ঢাকা, শুক্রবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৭ মে ২০২৪, ০৮ জিলকদ ১৪৪৫

মুক্তমত

বিশ্বসমাজ কি কখনো সভ্য হবে না?

সুমি খান, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৪
বিশ্বসমাজ কি কখনো সভ্য হবে না?

ঢাকা: ভীষণ উদ্বিগ্ন হৃদয়ে এই লেখাটি লিখতে বসলাম। ইউনিসেফের সর্বশেষ তথ্য পেয়ে তাৎক্ষণিক এই লেখার অবতারণা।

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০ জন মেয়ের মধ্যে একজন যৌন নির্যাতনের শিকার। ছেলে শিশুরাও নিয়মিত যৌন নির্যাতনের শিকার। শুধু ২০১২ সালেই ৯৫ হাজার শিশু ও কিশোর-কিশোরী খুন হয়েছেন, যার বেশিরভাগ ঘটেছে ল্যাটিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয় দ্বীপপুঞ্জে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এ ঘটনা বেড়ে চলেছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বিশ্বের কোনো কোনো দেশে শিশুর প্রতি সহিংস আচরণ সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য।
জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের প্রতিবেদনের মাধ্যমে এই ভয়াবহ তথ্য যে কোনো সুস্থ, চিন্তাশীল মানুষকে উদ্বিগ্ন করবে। বিশ্বের ১৯০টি দেশের তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইউনিসেফ।

একথা সত্য যে, তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশে আমরা অনেক বেশি শঙ্কিত এবং উদ্বিগ্ন থাকি। কিন্তু বিশ্বের প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন নারী বা একটি শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার- এমন বাস্তবতা মেনে নেওয়া আসলেই কঠিন।

এ সমাজ, সভ্যতা সামনের দিকে এগুচ্ছে না? সমাজের বা পরিবারের কোনো মেয়ে বা শিশুকে যৌন নির্যাতন করে বিকৃত রুচির প্রকাশ ঘটাচ্ছেন এই সমাজেরই  অনেক ব্যক্তি। এদের অনেকেই সমাজের মুখোশধারী। যাদের বিকৃত লালসার শিকার হচ্ছে নিরীহ নারী এবং শিশুরা।

বিশ্বজুড়ে  প্রতি ১০ জন মেয়ের মধ্যে একজন যৌন নির্যাতনের শিকার হন এবং শিশুরা নিয়মিতভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। ছেলে শিশুরাও নিয়মিত যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। সেই পরিসংখ্যান তুলনামূলকভাবে কম পাওয়া যায়। ইউনিসেফের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী ২০ বছর বয়স নাগাদ ১২ কোটি মেয়ে ধর্ষিত বা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি লেক বলেন, সমাজের সব পর্যায়ের শিশুই সহিংসতার শিকার হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থান, ধর্ম, নৃতত্ত্ব ও পরিবারের আয় কোনো কিছুই তা আটকাতে পারেনি।

‘ঘর, স্কুল ও লোকালয় যেখানে শিশুরা নিরাপদে থাকবে সেখানেই এটা ঘটছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এ ঘটনা বেড়ে চলেছে এবং পরিবারের সদস্য, শিক্ষক, প্রতিবেশী, অপরিচিত ও অন্য শিশুরা এ নিপীড়ন করছে। ’

এই সমীক্ষায় দেখা গেছে, দুই থেকে ১৪ বছরের শিশুদের ১০ জনের ছয় জনকেই নিয়মিতভাবে তাদের পরিচর্যাকারীর কাছে শারীরিক শাস্তি পেতে হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো কোনো দেশে শিশুর প্রতি সহিংস আচরণ সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য। আবার অনেক সময় শিশুরা ভয়ে নিপীড়নের কথা প্রকাশ করে না।

প্রশ্ন আসে, বিশ্বের নানা প্রান্তে এনজিও এবং দাতা সংস্থাসমূহের বিশাল অংকের অর্থের বিনিময়ে প্রচার-প্রচারণা, সচেতনতার যে বহর আমরা দেখতে পাই- সেসবের কিছুই কি তাহলে কাজ করছে না? বাংলাদেশের চিত্র আমরা সংবাদকর্মীরা জানি। ব্যাঙের ছাতার মতো মানবাধিকার সংগঠন, নারী অধিকার সংগঠন তো আছেই। অনেক ঐতিহ্যবাহী  নারী সংগঠনও আছে, যেসব সংগঠন এখন দাতাসংস্থার মিলিয়ন ডলারের খাতায় বন্দি। কাজীর গরু তাদের কেতাবে আছে বটে, গোয়ালে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।
 
গোয়ালে আর গরু কৈ? গোয়াল-ই যে নেই। কেতাবের স্তুপ আছে, কেতাবি বাণী আছে। মানবাধিকার সংস্থার নেতানেত্রীরা টেলিভিশন টকশো-তে থাকেন বটে। নারী অধিকার যে এখন যাদুর বাক্সে বন্দি! তৃণমূল পর্যায়ের সংগঠকদের মধ্যে প্রবীণদের অনেককেই আজ অর্থের মূল্যে কেনা যায় না। তাই চরম বিপত্তি। সেক্ষেত্রে যাদের কেনা যাবে- তারাই এসব সংগঠনের কাজকর্মে থাকছেন। নারী অধিকার এবং শিশু অধিকার রক্ষায় সচেতনতা বাড়ানোর কোনো আন্তরিক উদ্যোগ কোথাও দেখা যায় না। কী করে সমাজে নারী-শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে?
 
মেয়ে শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং ছেলে শিশুদের যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কর্মসূচি জরুরি। এ ব্যাপারে সামাজিক সংগঠনগুলোর দায়বদ্ধতা বাড়াতে হবে।

সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে ইউনিসেফের এই প্রতিবেদনে। বিশ্বের প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজন মনে করে শিশুদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হলে শারীরিক শাস্তি অপরিহার্য। শারীরিকভাবে নিগৃহীত হলে যে কোনো শিশু মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ে। অভিভাবকদের এতোটা অসচেতনতা কেন? কেন তারা তাদের সন্তানদের বেদনা বুঝতে পারেন না? নিগৃহীত শিশুরা কখনো মানসিক দৃঢ়তা নিয়ে গড়ে উঠবে না।

আরেকটি বিষয় ইউনিসেফের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ১৫ থেকে ১৯ বছরের অনেক মেয়ে মনে করে কখনো কখনো স্ত্রীদের প্রহার করা নাকি স্বামীদের জন্যে যৌক্তিক।
 
দুর্ভাগ্য আর কাকে বলে? নিজেদের মানুষ বলে ভাবতেও ভুলে গেছে এই মেয়েরা? ইন্টারনেট সারাবিশ্বকে মানুষের হাতের কাছে এনে দিলেও একথা কি সত্য- নেতিবাচক ঘটনাগুলোতে উৎসাহিত করা থেকে মানুষকে এখনো বিরত রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে বিশ্বসমাজ? এর শেষ কোথায়?
 
বিপন্ন এই পরিস্থিতি প্রতিরোধে সমাজের সুধীজনদের এগিয়ে আসতে হবে। তা না হলে অনেক বড় বিপর্যয় নেমে আসতে পারে- যার দায় আমরা কেউ এড়াতে পারি না।

লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, দৈনিক জনকন্ঠ

বাংলাদেশ সময়: ২১০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৫, ২০০১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।