ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

ইন্টারন্যাশনাল ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ডে: হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কথা

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১১
ইন্টারন্যাশনাল ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ডে: হারিয়ে যাওয়া মানুষদের কথা

৩০ আগস্ট ইন্টারন্যাশনাল ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স ডে পালিত হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। এক সময় লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশে অব্যাহতভাবে গোপনে মানুষ ধরে নিয়ে হত্যা করে লাশ গুম করে দেয়া হতো।

এই গুপ্ত হত্যা বন্ধ করতে ১৯৮১ সালে লাতিন আমেরিকার ফেডারেশন অব অ্যাসোসিয়েশন ফর রিলেটিভস অব ডেটেইনেড ডিসঅ্যাপিয়ারড সংগঠন নামে একটি বেসরকারি সংস্থা কোস্টারিকায় স্থাপিত হয় গোপন গ্রেফতার ও গুমের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বাড়ানোর জন্য।

জাতিসংঘের International Convention for the Protection of All Persons from Enforced Disappearance সনদের সাথে সঙ্গতি রেখে মানুষকে অবৈধ খুনের হাত থেকে রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই সনদের চার নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র যে কোনো ধরনের গুমের ঘটনাকে অপরাধ হিসেবে মেনে নিয়ে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে। এ রকম আরো অনেক ভালো ভালো কথা আছে সেখানে। কিন্তু রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্রের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ মদদে কোনো ঘটনা ঘটলে আন্তর্জাতিক সমাজ কি ভূমিকা নেবে সে ব্যাপারে অস্পষ্টতা  আছে।   

লাতিন আমেরিকার মতো বাংলাদেশের পরিস্থিতি অতটা ভয়াবহ না হলেও বিগত দু-তিন বছর ধরে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার নামে গোপনে গ্রেফতার করে লাশ গুম করার প্রবণতা আতংকজনকভাবে বেড়ে গিয়েছে। সাথে সাথে বেড়েছে পুলিশ এবং র‌্যাব কর্তৃক ক্রসফায়ারের নামে মানুষ হত্যা। গ্রেফতারের পর ভয়াবহ নির্যাতনের কথা না-ই বা বললাম। ইতিমধ্যে এই আতংকের কথা বাংলাদেশের সীমা ছেড়ে বাইরের বিশ্বেও ছড়িয়ে গেছে। কিছুদিন আগে অ্যামনেষস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক প্রতিবেদনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতি বাংলাদেশের পুলিশ এবং র‌্যাবের কাছে অস্ত্র বিক্রি করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়,  র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা বিচারবহির্ভূতভাবে মানুষ হত্যার কাজে এসব অস্ত্র ব্যবহার করে থাকে।

প্রতিবেদনের ভালো-মন্দ দুটো দিক আছে। ভালো দিকটা হচ্ছে দেশে সাধারণ মানুষের এই হত্যা, গুম কিংবা নির্যাতনের বিরুদ্ধে বিচার পাবার কোনো জায়গা নেই। বিচারব্যবস্থা এক রকম এদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে। কোনোভাবে কেউ মামলা করলেও মামলার গতিপ্রকৃতি যেভাবে চলতে থাকে সেটাও একটা দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তির পর্যায়ে চলে যায়। যেহেতু মামলার তদন্ত থাকে পুলিশের হাতেই, তাই মামলার ভাগ্যটা কী হবে তার জন্য টাকা এবং সময় খরচ করে আদালতের দরজা পর্যন্ত না গেলেও চলে। অন্যদিকে জনগণের ভোট পেয়ে যারাই ক্ষমতাসীন হোক না কেন, কোনো ঘটনা ঘটলে তদন্তের আগেই মন্ত্রীরা সবাই নির্যাতনকারীর পক্ষ নেয়। কারণ বিরোধী দল ঠেকাতে এসব ঠেঙারে বাহিনীর প্রয়োজন। তাই অ্যামনেস্টির মতো কোনো সংস্থার বরাতে চাপ প্রয়োগে এই অপতৎপরতা কিছুটা লাঘব হলেও সেটাই অনেক।

যতোদূর মনে পড়ে বিএনপি নেতা, ৫৬ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমকে দিয়ে গোপন গ্রেফতার এবং গুপ্তহত্যার কালো যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপরে একে একে মুদি দোকান কর্মচারী রফিকুল ইসলাম, সদরঘাটের ব্যবসায়ী তারিক উদ্দিন আহমেদ রানা, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তৌফিক, চট্টগ্রামের ইউনিয়ন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, নির্মাণ ব্যবসায়ী জহির রায়হান হীরন, যুবলীগ নেতা লিয়াকত, অধুনা দয়াগঞ্জের সেই হতভাগ্য তিন যুবকসহ আরো অনেকে সাদা পোশাকের পুলিশ অথবা র‌্যাবের হাতে গ্রেফতারের পরপর নিখোঁজ হয়ে যায়। কারো কারো লাশ মিললেও অধিকাংশের কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি।

ওপরের ঘটনাগুলো আমাদের দেশে ভয়াবহ মানবাধিকার লংঘনের চিত্র তুলে ধরে। রাষ্ট্রের উচিত পুলিশি নির্যাতন, গোপন গ্রেফতার এবং হত্যা বন্ধে কার্যকরী ভূমিকা নেয়া। সাদা পোশাকের কেউ কাউকে গ্রেফতার করলে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করণের একটা কৌশল বের করতে হবে যাতে গ্রেফতার-পরবর্তী কোনো আইন-বহির্ভূত কর্মকান্ড থেকে তারা রেহাই পেতে না পারে। এটাও হতে পারে সাদা পোশাকে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা পুলিশের পরিচয়ে কাউকে অপহরণ করে হত্যা করতে পারে, যার দায়ভার গিয়ে পড়বে পুলিশের কাঁধে। কিংবা পুলিশেরই কোনো বিপথগামী সদস্য চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে কোনো ব্যাক্তি বা গ্রুপের কাছ থেকে টাকা খেয়ে এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। অথবা গ্রেফতারের পর নির্যাতনে মৃত্যুর দায় এড়াতে পুলিশ বাহিনী লাশ গুম করে গ্রেফতারের কথা অস্বীকার করতে পারে। দয়াগঞ্জের ঘটনা বিষয়ে  ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনারের মুখপাত্র ও গোয়েন্দা পুলিশের (দক্ষিণ) উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ডিবির এ ধরনের হত্যার কালচার নেই। ডিবি আসামি ধরে, মামলা ডিটেক্ট করে, আসামি আদালতে চালান দিয়ে দেয়। ওই সময় যারা ডিবির নাম বলেছে, তারা অবশ্যই মিথ্যা পরিচয় দিয়েছে। ’

তার এই বক্তব্য থেকে কয়েকটি সত্য বেড়িয়ে আসে :

সত্য এক. তিনি মিথ্যা বলেছেন। পুলিশ অপরাধী হিসেবে প্রমাণিত হবার পাশাপাশি পুলিশকে তিনি মিথ্যাবাদী হিসেবেও প্রমাণ করলেন। পত্রিকায় প্রকাশিত ঘটনাগুলো প্রমাণ করে ডিবি পুলিশের নির্যাতনে কীভাবে মানুষের মৃত্যু ঘটছে। বেশ কয়েক বছর আগে অবৈধ টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্বে পুলিশেরই একজন সোর্সকে হত্যা করে লাশ গুম করতে না পেরে ডিবি অফিসেরই পানির ট্যাংকিতে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল।   পুলিশের মাধ্যমে সংঘটিত হাজার হাজার ঘটনা থেকে অল্প কয়েকটি ঘটনাই প্রকাশ পায় যেগুলি তারা লুকাতে না পারে।

সত্য দুই. তিনি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে শপথ ভংগ করে অপরাধীদের বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। যেহেতু পুলিশ কর্তৃক হত্যার ঘটনা পরীক্ষিত, তাই কোনো ঘটনার অভিযোগ আসার পরে তদন্তের আগে কোনো দায়িত্বশীল পদে থেকে কেউ কারো পক্ষে সাফাই গাইতে পারেন না। অপরাধীকে বাঁচানোর চেষ্টা করার মানে হচ্ছে তাকে পুনরায় অপরাধ করতে উৎসাহিত করা। অবশ্যই কারো অপরাধকে আইনের কাছে লুকানোর চেষ্টা আরেকটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

সত্য তিন. গ্রেফতারের বিষয়ে স্বচ্ছতা আনয়ন করা। সাদা পোশাকের কেউ গ্রেফতার করতে আসলে তাৎক্ষণিকভাবে কী করে তাদের পরিচয় নিশ্চিত করা যায় সেটার একটা কৌশল বের করা।

আমরা পুলিশকে খুব কমই বন্ধু হিসেবে পেয়েছি। বিগত দিনগুলিতে যেভাবে একটার পর একটা এই বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযোগ আসছে তাতে ভাবমূর্তির অবশিষ্টটুকুও যাই যাই অবস্থা । নিজেদের শুধরে নেবার সময় এখনো ফুরিয়ে যায়নি। মানুষের জীবনের নিরপত্তা দেয়া পুলিশের সব চেয়ে বড় কর্তব্য। সেটা পালনে ব্যর্থ হলে অ্যামনেষস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কর্তৃক আরো অনেক বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। যেমন হয়তো অচিরেই আন্তর্জাতিক কম্যুনিটি দাবি করে বসবে, বাংলাদেশের পুলিশের মতো নিবর্তনমূলক বাহিনীর কোনো সদস্যের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অংশ নেবার নৈতিক অধিকার নেই। যারা নিজের দেশের মানুষকে আততায়ীর হাত থেকে বাঁচাতে পারে না বরং নিজেরাই আততায়ীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, প্রতিনিয়ত নিজ জনগণের সংগে মানবাধিকার লংঘন করে তাদের কোনো অধিকার নেই শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে জাতিসংঘের শান্তি মিশনের মর্যাদাকে কলুষিত করার।

এটাও মিথ্যা নয় যে, পুলিশ বাহিনীতে দেশপ্রেমিক, সৎ এবং ভালো লোকের সংখ্যাও কম নয়। আমি অনেক লোকের কাছ থেকে চিঠি পেয়েছি যারা আমার লেখা পড়ে মেইল করেছেন। তাদের অনেকেই পুলিশের সন্তান, সৎ পুলিশের সন্তান। তারা তাদের দুখের কথা লিখেছেন, বেদনার কথা লিখেছেন। সৎভাবে কাজ করতে গিয়ে তাদের কারো বাবা কারো ভাই রাজনৈতিক প্রভু কিংবা উপরস্থ বস কর্তৃক কিভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন, পদচ্যুত হয়েছেন। আমার শ্রদ্ধা তাদের প্রতি। নষ্ট চক্রের ভেতরে থেকেও যারা ও পথে পা বাড়াননি তারাই তো সত্যিকার বীর। স্যালুট আপনাদের প্রতি হাজার বার।

আমাদের দেশে বড় কোনো সামাজিক ভূমিকম্পের আগে কারো টনক নড়ে না। যেমন প্রতি বছর হাজার হাজার সাধারণ জনগণ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেও কেউ ভ্রূক্ষেপ করেননি যতদিন না তারেক মাসুদদের মতো ক্ষণজন্মা লোকেদের জীবন বিসর্জন না হলো। হয়তো পুলিশ কর্তৃক এই অপহরণ, গুপ্ত হত্যা, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি বন্ধ হবে না যতদিন না কোনো বিখ্যাত লোক এর নির্মম শিকার হয়ে মারা যাবেন। হয়তো তখনই শুধু আমাদের মূক-বধির রাষ্ট্রযন্ত্র তৎপর হবে এগুলো বন্ধের পদক্ষেপ নেবার জন্য। তারেক মাসুদদের মতো মানুষ ক্ষণে ক্ষণে জন্মায় না।   তাছাড়া একজন সাধারণ মানুষেরও সমান অধিকার আছে নিজেকে রক্ষা করার। পুলিশের মতো সশস্ত্র বাহিনীর পুরোপুরি বেপরোয়া হবার আগে সরকারের উচিত এদের লাগাম টেনে ধরা।

বাংলাদেশ সময় ১৪৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ৩০, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।