ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

কৃষকের উন্নয়নে চাই মনোভাব পরিবর্তন ও সচেতনতা

জাহিদ হাসান জিহাদ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৭ ঘণ্টা, মে ২১, ২০২৩
কৃষকের উন্নয়নে চাই মনোভাব পরিবর্তন ও সচেতনতা

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর অপার সম্ভাবনার দেশ। এদেশের জনসংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশি মানুষ কৃষির ওপর সরাসরি নির্ভরশীল।

স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের কৃষি ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। সাম্প্রতি বৈশ্বিক করোনা মহামারিতে যেখানে বিশ্বের শিল্প নির্ভর এবং উন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে পড়েছে, সেখানে কৃষিনির্ভর আমাদের দেশ মাথা উঁচু করে রয়েছে সগৌরবে। কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষি অর্থনীতি, বাজার ব্যবস্থাপনা, সার ব্যবস্থাপনা, উচ্চ ফলনশীল জাত, কৃষি গবেষণার মাধ্যমে বদলে যাচ্ছে কৃষি খাত। আর এই কৃষির মূল কারিগর আমাদের দেশের কৃষক।  

দেশের কৃষির উন্নতি হলেও আশানুরূপ উন্নতি হয়নি আমাদের কৃষকদের। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে যেসব কৃষক ফসল ফলায়, দিন শেষে তাদের চুলাতেই আগুন জ্বলে না। বর্তমানে কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকার নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কৃষি ঋণ, কৃষি প্রণোদনা, প্রশিক্ষণ, ফসল বীমাসহ বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা প্রদান করছে। সেই সাথে কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে এনজিও এবং বিভিন্ন সংস্থা কাজ করছে। তারপরেও কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে তেমন কোনো পরিবর্তন আসছে না। এর কারণ কী? কৃষকরা কি এসব সুবিধা ঠিকমতো পাচ্ছেন না? নাকি এই পেশাটাই অলাভজনক? 

আমাদের দেশের বেশিরভাগ কৃষক বাস করেন গ্রামে। কৃষিপণ্য উৎপাদন কাজে সরাসরি যারা নিয়োজিত তাদের বড় একটি অংশ হলো প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক এবং ভূমিহীন বা বর্গা চাষী। যাদের ১০ থেকে ১৫ বিঘা জমি রয়েছে তারা খুব একটা কৃষি কাজ করেন না; জমি বর্গা দিয়ে অন্য পেশায় জীবিকা নির্বাহ করেন। আর সেই জমিতে প্রান্তিক ও ভূমিহীন কৃষকরা অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে ফলায় সোনার ফসল।

ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গা চাষীদের সংখ্যা আমাদের দেশে বেশি। আবার অনেকটা অবহেলিত এই চাষীরায়। কৃষি সুবিধা নিতে গেলে তাদের পড়তে হয় ভোগান্তিতে, কৃষি ঋণ পেতেও তাদের নানা বেগ পেতে হয়। সরকারি সুবিধাও ঠিকমতো পৌঁছায় না তাদের পর্যন্ত। গবেষণার মাধ্যমে উচ্চ ফলনশীল বীজেও ভেজাল মেশানো, সারের মান নষ্ট আর ডিলারের কারসাজিতে পদে পদে ঠকছেন কৃষকরা। মাঠে যখন চাষ শুরুর সময় হয়- বর্গা ও প্রান্তিক চাষীদের কাছ থেকে বেশি দামে জমির লিজ খরচ ধরে জমির মালিক। বর্গা মূল্য নির্ধারিত না হওয়ার কারণে প্রতিবছরই প্রায় বাড়তি টাকা দিতে হয়। এ বছর যে টাকায় বর্গা নিয়েছে জমি, আগামী বছর তার চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে জমি বর্গা নিতে হয়। এতে চাষের শুরুতেই চাপে পড়ে কৃষক।  

মাঠে চাষ করবেন কিন্তু সে সময় জমিতে পানি নেই। স্যালো ইঞ্জিন চালিত পাম্প ব্যবহার করবে কিন্তু জ্বালানির দাম বেশি। যেসব এলাকায় প্রাকৃতিক উৎস, কিংবা সেচ প্রকল্প চলমান রয়েছে সেখানেও সমস্যা। বেশিরভাগ এলাকা অবৈধ দখলদারদের কাছে জিম্মি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে- ধান উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটা মৌসুম হলো রবি মৌসুম। অথচ এই মৌসুমে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তামাক চাষের ফলে সেচ সুবিধা ঠিকমতো মাঠে পায় না চাষীরা। কারণ রবি মৌসুমের বোরো ধানের জমিতে পানি নিতে চাইলে পার্শ্ববর্তী তামাক চাষীর অসুবিধা। ফলে অধিক তামাক চাষ প্রবণ এলাকার বোরো ধান চাষীরা ঠিকমতো পানি পায়না। এছাড়া শষ্য পর্যায় এবং মাঠের ‘ক্রপ প্যাটার্ন’ ঠিকমতো না করার কারণেও যত্রতত্র ফসল আবাদ করেন কৃষকরা। এতে নানা সময় ফলন কমে যায়।

আমাদের দেশের অধিকাংশ এলাকার ক্ষুদ্র কৃষকদের জমির পরিমান এক দাগে কম। কম জমি, ভাগাভাগি হওয়া এবং একই ধরনের ফসল আবাদ না করার কারণে মাঠের জমিতে আইলের পরিমান বেড়ে যায়। সেক্ষেত্রে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ সুবিধা পায় না তারা। জমি খণ্ড হওয়ার ফলে তাদের চাষ, মই, আগাছা দমন, সেচ ইত্যাদি কাজে যান্ত্রিকীকরণ সুবিধা কম। যেখানে যান্ত্রিকীকরণ সুবিধা পায় কৃষকরা সেখানেও যন্ত্রপাতির মালিকদের কাছে এক প্রকারের জিম্মি তারা। তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে চাষ খরচ দ্বিগুণ হারে বেড়েছে। সেচ খরচও পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সরকার কৃষকদের জন্য প্রণোদনার মাধ্যমে যে সার, বীজ দিয়ে থাকেন তা ঠিকমতো প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে পৌঁছায় না। বিতরণ কাজে নিয়োজিত কিছু অসাধু ব্যক্তি, স্থানীয় ক্ষমতাশীল নেতাকর্মী, অকৃষকদের প্রভাবে প্রান্তিক এসব কৃষকরা অনেকটা বঞ্চিত হয় প্রণোদনা থেকে।

সরকার এসব প্রণোদনা অনেকটাই স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের স্বজনপ্রীতির কারণে মুখ থুবড়ে পড়ে। সেই সাথে মনিটরিং ব্যবস্থা নড়বড়ে হওয়া এবং ভেজাল বীজের ফলে কৃষককরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাশাপাশি প্রণোদনা গ্রহণের ক্ষেত্রে ভোগান্তির কারণে এ সুবিধা থেকে অনেকটাই হতাশ প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরা। কৃষক পর্যায়ে বিনামূল্যে এসব প্রণোদনা সুবিধা দেওয়ার কথা, অথচ কৃষি সম্প্রসারণ এসব সুবিধা বিনামূল্যে দিলেও সুবিধা প্রাপ্তির জন্য অসাধু জনপ্রতিনিধিদের অনেক ক্ষেত্রে টাকা দিতে হয় কৃষকদের। গ্রাম থেকে উপজেলা শহরে এসে একজন কৃষক সরকারি প্রণোদনা গ্রহণের ক্ষেত্রে তার দৈনিক শ্রমের মূল্য, সময় অপচয়, যাতায়াত খরচের তুলনায় প্রণোদনা কম পাওয়ায় অনাগ্রহ তৈরি হয়। আবার যথা সময়ে সার বীজ কৃষক পর্যায়ে না পৌঁছানোর ফলে সেগুলো কাজে লাগাতে পারে না কৃষকরা।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কৃষক পর্যায়ে কৃষি সেবা দিয়ে থাকেন। কৃষকরা যাতে ন্যায্যমূল্যে সার-বীজ কিনতে পারে এজন্য মনিটরিং করে কৃষি বিভাগ। কিন্তু মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার না হওয়ায় সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অতিরিক্ত দামে সার-বীজ কিনতে হয় কৃষকদের। মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তাদের মনিটরিংয়ের অভাবে বিভিন্ন এলাকায় বীজ কিনে প্রতারিত হয় কৃষক। আবার কোথাও কোথাও ভেজাল সার ও বীজ কিনেও ক্ষতিগ্রস্ত হয় তারা। কৃষকরে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এসব অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেও তেমন কোনো লাভ হয় না। যার ঠকার, সেই কৃষকই দিনশেষে ঠকে। এছাড়া কৃষি শ্রমিকের তুলনায় অকৃষি শ্রমিকের মজুরি বেশি। একারণে ফসল রোপন, পরিচর্যা, কর্তন, মাড়াই, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থাপনার সময় কৃষকরা প্রতি মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত। সরকার কৃষি যান্ত্রিকীকরণে নানা প্রদক্ষেপ গ্রহণ করলেও যন্ত্রপাতি সহজলভ্য না হওয়ায় অনেকটায় সুফল পায় না তারা। এলাকা ও ফসল ভেদে কৃষি শ্রমিকের নির্ধারিত মূল্য নির্ধারিত না থাকার ফলে কৃষককে বাড়তি টাকা দিতে হয়। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। আবার ফসল চাষাবাদের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের কৃষকদের অজ্ঞতাও রয়েছে।

ফসলের জাত নির্বাচন সর্ম্পকে জ্ঞানের অভাবের ফলে কোন মৌসুমে কোন ফসলের কি জাত আবাদ করতে হবে এটা নিয়ে দ্বিধায় থাকে চাষীরা। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে তারা এক জনের দেখা দেখি চাষ করে। এতে উচ্চ ফলনশীল ও উন্নত জাতের ফসল আবাদ সম্প্রসারণ কম হয়। একেক এলাকার মাটি, জলবায়ু একেক রকম। সে অনুয়াযী উদ্ভাবিত ফসলের জাত চাষে উক্ত এলাকায় চাষীদের প্রবণতা সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া সেসব ফসলের জাত সর্ম্পকে কৃষকদের বিস্তর ধারনা প্রদান করতে হবে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ কৃষকরায় কোন ফসলের পরে কোন ফসল চাষ করলে ভালো হয়, রোগবলাই কম হয়, উৎপাদন বেশি হয় এসব সম্পর্কে খুব একটা অভিজ্ঞ নয়। ফলে তারা চাষাবাদের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া প্রতিবছর ভেজাল বীজ, আবহাওয়া, বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দূর্যোগ তো থাকেই। এজন্য কৃষকদের ফসল চাষাবাদের আধুনিক কলাকৌশল সর্ম্পকে প্রশিক্ষণ এবং মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা জরুরি।

কৃষকরা মাঠ ফসলের আবাদ করেন, কিন্তু ফসলের রোগবালাই ও পোকা মাকড় সম্পর্কে অনেকটাই অজ্ঞ। যার কারণে শষ্যহানির মতো ঘটনা ঘটে। সচারচর ধানের জমিতে পোকা নড়াচড়া করলেই কৃষকরা মনে করেন জমিতে পোকার আক্রমণ হয়েছে। এর পরে ছুটে যান স্থানীয় কীটনাশকের দোকানে। সেখান থেকে কীটনাশকের দোকানীর পরামর্শেই পোকার উপস্থিতি না দেখেই কীটনাশক কিনে এনে যত্রতত্র জমিতে দেন। কিন্তু জমিতে উপকারী এবং অপকারী এই দুই ধরনের পোকা ও মাকড় থাকে। উপকারী এবং অপকারী পোকা শনাক্ত না করেই কৃষকরা কীটনাশক স্প্রে করে। এতে অপকারী পোকার পাশাপাশি উপকারী পোকা ধ্বংস হয়। ফলে ক্ষতি আরো বেশি হয়। এছাড়া সার বা কীটনাশকের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে কৃষকরা অভিজ্ঞ না। মাত্রা, কার্যকারিতা এবং প্রয়োগ পদ্ধতি সঠিকভাবে জানেন না। ফলে একদিকে যেমন সার ও কীটনাশক ব্যবহারে অপচয় হয় ঠিক অন্যদিকে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। এদিকে মাঠ পর্যায়ে ফসলের রোগবলাই ও পোকা দমনের ক্ষেত্রে প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকরা বেশিরভাগই কীটনাশক বিক্রেতার ওপর নির্ভর করে। জমিতে কখন কোন কীটনাশক প্রয়োগ করবেন তার পরামর্শ বেশিরভাগই দেন ঐ সব দোকানীরা। এদিক থেকে কীটনাশকের এসব দোকানীদের কাছেও জিম্মি থাকে কৃষকরা। অনেক ক্ষেত্রে মেয়াদ উত্তীর্ণ কীটনাশক ব্যবহারের ফলে ঠিকমতো রোগ ও পোকা দমন হয় না। এক্ষেত্রে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয় কৃষকদের। অনেক কৃষক আছেন যারা চাষের পরে ফসল বিক্রি করে সার ও কীটনাশকের মূল্য পরিশোধ করে। যার কারণে ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার সুযোগ করে নেয়। এক্ষেত্রে কৃষকরা যাতে ন্যায্য মূল্যে কীটনাশক ও সার কিনতে পারে সেদিকে মনিটরিং ব্যবস্থা আরো জোরদার করা প্রয়োজন। মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের পরামর্শদাতা কর্মকর্তাদের আরো আন্তরিক হয়ে কৃষকদের পরামর্শ প্রদানের ব্যবস্থা করা জরুরি।

কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যে যেন কৃষক ন্যায্য মূল্য পায়, সেজন্য বর্তমান সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে তার পরেও কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পায় না। একজন কৃষকের স্বপ্ন থাকে যে তার মাঠে এবার যে ফসল রয়েছে, তা যেন ঠিকমতো ঘরে তুলতে পারে। ফলন যাতে ভালো হয় আর দাম যাতে ঠিকঠাক পায়। একজন ভোক্তা চাই যে কৃষকের উৎপাদিত ঐ পণ্যটি যাতে কম তামে কিনতে পারে। একজন ব্যবসায়ী চাই যে কৃষকের কাছ থেকে কম দামে কিনে বেশি দামে ভোক্তার কাছে বিক্রি করা। কৃষক এবং ভোক্তার এই দুজনের মাঝে বড় বাধা হলো ব্যবসায়ী। এছাড়া ভুঁইফোড় ও অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি কৃষকরা। কৃষি পণ্য উৎপাদন ছাড়া কৃষকদের হাতে আর কিছুই থাকে না। সরকার কৃষকদের জন্য সার-বীজ-জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু কৃষক পর্যায়ে সেগুলো নির্ধারণ করে ব্যবসায়ীরা। সারের মূল্য সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেয় তা থেকে কেজিপ্রতি ৫-১০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হয় কৃষকদের। বীজ ও জ্বালানি তেলের ক্ষেত্রেও বিষয়টা একইরকম।

কৃষক ধান উৎপাদন করলে ধানের দাম, পাটের দাম, আঁখের দাম, আলুর দাম, ডাল, পেয়াজ, সবজিসহ সকল কৃষি পণ্যের দাম নির্ধারণ কৃষকের হাতে নেই। বর্তমানে ধানের একটি সরকারি দাম নির্ধারিত রয়েছে। কিন্তু কৃষকরা সে নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে পারে না সরকারের কাছে। প্রভাবশালী নেতাকর্মীরাই কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ধান কম দামে কিনে সরকার নির্ধারিত দামে সরকারের কাছে বিক্রি করে। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি মূল্যের তুলনায় খোলা বাজারের দাম বেশি হয়, সেক্ষেত্রে ধানের প্রথম দাম নির্ধারণ করে চালকল মালিকরা, দ্বিতীয় দাম নির্ধারণ করে বড় ব্যবসীয়রা, তৃতীয় দাম নির্ধারণ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দালালরা, চতুর্থ দাম নির্ধারণ করে স্থানীয় সিন্ডিকেট। আর কৃষকদের বাধ্য হয়ে ঐ স্থানীয় সিন্ডিকেটের কাছেই তাদের বেঁধে দেওয়া দামে ধান বিক্রি করতে হয়। কারণ কৃষকরা তাদের কাছে জিম্মি। পাটের ক্ষেত্রেও একই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। আখ উৎপাদন করে কৃষক, আর তার দাম নির্ধারণ করে আখ ব্যবসায়ী এবং মিলের অসাধু কর্মকর্তারা। যার কারণে সরকারী মূল্যে আখ বিক্রি করতে পারে না কৃষকরা। দাম দিলেও টাকা না পাওয়া, ঘুষ না দিলে আখের ওজন কমে যাওয়া, টাকার পরিবর্তে চিনি দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে আখ চাষে অনাগ্রহ কৃষকদের। তেমনি আলুর দাম নির্ধারণ করে বাজার সিন্ডিকেট। ডাল, সবজির দামও বাজারের সিন্ডিকেটের হাতে। পেঁয়াজ উৎপাদন করে কৃষক আর তা থেকে লাভবান হয় অসাধু ব্যবসায়ীরা। কারণ কৃষক নিরুপায়।

দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যতম অর্থকারী ফসল তামাক। এতেও আছে ক্ষতির হিসেব। তামাক উৎপাদন করে শুধু কৃষক। তাছাড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, দাম নির্ধারণ থেকে শুরু করে সবই নির্ধারণ করে দেয় কোম্পানিগুলো। তামাক চাষে দেশের সহজ সরল অভাবি কৃষকদের টার্গেট করে তামাক কোম্পানিগুলো কৃষকদের সাথে জোঁকের মতো আচরণ করছে। চাষের শুরুতে নানা প্রলোভন দেখিয়ে, চড়া সুদে চাষের জন্য বীজ, সার দিয়ে পরবর্তী সময়ে তাদের নির্ধারিত দামেই কৃষকদের পণ্য বিক্রি করতে হয়। এ ক্ষেত্রেও কৃষক নিরুপায়।

সাম্প্রতিক সময়ে তরমুজের দাম নিয়ে কৃষকদের ঠকার চিত্র সকলের সামনে। মাঠের কৃষকদের থেকে তরমুজ পিস হিসেবে কিনে বাজারে ক্রেতাদের কাছে কেজি দরে বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে। অসাধু ব্যবসায়ীরা তরমুজ ক্ষেতে গিয়ে কৃষকদের কাছ থেকে পিস হিসেবে কিনছেন। তরমুজ চাষী এবং বাজাররের ক্রেতাদের মধ্যে বড় যোগাযোগ না থাকার সুবিধা নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরদের সিন্ডিকেট এই কাজ করছে। ব্যবসায়ীদের অতি লাভের মানসিকতা থেকে এটা হচ্ছে। দাবি উঠানোটা স্বাভাবিক। পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেওয়াটাই আধুনিক বাজার ব্যবস্থাপনার ধারণার মধ্যে পড়ে। মূলত ভুঁইফোড়দের দৌরাত্ব্য এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের যোগসাজসই কৃষকের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার প্রধান কারণ। এতে ক্রেতা যেমন ঠকছেন তেমনি উৎপাদনকারী কৃষকও ঠকছেন। ফলে কৃষক এবং ক্রেতার মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা না হলে এই বাজার ব্যবস্থায় চলমান সিন্ডিকেট দমন সম্ভব নয়।

কৃষিপণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও কৃষকদের নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রির পরিবর্তে বাইরের বাজারে নিতে গেলে পরিবহনের ভাড়া নিয়ে অসুবিধা হয়। একজন কৃষক ক্ষেত থেকে ৫০ কেজি বেগুন তুলে স্থানীয় বাজারে নিয়ে যায়। সেটা শহরের বাজারে নিয়ে গেলে দ্বিগুন দাম পাবে জেনেও সেটা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হয় সে। কারণ কম পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে বেশি ভাড়া দিতে হয়। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের কাছে বিক্রি ছাড়া কোনো উপায় থাকে না কৃষকদের। আবার কৃষি পণ্য সংরক্ষণের সু-ব্যবস্থা এখনো আমাদের দেশে পর্যাপ্ত না। কৃষকরা যে বাড়িতে বা অল্প কিছুদিন ফসল সংরক্ষণ করবে, তারও অজ্ঞতা রয়েছে। এজন্য সবজি, ফল, লতাজাতীয় ফসল, দানা শস্য, পেয়াজ ইত্যাদিসহ দ্রুত পচনশীল পণ্য উৎপাদন করে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষক। মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা ফসল সংগ্রহ, ওয়াশিং, সটিং, গ্রেডিং, প্যাকেজিং, সংরক্ষণ, সংগ্রহোত্তর ব্যবস্থানা ও বাজারজাতকরণের ওপরে সঠিক ধারণা এবং ব্যবস্থা না থাকার ফলে কৃষকরা ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয়।  

একজন সবজি উৎপাদনকারী কৃষক মাঠ থেকে সবজি তুলে সরাসরি স্থানীয় বাজারে গিয়ে বিক্রি করে। এতে বাজারের সিন্ডিকেটের নির্ধারিত দামে তাকে সবজি বিক্রি করতে হয়। তার বিক্রি না করেও কোনো উপায় থাকে না। কারণ কিভাবে সবজি প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে হয় এবং কোথায় কখন বিক্রি করতে হয়, তা তার অজানা। তাছাড়া সংরক্ষণের প্রতিকূলতার কারণে কৃষক দ্রুত বিক্রি করে দেয়। প্রান্তিক কৃষক পর্যায়ে আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণেও দ্রুত ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। যার কারণে ন্যায্য দাম থেকে বঞ্চিত হয় তারা। যেমন একজন কৃষক টমেটো উৎপাদন করলো। স্থানীয় বাজারে সেই টমেটো ১০-১৫ টাকা কেজি। সেই বাজারের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা টমেটো ১৫ টাকায় কিনে ২০ টাকায় বিক্রি করলো। মধ্য ব্যবসায়ীরা ২০ টাকায় কিনে শহরে ২৫ টাকায় ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করলো। শহরের ব্যসায়ীরা ২৫ টাকায় কিনে খুচরা বাজারে ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি করলো ভোক্তার কাছে। ১৫ টাকার টমেটোর দাম ক্রেতা পর্যায়ে ৪০ টাকা। কিন্তু কৃষক পেলো ১৫ টাকা। ক্রেতা ও উৎপাদনকারী কৃষকের মধ্যে দামের এই পার্থক্য সৃষ্টি করে ব্যবসায়ীরা। কৃষি পণ্য বিক্রির জন্য ফসল অনুয়াযী বাজার না থাকার ফলে কৃষকরা দাম ঠিকমতো পায় না। বর্তমান সরকার কৃষি পণ্য বাজারজাত করণের ওপরে গুরুত্ব দিয়েছেন। কৃষকরা দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে পণ্য শহরের বাজারে নিয়ে এসে ভালো দাম পাচ্ছে। তবে মূল কৃষকরা কি এই দাম পাচ্ছে? কৃষকদের পরিবর্তে ব্যবসায়ীরা কৃষক সেজে ভালো দামে বিক্রি করছে পণ্য।

ফসল উৎপাদেন পাশাপাশি সরকার নিরাপদ ফসল উৎপাদনের জন্য গুরুত্ব দিয়েছেন। কৃষকরা কিভাবে নিরাপদ ফসল উৎপাদন করে লাভবান হতে পারবে এ ব্যাপারে ব্যপক প্রচারণা দরকার। সেই সাথে নিরাপদ ফসল উৎপাদন প্রযুক্তি কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে হবে। কৃষক নিরাপদ উপায়ে যেসব ফসল উৎপাদন করবেন সেগুলো প্রয়োজনে আলাদা বাজারের ব্যবস্থা করে ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে কৃষক পর্যায় থেকে নিরাপদ কৃষি পণ্য সুপারসপ, রেস্টুরেন্ট, বড় বাজার বা বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করে দিলে কৃষক লাভবান হবে। মাঠ পর্যায়ে ক্ষুদ্র কৃষকদের পণ্য অতি দ্রুত বিক্রির ঝোক বেশি থাকে। এই ঝোকটাকেই কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃষক ও ভোক্তা পর্যায়ে দুজনেরই পকেট কাটছে। এমন অবস্থায় কৃষকদের এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে চাইলে কৃষকদের সর্ব প্রথম ব্যবসায়ী মনোভাব তৈরি করতে হবে। প্রত্যেক প্রান্তিক কৃষককেই ব্যবসায়ী হতে হবে। প্রত্যেকটি ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যয়ের হিসাব ও আয় নির্ধারণ করতে হবে। তাহলে কৃষকরা সচেতন হবেন। আর কৃষকরা সচেতন হলেই মাঠ পর্যায়ের কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাবেন।

প্রত্যেকটি কৃষককে হতে হবে এক একটি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। নিজের উৎপাদিত ফসল যতদিন তার কাছে ব্যবসায়ী মূলধন হবে ততদিন কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাবে না। তরমুজ নিয়ে কেন ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবে? তরমুজ যে কৃষক উৎপাদন করতে পারলো সেই কৃষকই বাজারে ভালো দাম পেতে পারে। ভোক্তা ও উৎপাদনকারীর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা গেলে দুজনেরই লাভ। একজন ব্যবসায়ী কখনোই চায় না যে তার ব্যবসায় লস হোক। কিভাবে কোন পদ্ধতিতে বিক্রি করলে পণ্যটিতে বেশি লাভ হয় সেটি ঐ ব্যবসায়ী নিজেই খুঁজে বের করবেন। তেমনি কৃষকরা যদি বাণিজ্যিক ও ব্যবসায়ী মনোভাব নিয়ে ফসল উৎপাদন করে তাহলে তাদের ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তিতে কোনো বাধা থাকবে না। এতে ধ্বংস হবে বাজার সিন্ডিকেট, টেকসই হবে দেশের কৃষি, সমৃদ্ধ হবে বাংলাদেশ। সেই সাথে কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। আর এই সবকিছু মিলিয়ে কৃষি পণ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ এবং পরবর্তী ব্যবস্থাপনা, বাজারজাতকরণের ওপর কৃষকদের আরো সচেতনতা বৃদ্ধি করা এখন সময়ের দাবি।
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।