ঢাকা, শনিবার, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৮ মে ২০২৪, ০৯ জিলকদ ১৪৪৫

মুক্তমত

আপনা মাংস হরিণা বৈরী

শামীম রুনা, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪২ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৫
আপনা মাংস হরিণা বৈরী

আব্বাকে আমার ভালো লাগত, তাঁর গায়ের গন্ধ ভালো লাগত; তিনি একজন পুরুষ ছিলেন, আমার ভাই একজন পুরুষ-  সে যখন সস্নেহে জড়িয়ে ধরে ভালো লাগে, আমার স্বামীকে আমার ভালো লাগে— আমার প্রেমের পুরুষ, আমার কিছু সংখ্যক বন্ধু এবং কিছু প্রিয় মানুষ পুরুষ-যাদের সান্নিধ্য আমার কাছে কাঙ্খিত। আমি তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে পছন্দ করি, ওদের সঙ্গে ঘুরতে বা কথা বলতে আমার ভালো লাগে, তাদের পাশে নিরাপদ বোধ করি।

কিন্তু পুরুষের মধ্যে যখন মুখোশ পরা কিছু পশু দেখি, তখন নিজের ভেতর এক ভয়ঙ্কর শীতলতা অনুভব হয়। আতংকে অসার হয়ে পড়ি। মনে প্রশ্ন ফেনিয়ে ওঠে, সব পুরুষরাই কি এমন? আমার প্রিয় পুরুষগুলো কেমন, এমন নয় তো? সব পুরুষ যে অমন নয় জানি, নারীদের চরম অবমাননার সময় পুরুষরাই তাদের সাহসী হাত বাড়িয়ে জানিয়ে দেয়, আমরা নারী-পুরুষ নই; আমরা মানুষ। আমার এই লেখায় আমি সেইসব পুরুষরূপী মানুষদের স্যালুট করি আর সেইসব পুরুষরূপী পশুদের ঘৃণা জানাই।
   
কয়েক বছর আগে, এক শবে বরাতের রাতে ছয় বছরের মেয়েশিশু আল্পনা এক লম্পটের হাতে পড়ে খুন হয়। সে তখনো মেয়ে বা নারী হয়ে ওঠেনি, কেবলই একটি শিশু। মৃত্যুর আগে ও যে নির্মম পৃথিবী দেখে গেছে, তা ভাবলেও সারা শরীর ভয়ে অসাড় হয়ে আসে। জেনির মত কিশোরীকে আমরা দেখি বিবর্ণ পাতার মত গাছের সঙ্গে ঝুলতে। তখনো পাশে পড়ে রয়েছে ওর চলার পথের প্রাণবন্ত সঙ্গী হলুদ সেন্ডেল জোড়া!

সিমি’র মৃত্যুর কয়েক বছর পর, একটি পত্রিকায় পড়েছিলাম; তখনো; সিমির রুমের আয়নার কোণে সেঁটে ছিল ওর ব্যবহৃত কয়েকটি টিপ। নিঃসন্দেহে টিপগুলো মানুষের চেয়ে ভাগ্যবান। ওরা নির্বাক, প্রতিবাদ করেনি বলে ওরা তখনো পৃথিবীর খানিক স্থান দখল করে রেখেছিল। সিমি বোকা’র মতো প্রতিবাদ করেছিল, তাই সে শুয়ে আছে মাটির হিম অন্ধকার কবরে। যারা সিমিকে মৃত্যু’র দিকে হাত ধরে এগিয়ে দিয়েছিল তারাও পৃথিবীতে চরে বেড়াচ্ছে। ক্লাশ ফোরের ছাত্রী তৃষ্ণাকেও (নামটা ভুল হতে পারে) বখাটেরা তাড়া করে পুকুরে ডুবিয়ে মেরেছিল। ক্লাশ ফোরের একটি মেয়ে, কতো আর বয়স হবে? তাকেও যদি নিজ সম্মান রক্ষায় পুকুরে ডুবে মরতে হয়; তাহলে সে লজ্জাটা কার?

এগুলো ১২০০ সালের কথা নয়, এই সময়ের কথা; এখন নারী পর্বত জয় করছে, মহাকাশ জয় করে মহাবিশ্বে বসতি গড়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু আমার দেশের নারী ঘর থেকে দু’পা ফেলে শিশির বিন্দু দেখতে গেলেও কেনো এতো ঝামেলায় পড়তে হয়? এই অবুঝ শিশু আর কিশোরি মেয়েগুলোর কি নির্মম আর অকাল সহমরণ শুধু মেয়ে হয়ে জন্ম নেবার কারণে! আমাদের দেশের নারীর গণ্ডি কি শরীর কাঠামোর শুদ্ধতা রক্ষায়ই আটকে থাকবে?

বয়সের একটা পর্যায়ে এসে নারীরা বুঝতে পারে কি করে হীন রুচির পশুদের এড়িয়ে চলতে হয়। তাও সব সময় পুরোপুরি পারে না। জীবনের শুরুতে নারী যখন মাত্র একটি শিশু থাকে, পৃথিবীর রুঢ়তা সম্পর্কে যখন একবারে অজ্ঞ, তখনও সুযোগ নিতে চায় অনেক মুখোশধারী পশু। আমাদের সমাজে খুব কম মেয়ের জীবনেই বড়রা সাহস জুগিয়ে বলে, ওদের লাথি মেরে চলার পথ থেকে সরিয়ে দিতে হয়। আমাদের সমাজ ব্যবস্থাটাই এমন এইসব ব্যাপারে বড়রা ছোটদের সঙ্গে কিছুই শেয়ার করতে চায় না। এই সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যেন অনৈতিক-নিষিদ্ধ।

অভিভাবকরা যদি একটু সচেতন হতেন। এসব কথা তারা যদি ছোটদের বুঝিয়ে বলেন, তাহলে দেখা যাবে ছোটরা নিজেদের  রুচিশীল মার্জিত ব্যক্তিত্ব যেমন তৈরি করে নিতে পারবে তেমনি নিজেদের নিরাপদে রাখতেও সক্ষম হবে। মুখোশের আড়ালে ঢাকা মানুষটির মনোভাবও বুঝতে পারবে। আর শৈশব বা কৈশোরের এইসব সমস্যা শুধু মেয়েশিশু বা কিশোরিদের একাই ফেস করতে হয় এমন নয়, অনেক ছেলেশিশু বা কিশোরকেও নানান সমস্যায় পড়তে হয়। তাই সব বিষয় ছেলে সন্তান মেয়ে সন্তান দু’জনের সঙ্গেই মা-বাবার সমান ভাবে শেয়ার করা প্রয়োজন।

আমার মনে আছে, আমার প্রথম পিরিয়ডের পর আমি আতংকিত হয়ে কেঁদেছিলাম। আমাকে এই ব্যাপারে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আমার মা আমার ইমিডিয়েট বড়ো বোনকে দায়িত্ব দিলে সে বিষয়টি এইভাবে বর্ণনা দিল, এবার আমার বাচ্চা হবে। আতঙ্ক কমার বদলে তাতে আমার আতঙ্ক আরো বাড়ল। এতটুকু বয়সে মা হবার আতঙ্কে আমি দ্বিগুণ জোরে কেঁদেছিলাম।   তারপরও কেউ বলেনি মেয়েদের জীবনে এটা স্বাভাবিক একটা প্রক্রিয়া। এরপর ক্লাশের পড়াশুনায় সব চেয়ে দুর্বল মেয়েটির কাছে একদিন জানতে পারলাম,  পিরিয়ড না হলে তুই তো সত্যিকারের মেয়ে হতে পারবি না! এত বছর পর বলছি— থ্যাংকস নৈনী। এই বিষয়টি মেয়েদের পাঠ্যবইয়ে যে ক্লাশে অন্তর্ভুক্ত সে ক্লাশে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অনেক মেয়ের পিরিয়ড হয়ে যায়। আবার অনেক স্কুলের মিসরাও এই বিষয়টি পড়াতে আগ্রহী না হয়ে চ্যাপ্টারটি উল্টে রেখে যায়।

শুধুমাত্র সেক্সসুয়াল হ্যারাসমেন্ট, ইভ টিজিং বা শারিরীক পরিবর্তনের কারণে জীবনের শুরুতে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয় তা ঠিক নয়, অনেক সময় অভিভাবকের প্রত্যাশার সঙ্গে শিশু-কিশোরদের পড়াশোনা, খেলাধুলা, ব্যবহার বা পছন্দের বন্ধুর সঙ্গে বন্ধুত্ব পরিবার মেনে না নিলেও ওদের মনে চাপ পড়ে, এই মানসিক চাপ ওদের চিন্তা-চেতনাকে অনেক সময় দারুণ বিপর্যস্ত করে তুলে যার জন্য বড়োরা প্রস্তুত  থাকে না।

আমার দুই মেয়ে, ধীরে ধীরে শিশু থেকে কিশোরী হয়ে উঠছে, আর আমার ভেতরে উঁইপোকারা কাটছে। মেয়েদের সব রকম নোংরামী থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব কি? কোনো রকম ভুল করা যাবে না ওদের ব্যাপারে। আমি আমার শৈশব-কৈশোরে অনেক রকম সাপোর্টের অভাব বোধ করেছি তাই সব রকম  সাপোর্ট ওদের দেবার চেষ্টা করি নিরন্তর। গল্পের ছলে, বন্ধুত্বের কন্ঠে ওদের শরীরেরর প্রাইভেসি বুঝাতে চেষ্টা করি। হাসতে হাসতে বলি শারিরীক বৃদ্ধি-পরিবর্তনের কথা। হিউম্যান বডির আলাদা স্ট্রাকচারের কথা বলি। কারোকে হুট করে ভালো লাগার কথা বলি-- জানি না আমি ভুল কিনা। চেষ্টা করি ওদের নিজেদের অধিকার দায়িত্ববোধের বিষয় বুঝাতে। ওদের বলি জীবনে যত রকম ঝামেলাই আসুক ওরা যেন কোনো কিছু না লুকিয়ে আমাদের সাথে শেয়ার করে। মা-বাবা কখনো হয়ত রাগ করতে পারে তারপরও সব সময় আমরা ওদের পাশে থাকবো- এই আশ্বাস টুকু দেবার চেষ্টা করি। চাই ওরা স্বাধীন ভাবে পরিচ্ছন্ন মন নিয়ে বেড়ে উঠুক। ওরা এখনও বেশ ছোট, আমি বুঝি না; ওরা আমার কথা কতটুকু বুঝে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪২ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।