ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

ফুটবল পাগল সেই দর্শকরা কোথায়?

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১৪ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৬
ফুটবল পাগল সেই দর্শকরা কোথায়?

সত্তর কিংবা আশির দশকে ঢাকার ফুটবলে একটা গল্প প্রচলিত ছিল। এক নতুন দর্শক গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছিলেন।

হঠাৎ প্রিয় দলের গোলে গলা ছেড়ে ‘গোওওল’ বলে চিৎকার করে উঠলেন। কিন্তু পড়ে গেলেন মহাবিপদে। আসলে না জেনেই তিনি বিপক্ষ দলের গ্যালারিতে বসেছিলেন। ব্যস, আর যায় কোথায়? লঙ্কাকাণ্ড।  

সেসময় কট্টর মোহামেডানের সমর্থকের ছেলের সঙ্গে কট্টর আবাহনীর সমর্থকের মেয়ের বিয়ের কথা চিন্তা করাও অনিয়মের মধ্যে পড়তো। বড় খেলার সময় আবশ্যিকভাবে ‘স্টেডিয়াম’ নামের একটা পত্রিকা বের হতো। খেলা শুরুর আগেই দশ হাজারের অধিক কপি কেবল গ্যালারির মধ্যে এবং বাইরে বিক্রি হয়ে যেতো। মফস্বল শহরের যুবকরা দল বেঁধে বাস রিজার্ভ করে ঢাকায় চলে আসতো খেলা উপভোগ করার জন্য।  

ফুটবলের সেই দিন আজ আর নেই। আজকের স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের কাছে সেগুলো ইতিহাসের কিছু ঘটনা মনে হতে পারে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো এমন দিন আসবে, যখন আমাদের তরুণ সমাজ আদৌ বিশ্বাস করবে না লাল-সবুজের এ দেশের ফুটবল ঐতিহ্যের কথা।

একটি খেলা দেখতে গ্যালারিতে দর্শকদের ঢল নামবে, লম্বা লাইন হবে, টিকিট কালোবাজারি হবে, লাইন ধরে গ্যালারিতে ঢুকতে গিয়ে ধাক্কাধাক্কি হবে, হুড়োহুড়ি হবে, চেঁচামেচি হবে, তবেই না ফুটবল দেখার আসল মজা। প্রকাশ পাবে খেলার প্রতি ভালোবাসা।

এক সময়ের তারকা ডিফেন্ডার কায়সার হামিদ গত ১৬ জুন বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত কলামে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা যখন মোহামেডানে খেলতাম, তখন ভয়ে ভয়ে মাঠে নামতাম। দুর্বল প্রতিপক্ষের বিপক্ষে পয়েন্ট হারানো মানে লঙ্কাকাণ্ড বেঁধে যাওয়া। চ্যাম্পিয়নের বদলে রানার্সআপ হলে সমর্থকরা উত্তেজিত হয়ে ক্লাব ভাঙচুর করতে আসতেন। ’ একটি উদাহরণ হিসেবে তিনি ১৯৮৬ সালে আবাহনীর বিপক্ষে খেলার পূর্ব মুহূর্তের অভিজ্ঞতায় বলেন, ‘খেলার আগের দিন সমর্থকরা হুমকি দিয়ে গেছে, জিততে না পারলে ক্লাবে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হবে না। মাঠে নামার আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ম্যাচে জিততে না পারলে ক্লাবে যাবো না। যে যার মতো নিরাপদ স্থানে চলে যাবো। ’

গত ২ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকে এক সময়ের দেশ সেরা লেফট উইঙ্গার আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নুর বরাত দিয়ে বলা হয়, ‘মানুষ ফুটবল দেখে না, এটা ঠিক নয়। দর্শকরা ফুটবলারের ব্যক্তিগত নৈপুণ্য দেখে। মেসি-নেইমার কী করলো তা দেখার অপেক্ষায় থাকে। ক্ষীপ্রগতির ফুটবলার সালাহউদ্দিন, পাওয়ার ফুটবলার এনায়েত, আসলামের সুন্দর হেড, মঞ্জু-টুটুলের ওভারল্যাপিং, অমলেস দা’র পরিশ্রমী ফুটবল- এগুলোই একসময় সাপোর্টার তৈরি করেছিল। মাঠে এসে ভালো গোল, ড্রিবলিং, ভালো পাস ও গোল গড়ে দেওয়ার দক্ষতা দেখতে চায় দর্শক। অথচ এখন সেরকম স্কিলড ফুটবলারের বড়ই অভাব। ’

বর্তমান সময়ে সারা দুনিয়ার খেলা পাগল মানুষ মেতে রয়েছে ফুটবল নিয়ে। হালের লিওনেল মেসি, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, নেইমার, লুইস সুয়ারেজ কিংবা গ্যারেথ বেলের কথা না হয় বাদই দিলাম, এখনও মানুষ যেভাবে ইউটিউবে পেলে, ম্যারাডোনা, জিনেদিন জিদান, মিরোস্লাভ ক্লোসার ফুটেজগুলো সার্চ করে, মনে হয় সার্থক ওই সকল ফুটবলারদের ফুটবল খেলা। আমাদের দেশের এখন যাদের বয়স ৪০ বছর বা তার ওপরে, তারা আসলাম, সালাম মুর্শেদী, কায়সার হামিদ, মোনায়েম মুন্না, সাব্বিরের অনেক খেলার অংশ এখনও যেভাবে ব্যাখ্যা করেন, মনে হয় গত সপ্তাহে হয়তো তারা সেই খেলা দেখেছেন।  

আসলে কি তাই? মানুষ হৃদয় দিয়ে উপভোগ করাতো আমাদের খেলোয়াড়দের ক্রীড়া নৈপুণ্য। বর্তমান তরুণ প্রজন্মকে যদি বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের নাম বলতে বলা হয়, আমার সন্দেহ হয়, কয়জনের নাম তারা বলতে পারবে। আমাদের নিম্নমানের ফুটবল খেলাই এজন্য দায়ী। এখানে অনেক সমস্যা বিদ্যমান। একদিনে এ সমস্যা তৈরি হয়নি। আর দিনে দিনে আমরা হারিয়ে ফেলছি আমাদের সেই ফুটবল ঐতিহ্য। রাতারাতি সেই ঐতিহ্য ফিরে পাবো, সেই আশা করাও বোকামি। তবে সমস্যার সমাধান সম্ভব। যারা ফুটবলকে ভালোবাসেন ঠিকই রাত জেগে রিয়াল মাদ্রিদ-বার্সেলোনা দ্বৈরথ উপভোগ করেন, কিন্তু দেশের ফুটবল দেখার মতো আগ্রহ নেই। আগে বাংলাদেশে একটিই চ্যানেল ছিল বিটিভি। মানুষের কাছে দ্বিতীয় কোনো বিকল্প ছিল না। বিটিভিতে কালেভদ্রে একটি খেলা সম্প্রচার হলে মানুষ সেই খেলা দেখতো সাগ্রহে।

কিন্তু এখন তো আর সেই অবস্থা নেই। ফুটবল বলতে আমাদের দেশের মানুষ এখন চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ কিংবা স্প্যানিশ লিগকে বুঝে থাকে। আর রিমোর্ট থাকে ইএসপিএন, টেন স্পোর্টস চ্যানেলগুলোর দখলে।  

যে মালদ্বীপ, নেপাল, ভুটানকে আমরা বেহিসাব গোল দিতাম, আজ আমরা তাদের কাছে হেরে যাচ্ছি। সেই খবরটাও এখন আমাদের খেলা পাগল মানুষের মনে দাগ কাটে না। সবাই যেন মেনে নিয়েছে আমাদের এই অধঃপতন। এক সময়ের বহুল আকাঙ্ক্ষিত ও প্রবল উত্তেজনাময় আবাহনী-মোহামেডান ফুটবল ম্যাচের আগের আবেদন এখন আর নেই। ম্যাচ হয় নীরবে-নিভৃতে, দর্শকশূন্য মাঠে। ঘরোয়া ফুটবলের প্রতি দর্শক অনেক আগেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এমনকি জাতীয় ফুটবল দলের খেলায়ও দর্শকদের আগ্রহ নেই।  

২০১৮ সালে রাশিয়ায় অনুষ্ঠেয় বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের আটটি খেলার মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় দল সাতটিতে পরাজিত এবং একটিতে ড্র করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এমন ম্যাচে শুধু পরাজয়ের স্বাদ নেওয়ার জন্য দর্শক মাঠে আসবে কেন? 

সবশেষে ইংলিশ লিগের লেস্টার সিটির উদাহরণ দিয়েই শেষ করতে চাই। দু’বছর আগেও দলটি ছিল দ্বিতীয় সারির দল। তিন কোটি পাউন্ডের কম খরচে গঠিত একটি দল, যেখানে বর্তমানে তারকা বনে যাওয়া ফরোয়ার্ড রিয়াদ মেহারাজ কিংবা মিডফিল্ডার এনগোলে কান্টেকে কেউ চিনতো না। অথচ ওই লিগের অনেক ক্লাব একজন খেলোয়াড়ের জন্যই তিন কোটি পাউন্ডের বেশি খরচ করে থাকে। গত মৌসুমে অল্পের জন্য অবনমনের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল ক্লাবটি। অথচ বাঘা বাঘা দলগুলোর মধ্য থেকে এবার কিনা সেই লেস্টার সিটি দলটিই চ্যাম্পিয়ন! 

ক্লাবের ১৩২ বছরের ইতিহাসে লেস্টার সিটি যদি এই অবস্থা থেকে উতরে পৃথিবীর সেরা ফুটবল লিগ চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, তবে আমরা কেন আমাদের খেলার উন্নতি ঘটিয়ে পুনরায় দর্শকদের মাঠে আনতে পারবো না? আমরা নতুন কিছু চাইছি না। গ্যালারি মাতানো দর্শক মাঠে ফেরত চাই। প্রয়োজন সঠিক কিছু পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন।



লেখক: উপ-পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক



বাংলাদেশ সময়: ২১১০ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০১৬
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।