ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

অবরোধে হত্যাকে ‘নিয়তি’ বলে মানবো কেন || হাসান মামুন

বিশ্লেষণ/মুক্তমত | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৫
অবরোধে হত্যাকে ‘নিয়তি’ বলে মানবো কেন || হাসান মামুন ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম/ফাইল ফটো

এ নিবন্ধ তৈরির দিন ২০ জানুয়ারি, মঙ্গলবার—দেশে কম সহিংসতা হয়েছে বলে ধরে নেয়া যাবে না যে, এটা কমে আসবে। অবরোধ চালিয়ে গেলে তাতে সহিংসতা আরও বাড়তে পারে।

গত বছরের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন ঠেকাতে যে আন্দোলন হয়েছিল, তাতে সহিংসতা হয়েছিল এর চেয়ে বেশি। সেটি ব্যর্থ হওয়ার পর নতুন করে যে সরকার গঠিত হয়েছে, তারা কি বের করতে উদ্যোগী হয়েছেন—ওই সময়কার সহিংসতাগুলো কারা করেছিল? পরিস্থিতি সামলে রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরে আসতে পেরেই তারা বোধহয় সন্তুষ্ট। কিন্তু নতুন মেয়াদের একটি বছর পেরোতে না পেরোতেই আবারও একটি সহিংস আন্দোলনের মুখে পড়েছেন তারা। চরিত্রের দিক থেকে এটা আগেরটার মতোই। মাত্রাগত তফাৎ হয়তো রয়েছে। বলা যায় না, আন্দোলনে সহিংসতা আরও বেড়ে গেলে তা নতুন রেকর্ডও গড়তে পারে।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিরোধী দলের সব আন্দোলনেই সহিংসতা হয়েছে। তাদের ওপর পাল্টা সহিংসতাও করেছে সরকার পক্ষ। আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ার পরও দমন-পীড়ন বেড়ে উঠতে দেখা গেছে। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনেও কিছু সহিংসতা হয়েছিল। আরও বেশি সহিংসতা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। হরতাল-অবরোধ ধরনের কর্মসূচি পালনের প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে বৈকি। ক্রমে এগুলো হয়ে উঠেছে জবরদস্তিমূলক কর্মসূচি। স্বাধীনতার আগে হরতাল পালনে মানুষকে অনুরোধ করা হতো; এখন ভাঙচুর, বোমা মারা, আগুন দেয়া প্রভৃতি হয়। আগে রেললাইন আটকে দেয়া হতো অবরোধে; এখন তা উপড়ে দুর্ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা হয়। সড়ক কেটে ‘পরিখা’ তৈরির কাণ্ডও আমরা দেখেছি সাম্প্রতিককালে। বিএনপি-জামায়াতের হরতালে অনেক বেড়ে গেছে চোরাগোপ্তা হামলা আর তাতে পেট্রল বোমার ব্যবহার। রাস্তায় বের হওয়া নিরীহ মানুষ তো বটেই, পুলিশও এতে দগ্ধ হচ্ছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক হলো শিশুদের আক্রান্ত হওয়া।

ভালো হতো, হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস হয়ে পড়া কর্মসূচির বাইরে রাজনীতিকে নিয়ে যেতে পারলে। সে চেষ্টা আমরা করি নি, বরং সহজে পালনযোগ্য এসব কর্মসূচি বেশি করে আঁকড়ে ধরেছি। সংগঠন দুর্বল হলে আর সেক্ষেত্রে সরকারকে চাপে ফেলতে এমনতরো কর্মসূচি-নির্ভরতা আরও বাড়ছে মনে হয়। হরতাল-অবরোধ কার্যকর করতে দলের বা ভাড়া করা একদল সন্ত্রাসী টাইপের লোককে ইট-পাটকেল, ককটেল আর বেশি করে পেট্রল বোমাসহ নামিয়ে দিলেই হয়ে গেলো। ‘আন্দোলন’ বলতে না চাইলে না বলুন; কিন্তু এটা করে তো পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা এবং সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে। সরকারকে চাপে ফেলাই যদি উদ্দেশ্য হয়, সেক্ষেত্রে তো তারা সফল!

হরতাল-অবরোধকারীরা আবার দাবি করছেন, তারা ‘শান্তিপূর্ণ’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। সুতরাং সহিংসতা বা নাশকতা কিছু হলে তা করছে সরকারপক্ষীয় লোকজন। সেটা নাকি করা হচ্ছে বিরোধী দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট বা আন্দোলনে কালিমা লেপন করতে। ‘অবরোধমুক্ত’ হয়ে বিএনপি নেত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে এটা জোর দিয়ে বলেছেন। আশ্চর্যজনক হলো, এজন্য তিনি পুলিশকেও দায়ী করেছেন। হয়তো বোঝাতে চেয়েছেন, পুলিশের লোকজন সরকারের নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে।

পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাগুলো নিশ্চয়ই পুলিশ ঘটাচ্ছে না? বিএনপি বা জামায়াতের মিছিল থেকে এসে পুলিশকে রাস্তায় ফেলে পেটানো বা তার হাতিয়ার কেড়ে নেয়ার ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটাচ্ছে না সরকারপক্ষীয়রা? রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিঘ্নিত করে তারা নিশ্চয়ই নিজেদের সরকারকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ব্যর্থ প্রতিপন্ন করছে না? সরকার এতো বোকা নয়। যুক্তির খাতিরে না হয় ধরে নেয়া গেলো, সরকারের লোকজন নাশকতার কিছু ঘটনা ঘটাচ্ছে বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপাতে। কিন্তু সব ঘটনাই তারা ঘটাচ্ছে, এমন বক্তব্য বেগম জিয়ার সমর্থকরাও বোধ হয় বিশ্বাস করবেন না। মিডিয়া এ বিষয়ে যেসব খবর প্রচার করছে, সেগুলো কি তাহলে মিথ্যা? বিরোধী দল সমর্থক মিডিয়াও কিন্তু কম নেই। দেশে রয়েছে দলনিরপেক্ষ মিডিয়া। আন্তর্জাতিক মহলগুলোর কাছেও এখানে ঘটে চলা ‘আন্দোলন’ সম্পর্কে তথ্য রয়েছে। তারা তো আর এমনি-এমনি সহিংসতা এড়ানোর আহ্বান জানাচ্ছেন না। সহিংসতার জন্য কিন্তু তারা সরকারকে দায়ী করছেন না। দায়ী করছেন এমন পরিস্থিতি সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখার জন্য এবং সহিংসতা রোধে ব্যর্থ হওয়ায়।

সহিংসতা বা নাশকতা যাই বলি না কেন, তা থেকে সাধারণ মানুষ ও অর্থনীতিকে নিরাপদ রাখাটা সরকারের দায়িত্ব। এ লক্ষ্যে তারা শুধু বিজিবি কেন, ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে সেনা সহায়তাও নিতে পারেন। বিজিবি, পুলিশ ও র‌্যাবপ্রধান এর মধ্যে সহিংসতা মোকাবেলায় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। তাদের ভাষা ও ভঙ্গি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে; কিন্তু মনোভাব ইতিবাচক। গোটা প্রশাসনের ওপর সরকারের যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, এটা বোঝা যাচ্ছে তাদের বক্তব্যে। সরকার তাহলে এদের বলিষ্ঠভাবে ব্যবহার করুক সহিংসতায় লিপ্তদের বিরুদ্ধে। এ ধরনের কম লোকই হাতেনাতে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছে। তারা আবার টোকাই প্রকৃতির। তবে অল্প টাকায় এরাও নিরীহ বাসযাত্রী বা ট্রাকচালককে পুড়িয়ে মারতে সক্ষম। বাসে গান পাউডার ছিটিয়ে একসঙ্গে অনেক মানুষকে কয়লা বানিয়ে দেয়ার ঘটনাও নিকট অতীতে রয়েছে। এর ‘রহস্য’ উন্মোচিত না হওয়াটাও একটা রহস্য। বড় একটি নাশকতারও রহস্য কি উন্মোচিত হয়েছে?

শুরুই তো করলাম এটা বলে যে, ৫ জানুয়ারির আগে সংঘটিত ভয়াবহ নাশকতার জন্য কতোজন চিহ্নিত হয়েছে? বিচার প্রক্রিয়া শেষে উপযুক্ত সাজা নিশ্চিত করা তো পরের ব্যাপার। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান সম্প্রতি রাজধানীতে বার্ন ইউনিট পরিদর্শন শেষে মন্তব্য করেছেন— ওইসব ঘটনার জন্য শাস্তি হলে নতুন করে সহিংসতা ঘটতো না। এতোটা নিশ্চিত করে বলা হয়তো যাবে না। তবে তার কথার ‘স্পিরিট’ বুঝতে হবে। তদন্ত ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি অপরাধকে আরও বিস্তৃত করে ফেলে। মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী বললেন, এটা আন্দোলন নয়, জঙ্গিবাদ। যেকোনো মূল্যে এটা দমন করা হবে। সত্যি বলতে, বিএনপির দাবিতে যৌক্তিকতা থাকলেও থাকতে পারে; কিন্তু আন্দোলনে নাশকতার কোনো যুক্তি নেই। কিন্তু নাশকতা হচ্ছে, এটা হলো বাস্তবতা। এমনটা হয়ে এসেছে এবং বেড়ে বেড়ে, নিত্যনতুন মাত্রা যোগ হয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।

দু’পক্ষ মুখোমুখি হয়ে গোলাগুলি ও লাঠালাঠি, সেটাও না হয় মেনে নেয়া যায়। কিন্তু নিরীহ যাত্রী, চালক, হেলপার ও স্কুলছাত্রের ওপর পেট্রল বোমা হামলা—এটা নির্জলা সন্ত্রাস। এটা ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ বলেও বিবেচিত হওয়ার যোগ্য। এক অর্থে তার চেয়েও বেশি। কারণ এখন তো আনুষ্ঠানিক কোনো যুদ্ধও চলছে না।

বিএনপির নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলন কবে কী অর্জন করবে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। এজন্য সরকারকে দায়ী বা একে রাজনৈতিকভাবে সমর্থনও করা যাবে হয়তো। কিন্তু দেশের নানা স্থানে, বারে বারে নিরীহ মানুষের ওপর যা চলছে, তার বিহিত হতে হবে। বিরোধী দলের রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার আন্দোলনে এতো মানুষের করুণ মৃত্যু, এতো নিরাপত্তাহীনতা, ভীতি আর অসহায়ত্বকে স্বাভাবিক বলে নেয়া যাচ্ছে না। তাই অন্তত বড় কয়েকটি সহিংসতা বা নাশকতামূলক ঘটনার তদন্তে একটি উপযুক্ত কমিশন গঠিত হোক। প্রয়োজনে (এবং সম্ভব হলে) এতে যুক্ত হোক জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন। নইলে বিরোধী দল বলবে, আমাদের কাবু করতেই এসব হচ্ছে।

এর পাশাপাশি রাজনৈতিক বিরোধ নিষ্পত্তিতে সংলাপেও এগিয়ে যেতে পারে সরকার। রাজনীতিতে সঙ্কট তো রয়েছে। কিন্তু এর নিষ্পত্তিতে নিরীহ মানুষ কেন আক্রান্ত হতে থাকবে? আর একে আমরা মনে করবো নিয়তি?




লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট



বাংলাদেশ সময়: ১৫১৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২১, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।