ঢাকা, রবিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

দিল্লির চিঠি 

কূটনৈতিক সম্পর্কের বিশেষ মাইলস্টোন

জয়ন্ত ঘোষাল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৫৬ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০২৩
কূটনৈতিক সম্পর্কের বিশেষ মাইলস্টোন

তাঁর নাম আজরা জেয়া। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক বিভাগের আন্ডারসেক্রেটারি; নিরাপত্তা ও মানবাধিকার, গণতন্ত্র—বিভিন্ন বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কূটনীতিক।

তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তাঁর শিকড় কিন্তু বিহারে।

তবে তিনি জন্মেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলাইনার চ্যাপেল হিলে। সেখানেই তাঁর পড়াশোনা। ওবামার সময় তিনি খুব গুরুত্ব পেয়েছিলেন। ট্রাম্পের সময় খুব ঝামেলায় ছিলেন এবং অভিযোগ করেছিলেন, তাঁকে প্রমোশন দেওয়া হচ্ছে না তাঁর গায়ের রঙের জন্য।

ভদ্রমহিলা খুব ডাকাবুকো। তিব্বত ও চীন বিষয় নিয়ে তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য আছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন আসন্ন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—তারা অল্প দূরত্বের মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে জনসভা করতে শুরু করেছে।


এটা ভালো খবর। দুই পক্ষের সেই সভা শেষ হতে না হতেই আজরা জেয়া ঢাকা সফর করেন। ঢাকা সফরের আগে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ সফর হচ্ছে ভারত সফর। আবার আজরা জেয়ার ভারত সফরের আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। নরেন্দ্র মোদির সফরের ঠিক আগে বাংলাদেশ নিয়ে ছয় মার্কিন কংগ্রেসম্যানের চিঠি, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে হঠাৎ বিতর্ক শুরু হয়ে যাওয়া—সবই যেন একটি সুতোয় বাঁধা।

এখন বোঝা যাচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কিন্তু চাইছে না বাংলাদেশের সঙ্গে তার কূটনৈতিক সম্পর্ক কটুতার পর্যায়ে যাক। ভারতও স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন কিছু কাজ করা উচিত নয়, যাতে ভারতের সার্বভৌম স্বার্থ বিঘ্নিত হয়। বিদেশনীতির ক্ষেত্রেও সার্বভৌম স্বার্থ কাজ করে। এমন একটা সময় ভারত ও আমেরিকার সঙ্গে এই কথোপকথনটা হচ্ছে, যখন চীন ও ভারতের সঙ্গে সীমান্ত মীমাংসা তো দূরের কথা, সেই সীমান্ত বিবাদ বাড়ছে বৈ কমছে না। আর ঠিক তার আগে আজরা জেয়া যখন দালাইলামার সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধিদল নিয়ে বৈঠক করেন, স্বভাবতই চীন একেবারে ফোঁস করে উঠেছে। চীনের পক্ষ থেকে দালাই লামার সঙ্গে মার্কিন কূটনীতিকের বৈঠক, এটি খুব খারাপ চোখে দেখা হয়েছে বলে তারা জানিয়েছে। তারা বলেছে, দালাই লামা ধর্মগুরু নন। তিনি একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে আছেন। তিনি এক চীন নীতির বিরুদ্ধে। যখন ভারত এক চীন নীতির কথা মেনে নিয়েছে, তাহলে ভারতেরও উচিত নয় এমন কোনো সফরকে গুরুত্ব দেওয়া বা উৎসাহিত করা, যাতে অভিন্ন চীন নীতির প্রতি ভারতের অবজ্ঞা প্রকাশ পায়।

কূটনৈতিক সম্পর্কের বিশেষ মাইলস্টোনচীন কি অভিন্ন ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছে সুতরাং সেখানে কিন্তু একটা ঝগড়াঝাঁটির পরিবেশ রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আজরা জেয়ার বাংলাদেশ সফরকে আমার মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রেখে উঠতি বিতর্কগুলো নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি কথা বলে একটা মীমাংসা এবং শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক পথে নিয়ে যাওয়াই ছিল এই সফরের উদ্দেশ্য।

এখানে একটা কথা স্পষ্ট ভাষায় আমার দিক থেকে বলা প্রয়োজন। সেটা হচ্ছে, কোনো সার্বভৌম রাষ্ট্র, কারা কিভাবে নির্বাচন করবে, কিভাবে করবে না, তাদের কী হবে, কী না হবে—সেটা নিয়ে নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক স্তরে খুব সাংঘাতিক একটা পরিস্থিতি তৈরি হলে অনেক সময় মতামত জ্ঞাপন করা হয়। যেমন—পাকিস্তানে বা মিয়ানমারে যখন গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিয়ে সামরিক শাসন বহাল হয়, তখন অনেক সময় দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সামরিক শাসনকে সমর্থন করছে। সেই সামরিক শাসনকে সমর্থন করাটা তখন তাদের মনে হয় গণতন্ত্রকে সমর্থন করা। আবার অনেক সময় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যেও তারা নাক গলিয়ে তাদের বক্তব্য পেশের চেষ্টা করে। যেটা অনেক সময় সেই ছোট স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের শাসকদলের স্বার্থে নয়, অন্য কোনো কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করে।

বিদেশনীতিতে অনেক স্তর থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু পশ্চিমী দুনিয়ার প্রথম দেশ, সেহেতু তার দিক থেকে দাদাগিরি থাকবে, সেটা আমাদের মেনে নিতে হয়। ভারত-বাংলাদেশকেও মেনে নিতে হয়। মেক্সিকো প্রসঙ্গে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোনো অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়, ট্রাম্প যখন সরাসরি নর্থ কোরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, তখন ভারত কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে তাদের অভ্যন্তরীণ নীতি নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার মানসিকতা দেখায় না।

সুতরাং এই যে প্রথম দুনিয়া, দ্বিতীয় দুনিয়া, তৃতীয় দুনিয়া—এই ভেদ ঘুচিয়ে জাতিসংঘ সব দেশকে একইভাবে মর্যাদা দেওয়ার কথা বললেও কোথাও না কোথাও দেখা যায়, এই ভেদাভেদ জ্ঞান থেকে যায়। তবে আশার কথা, এবার বাংলাদেশের সরকারও নির্বাচনের বিষয়টা একেবারেই স্পষ্ট করে দিয়েছে। তার কারণ আজরা জেয়া যখন বাংলাদেশে গেছেন, তখন তিনি তাঁর বিবৃতিতে ভারতে এসেও বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করেননি। নির্বাচনের কথা উল্লেখ করেননি। এমনকি মণিপুরে যে ঘটনা ঘটছে, সেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, সে কথা মার্কিন রাষ্ট্রদূত মণিপুরে গিয়ে বলে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। তিনি কিন্তু মানবাধিকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও ভারতে এসে সে বিতর্ক আরো উসকে দেননি। প্রশান্ত মহাসাগরীয় ক্ষেত্রে ভারত-বাংলাদেশের সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে এগোনোর কথা জোর দিয়ে বলেছেন তিনি।

এটা খুব স্পষ্ট যে চীন এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু। সে ক্ষেত্রে চীন যেহেতু অনমনীয় মনোভাব নিচ্ছে, সেখানে শি চিনপিং সংবিধান সংশোধন করে চিরকালের জন্য চীন কমিউনিস্ট পার্টির প্রেসিডেন্ট হয়ে গেছেন। এ অবস্থায় আমেরিকার জন্য ভারত ও বাংলাদেশ—এই জোট কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে আমেরিকার কাছেও বিমসটেক সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। গ্লোবাল সাউথ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে গ্লোবাল নর্থের কাছে। এ জন্য ভারতে যখন এ বছর জি২০ সম্মেলন হবে, বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এই বৈঠকের দিকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকিয়ে আছে।

এই পরিস্থিতিতে আজরা জেয়ার এই সময়ে বাংলাদেশ সফরটা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের যে বৈঠক হয়েছে, তাতেও একটা সুষ্ঠু রোডম্যাপ পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী—তাঁরাও কিন্তু আজরা জেয়াকে সবিস্তার জানিয়ে দিয়েছেন যে কিভাবে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করার ব্যবস্থা বাংলাদেশ সরকার করেছে। শুধু আনুষ্ঠানিকভাবে বা অফিশিয়াল বৈঠক নয়, নৈশ ভোজেও আজরা জেয়া ও মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল ঘরোয়া ভঙ্গিতেও অনেক কথা আলোচনা করেছে।

আজরা জেয়ার সফরটা কিন্তু বাংলাদেশের নির্বাচনের আগে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশ ও আমেরিকার সম্পর্কের মধ্যে যে সংঘাতের আবহ তৈরি হয়েছিল, সেটাকে দুই পক্ষ থেকেই অনেকটা নিরাময় করা হয়েছে। শেখ হাসিনাও ঢাকায় জাতীয় সংসদে স্পষ্ট ভাষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বহু কাজের সমালোচনা করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেসব বিষয় নিয়ে তোলা বিতর্কগুলো নিরসন করতে চায়। শুধু আর্থিক সাহায্য নয়, তারা কূটনৈতিক, এমনকি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারেও সাহায্যের বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছে। শেখ হাসিনার দিক থেকেও এটা একটা সার্থক কূটনীতি। আবার ভারতের দিক থেকেও এই গোটা যাত্রাপথ, সেটা কিন্তু ইতিবাচক দিকেই যাচ্ছে। তার মানে এই নয় যে বাংলাদেশ-ভারত একটা অক্ষ তৈরি করে ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় ক্ষেত্রে একেবারে চীনের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য তৈরি হচ্ছে; বরং চীনের সঙ্গেও সংঘাত মেটানোর ব্যাপারে বাংলাদেশ-ভারত উভয়ই একই রকমভাবে বিশ্বাসী। কিন্তু যেকোনো ধরনের সম্ভাবনা, যেকোনো ধরনের পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকাটাও ভারতের দিক থেকে একটা কর্তব্য। আপাতত ভারত ও বাংলাদেশ—দুটি দেশেই নির্বাচন আসন্ন। বাংলাদেশ-ভারত এবং এই উপমহাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আজরা জেয়ার সফর একটা বিশেষ মাইলস্টোন তৈরি করল।  

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০২৩
এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।