু এতকিছুর পরও সরকার যে আদরের আবুলকে রক্ষা করতে চাইছে, তা তাদের সবশেষ পদক্ষেপে স্পষ্ট। সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বৃহস্পতিবার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক রফিকুল ইসলামকে এর আগে সরিয়ে দেওয়া হয়।
 
আমেরিকানরা এর আগে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের এক কর্মকর্তার ব্যাপারেও একই আপত্তি জানিয়েছে। দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ার পর ওই কর্মকর্তা ঢাকার মার্কিন দূতাবাসকে নির্দিষ্ট অংকের টাকা ফেরত দিতে বাধ্য হন। ওই ঘটনার পর তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মরিয়ার্টি প্রশ্ন তুলে ওয়াশিংটনকে লিখেছেন, প্রধানমন্ত্রীর দফতরের গুরুত্বপূর্ণ পদে এমন একজন কর্মকর্তাকে বহাল রেখে কীভাবে একটি সরকারের দুর্নীতিমুক্তভাবে কাজকর্ম করা সম্ভব? মরিয়ার্টির তারবার্তার বক্তব্যটি সম্প্রতি উইকিলিকসের মাধ্যমে ফাঁস হয়েছে। আবুল মন্ত্রীর সততা নিয়েও মরিয়ার্টির তারবার্তায় প্রশ্ন তোলা হয়।

এতসব কিছু আর সর্বশেষ বিশ্বব্যাংকের অনড় অবস্থান সত্ত্বেও আবুল মন্ত্রীকে আঁকড়ে থাকার রহস্য নিয়ে নানান ডালপালা মেলা শুরু করেছে। পদ্মাসেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি স্বপ্ন আটকে যাওয়া সত্ত্বেও বিরোধীদলের সমালোচনার ভয়ে সরকার যেহেতু দুর্নীতি কবুল করতে চাইছে না, উল্টো প্রধানমন্ত্রী সার্টিফিকেট দিয়ে বলছেন, তার মন্ত্রীরা দুর্নীতিতে না কাজে স্মার্ট, তখন কানাঘুষা-কথাবার্তার ডালপালা আরও চারপাশে ছড়াতে পারে দ্রুত। কারণ এর মাঝে সাফ-স্পষ্ট হয়ে গেছে আবুল মন্ত্রীর বরখাস্ত-অপসারণ ছাড়া জট খুলবে না স্বপ্নের পদ্মাসেতুর! এই সরকারের মেয়াদের মধ্যে সেতুর উদ্বোধন না, এর কাজ কবে শুরু হবে তাই এখন আর কেউ জানে না। উল্টো এর মাঝে সেতুর প্রাক্কলিত ব্যয়ও অনেক  বেড়ে গেছে। পরিস্থিতি দেখে শুনে ঝোপ বুঝে কোপ মারার মতো সিলেট রোড মার্চের বক্তৃতায় আগামীতে ক্ষমতায় গেলে দুর্নীতিমুক্ত পদ্মাসেতু নির্মাণের আশ্বাস দিয়ে রেখেছেন বিরোধীদলের নেত্রী খালেদা জিয়া!
 
লক্ষ্য করার বিষয়, সাকো ইন্টারন্যাশনাল নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের মালিক ঠিকাদার এই আবুল মন্ত্রীর কিন্তু শুরু থেকেই শুধু বড় বড় প্রজেক্ট আর ঠিকাদারী কাজের দিকেই নজর! এ সরকারের মন্ত্রী হওয়ার জন্য সাকোর দায়িত্ব থেকে আক্ষরিক পদত্যাগ করে তা স্ত্রী খাজা নার্গিস হোসেন, দুই মেয়ে সৈয়দা রুবাইয়াত হোসেন ও সৈয়দা ইফফাত হোসেনের নামে সক্রিয় দেখানো হলেও বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ ইঙ্গিত করেছে মন্ত্রী আবুল আসলে মন্ত্রণালয়ে বসে তার ব্যক্তিগত ব্যবসার লাভালাভ দেখভালেরই কাজ করছেন! এমন একজন ঠিকাদারী ব্যবসায়ীকে জেনেশুনে প্রধানমন্ত্রী কেন যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছেন বা এখনও বহাল রেখেছেন, আগামীতে সে প্রশ্নও সামনে আরও বেশি চলে আসবে।

কারণ আগের বারের তথা ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের ক্ষমতার সময় শেখ হাসিনা এ বিষয়ে খুবই কঠোর ছিলেন। শেখ সেলিমের ট্রাভেল এজেন্সির ব্যবসা থাকায় তখন তার আগ্রহ সত্ত্বেও তাকে বিমান মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। সাধারণত কাউকে কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার সময় এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ব্যক্তিগত-পারিবারিক অর্থনৈতিক লাভালাভের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হয়। এটিই সরকারি কনভেনশন। কিন্তু এবার মন্ত্রী আবুলের বেলায়ই তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
 
লক্ষ্য করার বিষয়, এবার আবুল মন্ত্রীর বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগ আসা সত্ত্বেও চোরের বড় গলার মতো এসবের বিরুদ্ধে তিনি একাই সোচ্চার ছিলেন এবং এখনও আছেন! কখনও ট্রান্সপারেন্সি, কখনও দুদক, সবশেষ তিনি পদ্মাসেতুর দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে বিএনপিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন! ট্রান্সপারেন্সি যখন বলল, তারা তদন্তের দায়িত্ব নিতে পারে, তবে এর জন্যে মন্ত্রণালয়ের যে কোনো নথি চাহিবা মাত্র তাদেরকে দিতে হবে। এরপর বিষয়টিতে স্বাভাবিক তিনি চুপ মেরে যান।
 
মন্ত্রী হয়তো মনে করছেন, তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির যে ঘরানার অভিযোগ, এর কোনো ডকুমেন্টারি প্রমাণ নেই। কেউ যদি কারও কাছে থেকে ঘুষ অথবা কমিশন নেয় বা দাবি করে, এর কোনো ডকুমেন্টারি প্রমাণও থাকে না। কিন্তু বিশ্বব্যাংক বলেছে তারা এ ব্যাপারে ১২ জনের সাক্ষ্য নিয়েছে। তাদের কাছে অভিযোগকারী টেন্ডার না পেয়ে বিক্ষুব্ধ হতে পারে এমন জেনেশুনে অভিযোগের আইনগত ভিত্তির ব্যাপারে তারা শুরু থেকে সতর্ক ছিল। এখন এই স্বপ্নের সেতুর বিষয়ে একই দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করছে খোদ কানাডার পুলিশ!

সাধারণত কোনো বিদেশি রাষ্ট্র অথবা বিশ্বব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠান কোনো বিশেষ ইস্যুতে এ ধরনের অবস্থান নিলে এর প্রতিক্রিয়া কত সুদূর প্রসারি হয়, তা সরকার যারা চালান তারা জানেন। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতের তা বেশি জানার কথা। কারণ এ ধরনের বিদেশি সংস্থায় কাজ করার ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা তার আছে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের আস্থা অর্জনের শর্ত পূরণে সরকার যত দেরি করবে দেশ তত বেশি ভুগবে।
 
এমন দুর্নীতির একের পর এক অভিযোগ সত্ত্বেও মন্ত্রিত্ব ধরে রাখতে বেশরম মরিয়া অবস্থান নিয়েছেন আবুল মন্ত্রী! এখন তিনি বলা শুরু করেছেন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ ছাড়াই নাকি এমন পদ্মা সেতু বছরে চারটি করা সম্ভব! সরকার কোন কোন খাতে কত ভুর্তকি দেয়, এর একটি হিসাব দিয়ে কোনখাত থেকে টাকা নিয়ে সেতু বানাতে হবে, এমন একটি ফতোয়াও দিয়ে ফেলেছেন। যেখানে দাতাদের ঋণ-প্রতিশ্রুতি ছাড়া একটি বাজেট করা যায় না, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণ নিয়ে একটি সরকার জোড়াতালি দিয়ে চলছে সেখানে পুরো বিষয়টি স্রেফ একটা ফাজলামো আর কী!

গত ঈদের আগে যখন দেশের রাস্তাঘাট বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তখন জরুরি মেরামতের টাকা ছাড়ের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, উন্নয়ন বাজেটের টাকা ভুর্তকির খাতে খরচ করাতে রাস্তাঘাটের মেরামতসহ অনেক কাজকর্ম ঠিকমতো করা যায় না। জ্বালানি খাতের ভুর্তকি কমাতে সারা সময় চাপ দিয়ে চলেছে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ নানান ঋণদাতা সংস্থা! আপনি যার কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চলবেন, তার কথামতো চলতে হবে। নইলে সে ঋণ দেবে না। পদ্মাসেতুর মতো আরও অনেক সমস্যা করবে। আর দেশে একবার জ্বালানি তেলের দাম বাড়ালে চতুর্মুখী কী কী প্রতিক্রিয়া হয়?

এখন এমন একজন আবুলের মন্ত্রিত্ব বাঁচাতে ভুর্তকি প্রত্যাহারের লক্ষ্যে জ্বালানি তেলের মতো খাতের দাম যদি আরও বাড়ানো হয়, পাবলিকের কিল একটাও মাটিতে পড়বে কী? না আগামীতে ভোট পাওয়া লাগবে? না দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত আবুল মন্ত্রীকে আঁকড়ে থাকলে বিশ্বব্যাংকসহ দাতা সংস্থা-দেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে? হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে বৈঠকে কি সে বার্তা সামনসামনি পাননি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি?
 
ড. ইউনুসসহ নানা ইস্যুতে আমেরিকার সঙ্গে সরকারের যে সুমধুর সম্পর্ক নেই, তা বুঝে এসেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী! বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপোড়েন যে পর্যায়ে চলে গেছে, তা আগামীতে কী শুধু একজন আবুল মন্ত্রীর অপসারণে এর ক্ষত সারানো সম্ভব হবে? সৈয়দ আবুল মকসুদসহ বিশিষ্ট নাগরিকদের না হয় গোয়েন্দা হয়রানির ভয় দেখিয়ে আপাতত নিষ্ক্রিয় করা গেছে। বিশ্বব্যাংকের স্থানীয় আবাসিক প্রতিনিধিকে সাইজ দিতে তেমন কিছু গোয়েন্দা লাগানো সম্ভব কী? তারা ঠিকমতো ট্যাক্স দেয় কিনা, শুল্কমুক্ত বিপণির মদ ঠিকমতো খায় কিনা! এক লোভী মন্ত্রীর সমস্যাকে এর মাঝে অনেক বড় করে ফেলেছে সরকার!

ফজলুল বারী: সিডনিপ্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ১৩০০ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।