বিগত ষোলো বছরে কর্তৃত্ববাদী শাসনের উত্থান ও নাগরিক অধিকার সংকোচনের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ এক গভীর রাজনৈতিক অন্ধকারে ঢুকে পড়েছিল। হয়রানি, নিপীড়নের শঙ্কার আবহে যখন অধিকাংশ মানুষ নীরবতা বেছে নিয়েছিল, তখন দেশি এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো দাঁড়িয়েছিল দৃঢ়ভাবে—যারা শাসকের রোষের মুখে সত্যের পক্ষে অবিচল থেকেছে।
নিরঙ্কুশ দমন-পীড়নের আবহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চিহ্নিত হওয়ার আগেই বাংলাদেশে ক্রমাগত স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। ২০১০ সালের জুন মাসে বিএনপি-সমর্থিত ঢাকা সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মোহাম্মদ চৌধুরী আলম নিখোঁজ হয়ে যান—এটি ছিল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নিখোঁজ হওয়ার প্রথম দিককার একটি উদাহরণ। তবে পুরো জাতির বিবেক নাড়া দিয়েছিল ২০১২ সালে বিএনপির প্রভাবশালী নেতা ইলিয়াস আলীর রহস্যজনক অন্তর্ধান। এই ঘটনাটি ছিল রাষ্ট্রীয় নিষ্ঠুরতা এবং জবাবহীনতার প্রতীক— দীর্ঘ কালো অধ্যায়ের সূচনা।
২০১৩ সালের ৫ মে রাতে হাজার হাজার হেফাজতে ইসলামের কর্মী ও সমর্থক ঢাকার মতিঝিলে শাপলা চত্বরে জমায়েত হন। এই রক্ষণশীল ইসলামি সংগঠনটি ধর্মীয় মূল্যবোধ রক্ষার দাবিতে ১৩ দফা দাবি উপস্থাপন করে। আন্দোলনটি জন্ম নেয় একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে—যেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে ইসলামবিদ্বেষ বাড়ছিল। সেই রাত পরিণত হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়ংকর এক কালো অধ্যায়ে। গভীর রাতে র্যাব-পুলিশের সমন্বয়ে চালানো অভিযানে অসংখ্য আলেম এবং এতিমের মৃত্যু ঘটে। এই ভয়াবহ দমন-পীড়ন পরবর্তীতে পরিচিত হয় ‘শাপলা চত্বর গণহত্যা’ নামে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই ঘটনায় একটি স্বাধীন তদন্তের দাবি তোলে। স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা অধিকার তাদের প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যা ৬১ জন বলে উল্লেখ করে, যা সরকারি সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি। এর পরিণতি ছিল ভয়াবহ: ‘অধিকার’ সম্পাদক আদিলুর রহমান খানকে গ্রেপ্তার করা হয়, অফিসে অভিযান চালানো হয়। পরে ‘অধিকার’র এনজিও নিবন্ধন বাতিল করা হয়—এটি ছিল সত্য প্রকাশের জন্য স্বৈরাচারী হাসিনার প্রতিশোধ।
এরপর আসে ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাস—বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এই নির্বাচন বর্জন করে, যার ফলে ৩০০টি আসনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি। নির্বাচনের দিনজুড়ে সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ এবং ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগ ওঠে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থাগুলো নিরপেক্ষতার অভাবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ থেকে বিরত থাকে। নির্বাচনের পরপরই মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং বাংলাদেশের স্বনামধন্য সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এই প্রক্রিয়াকে ‘ভোটারবিহীন ও গণতন্ত্রবিরোধী’ বলে আখ্যায়িত করে। এর প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয় এক নোংরা প্রতিহিংসার রাজনীতি—সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করা হয়, কর্মীদের হয়রানি করা হয় এবং প্রশাসনিক জটিলতার মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম সীমিত করা হয়।
২০১৮ সাল। দেশের ইতিহাসে ছাত্র আন্দোলনের নতুন জোয়ার আসে—প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলন, পরে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা প্রথমে সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির পরিবর্তে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগের দাবি তোলে। এরপর, একটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় দুই স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যু সারা দেশের শিক্ষার্থীদের রাস্তায় নামিয়ে আনে। দুটি প্রতিবাদ শুরু হয়েছিল শান্তিপূর্ণভাবে, কিন্তু তা দ্রুত রূপ নেয় একটি সর্বজনীন আন্দোলনে।
কর্তৃত্ববাদী সরকারের প্রতিক্রিয়া ছিল বরাবরের মতোই সহিংস—টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট এবং গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে আন্দোলন দমন করা হয়। কিন্তু যেটা সবচেয়ে বেশি শঙ্কা জাগিয়েছে, সেটি হলো ‘হেলমেট বাহিনী’ নামক একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসীর প্রকাশ্য সহিংসতা। লাঠি ও রড হাতে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায়, তারা শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, এমনকি চিকিৎসকদেরও প্রকাশ্য দিবালোকে আক্রমণ করা শুরু করে। তবুও অধিকার, আসক, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা নির্ভীকভাবে নিপীড়নের তথ্য সংগ্রহ করে এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেয়।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচন, যা পরবর্তীতে ‘রাতের ভোট’ নামে কুখ্যাতি পায়, বাংলাদেশের ইতিহাসে গণতন্ত্র হত্যার স্মারক হয়ে থাকে। বিরোধী দল, বিশেষ করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে গিয়ে ভয়াবহ বাধার সম্মুখীন হয়। নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার, মিছিল-মিটিংয়ে বাধা, এমনকি হামলা—সবই ছিল পূর্বপরিকল্পিত। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৩০ ডিসেম্বর, তবে অনেক কেন্দ্রেই ব্যালট বাক্স পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল আগের রাতেই—অভিযোগ ওঠে, ভোটগ্রহণ শুরুর আগেই ফল নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।
ভোটের দিন সহিংসতা, কারচুপি এবং ভোটারদের ওপর চাপ প্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। অনেক কেন্দ্রে স্বাধীন পর্যবেক্ষকদের ঢুকতেই দেওয়া হয়নি, আবার কোথাও কোথাও তাদের ভয় দেখিয়ে বের করে দেওয়া হয়। এই প্রহসনের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিন্দা জানায়। নির্বাচনকে তারা ‘অবাধ বা সুষ্ঠু নয়’ বলে ঘোষণা করে।
তবে দমন-পীড়ন এখানেই থেমে থাকেনি। নির্বাচন শেষে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ বিভিন্ন দমনমূলক আইনের মাধ্যমে সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী এবং বিরোধী মতাবলম্বীদের ওপর নেমে আসে দমনযন্ত্রের করাল ছায়া। এই আইনের আওতায় একটি নতুন ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ গড়ে ওঠে—যেখানে সত্য বলাও অপরাধ হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে আইনি নিপীড়নের চেহারা কুৎসিত হয়েছে একাধিক ধারাবাহিক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে। এর শুরু ২০০৬ সালের আইসিটি অ্যাক্ট-এর ৫৭ ধারার মাধ্যমে, যা পরবর্তীতে রূপ নেয় ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (DSA) এবং সবশেষে ২০২৩ সালে আসে তার নতুন রূপ—সাইবার নিরাপত্তা আইন (CSA)। সরকার এগুলোকে সাইবার অপরাধ ও গুজব দমনের হাতিয়ার হিসেবে তুলে ধরলেও বাস্তবে এই আইনগুলো পরিণত হয়েছে মতপ্রকাশ ও ভিন্নমত দমনের অস্ত্রে।
২০১৮ সাল থেকে ২০২৩ সালের শুরুর দিক পর্যন্ত শুধুমাত্র ডিএসএ-র অধীনে দায়ের হয় ৭,০০০-এর বেশি মামলা। প্রতিবছর শত শত মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছে এই আইনের আওতায়। একটি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২০–২১ সালের মধ্যে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের প্রায় ৩০ শতাংশ ছিলেন সাংবাদিক এবং ২৫ শতাংশেরও বেশি ছিলেন রাজনৈতিক কর্মী। এই আইনের প্রয়োগে কিছু ঘটনা জাতিকে হতবাক করেছে এবং আন্তর্জাতিক মহলে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
বিশ্ববিখ্যাত আলোকচিত্রী শাহিদুল আলম ২০১৮ সালের আগস্টে আল জাজিরায় সাক্ষাৎকারে সরকারের সমালোচনা করার পর গ্রেপ্তার হন। তিনি জেলে থাকেন একশ দিনেরও বেশি এবং পরে জানান, সেখানে তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
২০২০ সালে কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হন। তিনি জেলে কাটান দশ মাস—এবং মুক্তির পর জানান, তাঁকে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। তাঁর সহ-আসামি, লেখক মুশতাক আহমেদ, কারাগারে বিচারাধীন অবস্থায় ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে মারা যান। তার একাধিকবার জামিন আবেদন খারিজ করে দেওয়া হয়েছিল। মুশতাকের এই মৃত্যু দেশজুড়ে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক ক্ষোভের জন্ম দেয়। এই ধরনের নির্যাতন ও নিপীড়ন বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় তোলে।
আমি নিজেও এই দমনমূলক আইনি যন্ত্রের শিকার হয়েছিলাম। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক হিসেবে আমি আমার মত প্রকাশ করেছিলাম—আর সে কারণেই আমাকে মিথ্যা মামলার অপবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করা হয়। গণমাধ্যমে আমাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অপমানিত করা হয়, আমার চরিত্র হননের চেষ্টা চলে। তবে এই নিপীড়নের অন্ধকারে একটি আলো ছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের অটল ও দ্রুত প্রতিক্রিয়া। তাদের আন্তর্জাতিক চাপ এবং প্রচারণার মাধ্যমে বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে আলোচিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আমি পুনর্বহাল হই।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে আখ্যা দেয় ‘ভয়ের হাতিয়ার’ হিসেবে এবং এর তাৎক্ষণিক বাতিল দাবি করে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই আইনকে ‘দমনমূলক’ হিসেবে চিহ্নিত করে এবং অভিযোগ করে যে, সরকার এটিকে ব্যবহার করছে সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক মতপ্রকাশ রোধ করার জন্য। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের স্বাধীনতার অবস্থানকে সবচেয়ে খারাপ বলে উল্লেখ করে। তারা এই আইনের অপপ্রয়োগকেই মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরে।
২০১৪ সালে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশ করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন—`Stop Them, Now!'—যেখানে বর্ণনা করা হয়, কীভাবে সন্ত্রাস দমনের উদ্দেশ্যে গঠিত র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে রাষ্ট্রীয় খুনি বাহিনীতে। এর চার বছর পর, ২০১৮ সালে, `Killed in Crossfire' শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে অ্যামনেস্টি, যেখানে দেখানো হয় কীভাবে কথিত মাদকবিরোধী অভিযানের আড়ালে সরকার এই বাহিনীকে ব্যবহার করছে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের হাতিয়ার হিসেবে।
২০১৩ থেকে ২০১৯ সময়কালে রাজনৈতিক গুম ও বেআইনি হত্যাকাণ্ড বেড়ে যায়, যার টার্গেট ছিল মূলত বিরোধী দল ও সরকারের সমালোচকরা। এসব ঘটনার শিকার পরিবার—বিশেষত মায়েরা—প্রথমে অনানুষ্ঠানিকভাবে একত্র হতে শুরু করেন। পরে তারা গড়ে তোলেন একটি সংহতির প্ল্যাটফর্ম: ‘মায়ের ডাক’। ২০১৪ সালের দিকেই তাঁদের মাঝে পারস্পরিক যোগাযোগ শুরু হয়। ২০১৬ সালের ১২ মার্চ প্ল্যাটফর্মটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, প্রকাশ্য শুনানি—বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের প্রিয়জনদের গুমের বর্ণনা তুলে ধরেন। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে তাদের প্রথম বৃহৎ জনসমাবেশে ২০টির বেশি পরিবার প্রকাশ্যে তাদের নিখোঁজ স্বজনদের গল্প শোনায়।
এই হৃদয়বিদারক বর্ণনাগুলো আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তাঁদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে এই দুর্বিষহ বাস্তবতা তুলে ধরেন—যা সরকার বহুদিন ধরে অস্বীকার করে আসছিল।
র্যাবের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যে অভিযোগের ভিত্তি গড়ে উঠেছে, তা নির্মিত হয়েছে বছরজুড়ে চলা নিরলস তথ্যসংগ্রহ, নির্ভীক প্রতিবেদন এবং নিখোঁজ ও নিহতদের পরিবারের হৃদয়বিদারক সাক্ষ্যনির্ভর অনুসন্ধানের মাধ্যমে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ঐতিহাসিক দুটি প্রতিবেদন ছাড়াও, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০১৭ ও ২০১৮ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করে বিশদ তদন্ত প্রতিবেদন—যেখানে উঠে আসে গুম, হেফাজতে নির্যাতন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার ভয়াবহ চিত্র।
এই নৃশংসতার একটি শোকাবহ উদাহরণ হলো টেকনাফ পৌর কমিশনার একরামুল হকের হত্যাকাণ্ড। ২০১৮ সালে তাকে ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত বলে দাবি করে র্যাব। কিন্তু পরে একটি অডিও রেকর্ড ফাঁস হয়—যেখানে মৃত্যুর আগে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে একরামের শেষ কথোপকথন ধরা পড়ে। এই রেকর্ডে স্পষ্ট হয়, তিনি তখন জীবিত, নিরস্ত্র এবং ভয়াবহ আতঙ্কে ছিলেন—যা র্যাবের তৈরি করা ‘গোলাগুলির’ গল্পকে সম্পূর্ণ মিথ্যা ও পরিকল্পিত বলে প্রমাণ করে।
স্থানীয় সংগঠন অধিকার ও আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) বহু বছর ধরে ‘ক্রসফায়ার’ এবং নির্বিচার গ্রেপ্তারের নিরপেক্ষ তালিকা সংরক্ষণ করেছে। কিন্তু এই দায়িত্বশীল কাজের জন্য তাদের ক্রমাগত হুমকি, সরকারি নজরদারি এবং আইনি হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ এক বিস্তৃত দমন-পীড়নের সাক্ষী হয়—যার মূল লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করা। হাজার হাজার বিএনপি নেতাকর্মীকে পুলিশি অভিযানে গ্রেপ্তার করা হয়। শান্তিপূর্ণ সমাবেশ ভেঙে দেওয়া হয় জলকামান, রাবার বুলেট ও গণগ্রেপ্তারের মাধ্যমে। নিরাপত্তা বাহিনী বিরোধী রাজনৈতিক দফতরগুলো ঘিরে ফেলে, রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে; সবকিছু পরিচালিত হয় আতঙ্ক ও নিয়ন্ত্রিত শঙ্কার পরিবেশে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই পরিস্থিতিকে বর্ণনা করে ‘বিরোধী রাজনীতির ওপর সাংগঠনিক হামলা’ হিসেবে এবং হুঁশিয়ারি দেয়—এই ধরনের আচরণ একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে কার্যত অসম্ভব করে তোলে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল একই সুরে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং বিচার ব্যবস্থাকে ‘দমন-পীড়নের হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে। বিরোধী দল ও নাগরিক সমাজের কণ্ঠ রোধ করতে রাষ্ট্র আইনকে ব্যবহার করেছে একটি অস্ত্র হিসেবে।
একতরফা ‘ডামি নির্বাচনের’ পর ২০২৪ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ এক সন্ধিক্ষণে পৌঁছায়। বহু বছরের দমন-পীড়ন, রাজনৈতিক অধিকার হরণ, গুম, অর্থনৈতিক বঞ্চনা এবং মতপ্রকাশের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ অবশেষে এক বিস্ফোরণ তৈরি করে। প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নামে। কিন্তু খুব দ্রুত সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে—গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশাচালক, শিক্ষক, শহরের সচেতন মানুষ সবাই যুক্ত হয় এক সম্মিলিত গণ-আন্দোলনে। তাদের দাবি ছিল খুব সাধারণ: জবাবদিহিতা, মর্যাদা ও নাগরিক অধিকার।
রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া ছিল ভয়াবহ রকম নিষ্ঠুর। নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানো হয়, মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়, অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে দেওয়া হয়, এমনকি হাসপাতালগুলোকে সতর্ক করা হয় যেন তারা আহতদের চিকিৎসা না দেয়। অনবরত গুলি চলতে থাকে, ছাদে ছাদে স্নাইপার বসানো হয়, আর গভীর রাতে শুরু হয় গণগ্রেপ্তার ও অপহরণ।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই দমন-পীড়নকে অভিহিত করে “দক্ষিণ এশিয়ার গত দুই দশকের মধ্যে শান্তিকালে সংঘটিত অন্যতম রক্তক্ষয়ী অভিযান” হিসেবে। তারা উপস্থাপন করে স্যাটেলাইট চিত্র—যেখানে গণকবরের চিহ্ন পাওয়া যায়—এবং নির্যাতনের ভিডিওপ্রমাণ, যেগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে অস্থায়ী আটককেন্দ্র বা কথিত ‘ব্ল্যাক সাইট’ থেকে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, এসব স্থানে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে চোখ ঢেকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক কার্যালয়ে সমন্বিত অভিযান চালানো হয়েছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস নিশ্চিত করে, শুধুমাত্র প্রথম তিন সপ্তাহেই ৩১ জন সাংবাদিক গ্রেপ্তার হয়েছেন, ১২ জনকে নির্যাতন করা হয়েছে, এবং ৩ জন নিখোঁজ হয়ে গেছেন—যাদের আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এই পুরো চিত্র একটিই কথা বলে—রাষ্ট্র তার নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল, শুধু তাদের চুপ করিয়ে দেওয়ার জন্য।
এই বিভীষিকাময় দমন-পীড়নের মধ্যেও সাধারণ মানুষের সাহস এক নতুন ইতিহাস রচনা করে। অনেকেই ছিল কিশোর কিংবা তরুণ—তাদের হাতে ছিল শুধু প্ল্যাকার্ড, কিন্তু হৃদয়ে ছিল সত্যের জন্য লড়ার অদম্য শক্তি। তারা ভয়কে পরিণত করেছিল প্রতিরোধে। তাদের এই অবস্থান ছিল কেবল স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা জবাবহীনতার এক অন্ধকার ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) এক তথ্য-অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়—এই বিক্ষোভে কমপক্ষে ১,৪৩৭ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে শিশুরাও ছিল। প্রতিবেদনটি এই সহিংসতাকে “মানবতাবিরোধী অপরাধের সম্ভাব্য উদাহরণ” হিসেবে অভিহিত করে এবং একটি স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করে।
২০২৪ সালের জুলাই মাসে যা ঘটেছিল, তা কেবল একটি আন্দোলন নয়—তা ছিল একটি জবাব, একটি জাতীয় পুনর্জাগরণ। সংগ্রাম এখনো শেষ হয়নি। স্বৈরশাসন কেবল নেতৃত্ব পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায় না—এরা পিছিয়ে যায়, গা ঢাকা দেয় এবং আবার ফিরে আসে নতুন মুখোশ পরে। যে প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ধরে দুর্বল হয়ে পড়েছে, সেগুলোকে শুধু কাঠামোগতভাবে নয়—আদর্শ, ন্যায়বোধ ও বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করে নির্মাণ করতে হবে।
যে ক্ষত এই রাষ্ট্রের মানুষদের শরীর ও মনে বসেছে—তা মুছে ফেলতে সময় লাগবে, সাহস লাগবে এবং লাগবে সম্মিলিত স্মরণ। তবুও, অনেক বছর পর এখন আমাদের সামনে একটি নতুন সম্ভাবনা। আমরা আর একা নই—আমাদের পাশে আছে সেই সাহসী সংস্থা এবং মানুষগুলো, যারা জীবন দিয়ে, সম্মান হারিয়ে বা অবিচারের শিকার হয়েও সত্য থেকে সরে আসেননি।
এই লেখা কেবল একটি কৃতজ্ঞতা নয়—এটি একটি প্রতিজ্ঞা।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, অধিকার, আইন ও সালিশ কেন্দ্র এবং অসংখ্য নামহীন মানবাধিকার প্রহরী—আপনাদের সাহস আমাদের ভবিষ্যৎ নতুন করে গড়ে তোলার সুযোগ দিয়েছে।
আমরা এই সুযোগ যেন ব্যর্থ না করি। আমরা শুধু একটি রাষ্ট্র নয়, একটি ন্যায়ভিত্তিক সংস্কৃতি গড়তে চাই। অন্ধকারতম সময়েও যাঁরা আমাদের পাশে ছিলেন—আমরা তাঁদের স্মরণ করি, তাঁদের সম্মান করি। ধন্যবাদ।
ড. মোর্শেদ হাসান খান