ঢাকা, মঙ্গলবার, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২১ মে ২০২৪, ১২ জিলকদ ১৪৪৫

মুক্তমত

রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

এ কে এম ওবায়দুর রহমান | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৫
রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের প্রায় পুরোটা সময় কেটেছে সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি অর্জন করেছেন অসংখ্য সাফল্য, যার চূড়ান্ত প্রাপ্তি বাংলাদেশ।

যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের কাজ তাঁর হাত দিয়েই শুরু হয়েছিল। পাশাপাশি বিশ্বের বুকে বাংলাদেশকে মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা এবং বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি লাভের মতো অর্জনগুলো এসেছিল শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও তিনি নতুন দেশের নানা সমস্যা মোকাবেলা করেছিলেন দূরদর্শী রাজনৈতিক চেতনা, স্বভাবসুলভ মেধা ও  প্রজ্ঞা দিয়ে। ধর্মের নামে পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর শোষণের শিকার বাঙালির মুক্তির জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যেই দেশে একটি সংবিধান প্রণয়ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের মাধ্যমে।

অবিভক্ত ভারত থেকে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৮ বছর তিনি আন্দোলন করেছেন শোষণ, বৈষ্যম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে। নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে তিনি ছিলেন আপোষহীন। যেখানেই শোষণ ও বৈষম্য সেখানেই অধিকারহীনদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এ কারণে নদীবেষ্টিত গোপালগঞ্জের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্মগ্রহণ করেও তিনি হয়ে উঠেছেন এ উপমহাদেশের শীর্ষ রাজনীতিবিদের একজন। শুধু তাই নয়, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মহাত্মা গান্ধী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শামসুল হকের মতো সর্বজনবিদিত নেতাদের সাহচর্য পাওয়া এ নেতার পরিচিতি ছিল বিশ্বব্যাপী।
 
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে জানা যায়, সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তিনি যোগ দিয়েছিলেন স্বদেশী আন্দোলনে। এরপর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মোকাবেলা, দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের খাদ্য ও বস্ত্র সংস্থান এবং গরিব ছাত্রদের লেখাপড়ার সুব্যবস্থা ও পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে তাঁর ছিল স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। রাজনীতি ছিল তার রক্তধারায় মজ্জাগত। তাই শৈশব থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। স্কুলছাত্র অবস্থায়ই তিনি অধিকারের লড়াইয়ে লিপ্ত ছিলেন। ১৯৩৯ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের সান্নিধ্যে এসে প্রত্যক্ষ রাজনীতি শুরু করেন বঙ্গবন্ধু। এ সময় গোপালগঞ্জে গঠন করেন মুসলিম ছাত্রলীগ এবং তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সেই সময়কার ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। প্রচণ্ড জনপ্রিয় এ নেতা একদিকে যেমন ভালো সংগঠক ছিলেন, অন্যদিকে ছিলেন এক অসাধারণ বক্তা। অনলবর্ষী বক্তৃতা দিয়ে তিনি সভা সমাবেশে মানুষকে আকৃষ্ট ও প্রভাবিত করতে পারতেন গভীরভাবে। আন্দোলন ও সংগ্রামে নেতৃত্ব প্রদান তাঁর সহজাত গুণ হলেও একজন নিবেদিত রাজনৈতিক কর্মী হিসেবেও তাঁর সুখ্যাতি ছিল। অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারতেন বঙ্গবন্ধু। দিনের বেলা সাংগঠনিক কাজ আর রাতের বেলা রাজনৈতিক পাঠ গ্রহণ করেছেন দিনের পর দিন। রাজনৈতিক কাজে তাঁর ক্লান্তি ছিল না।

পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বাঙালির প্রতি পাকিস্তানি শাসকদের নিপীড়ন ও বৈষ্যমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, মাতৃভাষা রক্ষার জন্য ভাষা আন্দোলন, তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনসহ বাঙালির সামগ্রিক মুক্তির জন্য ছয় দফা ও অসহযোগ আন্দোলন এবং ১৯৭০ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক আইনসভায় আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রভৃতি অর্জনগুলোর বেশিরভাগই অর্জিত হয়েছিল তাঁর নেতৃত্বে। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে তার সভাপতিত্বে ১৯৪৮ সালের ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। ভাষা আন্দোলন ও শোষিত বাঙালির পক্ষে কথা বলতে গিয়ে তাকে বাববার কারাবন্দি হতে হয়েছে। দিনের পর দিন বিনা বিচারে কারাবন্দি রাখা হলেও আন্দোলন থেকে একবিন্দুও সরে আসেননি তিনি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেলে বসেই অনশন করেছেন। সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের আমলে আন্দোলন ও সংগ্রাম থেকে সরে আসার শর্তে মুক্তিলাভের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন ঘৃণাভরে। ঐতিহাসিক আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে বন্দি শেখ মুজিব প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় পরবর্তী সময়ে জনগণ তাকে কারাগার থেকে ছিনিয়ে এনেছিল। জনগণের প্রতি তার আস্থা ছিল অত্যন্ত দৃঢ়। অগ্নিঝরা আন্দোলনের এক পর্যায়ে ১৯৬৯ সালে এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার নামকরণ করেছিলেন ‘বাংলাদেশ’।

বাঙালি জাতির চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ডাক দিলে মিথ্যা আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা দেয় পাকিস্তানি শাসকরা। ওই সময় তাকে দমিয়ে রাখতে পাকিস্তানের কারাগারে সেলের ভেতরেই খোঁড়া হয়েছিল কবর। তবু বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব থেকে বঙ্গবন্ধু পিছপা হননি। নীতিতে ছিলেন অটল। বাঙালির মুক্তির জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন তিনি। পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ যখন জমিদার, জোতদার, ব্যবসায়ী ও নবাবদের প্রতিষ্ঠান হয়ে পড়ে, যখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি চরম বিমাতাসুলভ ও বৈষম্যমূলক আচরণ করতে থাকে মুসলিম লীগ, সে সময় বাধ্য হয়ে প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ থেকে তিনি বেরিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্নেই যুক্ত হন দলের সঙ্গে। পরবর্তী সময়ে তাঁর বলিষ্ট নেতৃত্ব, সংগ্রাম ও আন্দোলনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে তিনি সাধারণ জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত  করেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কণ্ঠস্বরে পরিণত করেন আওয়ামী লীগকে। এক পর্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে মহানায়কে পরিণত হন শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালে স্বনামধন্য বিদেশি সংবাদ মাধ্যম নিউজউইক শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে যথার্থ মূল্যায়ন করেছে। ম্যাগাজিনটি শেখ মুজিবকে ‘poet of politics’ উপাধি দেয়। এছাড়া, বিবিসি বাংলা জরিপে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তালিকায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন মানুষের ভোটে। কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেছেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসিকতায় তিনি হিমালয়ের মতো’।

লেখক: এ কে এম ওবায়দুর রহমান
দফতর সম্পাদক, ঢাকা সাব-এডিটরস কাউন্সিল
ইমেইল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ০৬৫০ ঘণ্টা, মার্চ ১৭, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।