ঢাকা, মঙ্গলবার, ৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৯ মার্চ ২০২৪, ০৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

রাজনীতিতে ‘এক-এগারো’ ঝড়ের পূর্বাভাস

সৈয়দ বোরহান কবীর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২২ ঘণ্টা, মে ২০, ২০২৩
রাজনীতিতে ‘এক-এগারো’ ঝড়ের পূর্বাভাস সৈয়দ বোরহান কবীর

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আমার ভালো লাগে। মাঝে মাঝে মুখ ফসকে কিংবা নিজের অজান্তে সত্যটা বলে ফেলেন।

এই যেমন গত শনিবার (১৩ মে) পল্টনের সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘ঝড় আসছে। সমুদ্র থেকে উত্তাল ঢেউ ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের দিকে। আজ শুধু প্রাকৃতিক ঝড় আসছে, সেটি মনে করার কোনো কারণ নেই। আজ রাজনৈতিক ঝড়ও আসছে। ’

 মির্জা ফখরুল যখন ‘ঝড় আসছে’ বলে উচ্ছ্বাস করছিলেন তখন দেশের মানুষ ছিল উদ্বিগ্ন, উৎকণ্ঠিত, আতঙ্কিত। উপকূলবাসী প্রিয় আপন ঠিকানা ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছিল আশ্রয় কেন্দ্রে। আবহাওয়া অধিদফতর, ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত ঘোষণা করেছিল। ঝড়, সাইক্লোন, টর্নেডো কোনো আনন্দের উপলক্ষ নয়। বিভীষিকা, মৃত্যু, আতঙ্ক, কান্না, আহাজারি। কিন্তু বিএনপি মহাসচিব এই তান্ডবে পুলক অনুভব করেছিলেন। একটি সুস্থ, জনঅধিকারে বিশ্বাসী কোনো রাজনৈতিক দল কখনো জনগণের দুর্দশা কামনা করতে পারে না। কিন্তু মির্জা ফখরুল রাজনৈতিক ঝড়ের পূর্বাভাস দিয়ে মানুষের কষ্টের আগাম বার্তা দিলেন। এ দেশের জনগণের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সিডর, আইলা, মোখা যেমন অপরিচিত নয়, তেমনি অপরিচিত নয় রাজনৈতিক ঝড়ের নামে সন্ত্রাস, সহিংসতা, অগ্নিসন্ত্রাস, অসাংবিধানিক শাসন।

রাজনৈতিক ঝড় দুই রকমের। এক ধরনের ঝড় সাময়িক স্বল্প সময়ের জন্য। যেমন ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের রাজনৈতিক টর্নেডো। এই দুর্যোগের আগুনে বাস পুড়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। কিন্তু এই ঝড় বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। আরেক ধরনের রাজনৈতিক ঝড় দীর্ঘমেয়াদি। যেমন ২০০৭ সালের রাজনৈতিক ঝড়। ওই তান্ডবের নাম ছিল এক-এগারো। ২০০৭ সালের রাজনৈতিক দুর্যোগ বাংলাদেশের জনগণকে ভুগিয়েছিল দুই বছর। তাহলে কি বিএনপি মহাসচিব আরেকটি এক-এগারো আনার ইঙ্গিত দিলেন।

শুধু ইঙ্গিত বলি কী করে বিএনপি কয়েক মাস ধরেই দেশে আরেকটি এক-এগারো আনার জন্য নিরন্তর চেষ্টা করছে। এক-এগারোর মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করেই তারা আওয়ামী লীগ সরকারকে হটাতে চাইছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আরেকটি অনির্বাচিত সরকারকে আনার কিছু দৃশ্যমান আলামতও পাওয়া যাচ্ছে। সম্প্রতি বিবিসির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন। যুক্তরাজ্য সফরকালে বিবিসির সাংবাদিক ইয়ালদা হাকিমকে তিনি একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। ওই সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র হয়তো আমাকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না বলেই বাংলাদেশে বিশেষ নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবাহী। যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের সম্পর্কের টানাপোড়েন এখন প্রকাশ্যে রূপ নিতে শুরু করেছে। তিন দেশ সফর শেষে গত সোমবার (১৫ মে) গণভবনে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধানমন্ত্রী।

ওই সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাম না বলে তিনি ঘোষণা করেন, যেসব দেশ আমাদের স্যাংশন দেবে, তাদের কাছ থেকে আমরা কিছু কিনব না। স্পষ্টতই শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করেই এ মন্তব্য করেছেন। প্রধানমন্ত্রী যখন সংবাদ সম্মেলন করছিলেন সে সময়েই ঢাকার পুলিশ কমিশনার জানালেন, যে চারটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা অতিরিক্ত প্রটোকল বা নিরাপত্তা সুবিধা পেতেন তা আর পাবেন না। সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রায় একই রকম ঘোষণা দেন। সিদ্ধান্ত ঘোষণার ধরন এবং প্রক্রিয়া ছিল বিভ্রান্তিকর। বুঝে না বুঝে এ নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। বিএনপি সরকারের এ সিদ্ধান্তের নিন্দা জানায়। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচিও ঘোষণা করেছে বিএনপি। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিএনপির উথলে পড়া দরদের রহস্য বুঝতে গবেষক হওয়ার দরকার নেই। একদা বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের কেউ ছিলেন মস্কোপন্থি। কেউ ছিলেন চীনপন্থি। সে সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কৌতুক প্রচলিত ছিল। কৌতুকটি ছিল এরকম-‘মস্কোতে বৃষ্টি হলে কমিউনিস্টরা বাংলাদেশে ছাতা ধরে। ’ জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে খালকাটা শুরু করলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতকে এতে আমন্ত্রণ জানানো হতো। সৌজন্যতার খাতিরে কোনো কোনো রাষ্ট্রদূত খালকাটা কর্মসূচিতে যোগ দিতেন। এরকম একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের বাংলাদেশস্থ রাষ্ট্রদূত। ব্যস। আর যায় কই, পরদিন থেকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা কোমর কষে কোদাল নিয়ে খাল কাটতে নেমে পড়লেন। রাজনীতিতে এ নিয়ে শুরু হলো হাস্যরস। কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরাও হতবাক।

পরে নেতারা ইনিয়ে-বিনিয়ে জানালেন, কৌশলগত কারণে তারা খালকাটা কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মীদের ওপর নির্যাতন বন্ধের জন্যই তাদের এই কৌশল। প্রটোকল বা এসকট প্রত্যাহার নিয়ে বিএনপির প্রতিক্রিয়া সেরকম একটি একান্ত অন্ধ অনুগত রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ। ওয়াশিংটনে বৃষ্টি হলে কি একদা চৈনিক বিএনপি নেতা ছাতা মেলে ধরেন আসলে ঘটনা কী বাংলাদেশে বহু দেশের দূতাবাস আছে। সব দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতরা একই রকম নিরাপত্তা সুবিধা পান না। এখানে কিছু দূতাবাসের রাষ্ট্রদূত ‘রাজা’দের মতো সুযোগ-সুবিধা পেতেন। তারা যেন প্রভু। কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতরা যখন এখানে ওখানে যেতেন তখন তাদের নিরাপত্তার নামে রীতিমতো বাড়াবাড়ি হতো। বাংলাদেশের সচিবরা তো নয়ই, মন্ত্রীরাও এমন প্রটোকল পান না। সরকার এখন এরকম কয়েকটি দেশের অতিরিক্ত নিরাপত্তা দেওয়া বন্ধ করেছে। ১৯৬১ সালের ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী একজন রাষ্ট্রদূত বা একটি দূতাবাসের নিরাপত্তা বিধানের জন্য যে ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত তার সবই নেওয়া হয়েছে।

শুধু তাদের বাড়তি খাতির বন্ধ করা হয়েছে। এটি রাষ্ট্রের স্বাভাবিক এবং সাধারণ একটি পদক্ষেপ। কিন্তু সরকারের একজন মন্ত্রী এবং পুলিশ কমিশনার যেভাবে আয়োজন করে সিদ্ধান্ত জানালেন মনে হলো ভয়ংকর এক কান্ড ঘটেছে। সরকারের এই ঘোষণা লুফে নিল বিএনপি। বাড়তি বা অতিরিক্ত কথাটি বাদ দিয়ে তারা এ নিয়ে এমনভাবে কান্নাকাটি শুরু করেছে যেন যুক্তরাষ্ট্রসহ রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাই প্রত্যাহার করা হয়েছে। সরকারের সঙ্গে যখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশ্য টানাপোড়েন তখন বিএনপি কি মার্কিন দূতাবাসের আস্থা অর্জনে মরিয়া কারণ বাংলাদেশে সব অসাংবিধানিক ক্ষমতা বদলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। অথচ বিএনপি ভুলে গেছে; তাদের শাসনামলে যুক্তরাজ্যের হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর সিলেটে কী ভয়ংকর হামলা চালানো হয়েছিল। বিএনপির মধ্যে স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার রোগ এখন প্রবলভাবে দৃশ্যমান। তারা শুধু বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের নিরাপত্তাদানের ব্যর্থতার কথাই ভুলে যায়নি, নিজেদের তাবৎ ব্যর্থতার কথাও ভুলে গেছে। লোডশেডিং, হাওয়া ভবনের দুর্নীতি, বাংলাভাইদের মতো সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের উত্থান।

১০ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনা  ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, বাজারে সিন্ডিকেট সবকিছু বিএনপি নেতাদের স্মৃতি থেকে মুছে গেছে। অথবা তারা ইচ্ছা করেই এসব ভুলে গেছেন। কারণ ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি যা করেছে; তা একবার যদি স্মরণ করত তাহলে বিএনপির কোনো নেতা এভাবে বুক চিতিয়ে কথা বলতে পারতেন না। লজ্জায় চোখ তুলে তাকাতেন না। বিএনপি নেতাদের ভুলে যাওয়ার তালিকায় আছে এক-এগারোর ঘটনাবলিও। এ জন্য তারা আবার সে রকম একটি অনির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতায় আনার জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছে। বিএনপি নেতারা হয়তো মনে করছেন; এরকম একটি সরকার এলে আওয়ামী লীগকে প্যাদানি দেবে আর বিএনপি আরাম আয়েশে ঘুরবে। বিষয়টি তেমন নয়।

অনির্বাচিত সরকার রাজনীতির প্রতিপক্ষ; অর্থনীতির বাধা; সাধারণ জনগণের শত্রু। আসুন একটু ‘ঝাপসা’ স্মৃতি পরিষ্কার করে নিই। ২০০৭ সালের ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা দখল করে প্রথমেই আক্রমণ করে রাজনীতির ওপর। ঢালাওভাবে গ্রেফতার শুরু হয় রাজনীতিবিদদের। রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিবাজ প্রমাণের এক নোংরা খেলা শুরু হয়। প্রভাবশালী গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন চলে। বিনা অভিযোগে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করে চালানো হয় বর্বর নির্যাতন। বিএনপির প্রয়াত নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের ‘কারাগারে কেমন ছিলাম’ কিংবা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের ‘কারাগারে লেখা অনুস্মৃতি, যে কথা বলা হয়নি। ’ এ দুটি গ্রন্থ পড়লেই যে কারও গা শিউরে ওঠে। আওয়ামী লীগ-বিএনপির নেতাদের গ্রেফতার করে টর্চার সেলে নেওয়া হতো। চালানো হতো নির্মম নির্যাতন। বিএনপি তখন ছিল সদ্য ক্ষমতা থেকে বিদায়ী দল। আওয়ামী লীগ ছিল বিরোধী দল। কিন্তু সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ নেতাদেরও ছাড়েনি। বরং আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে বেগম জিয়ার আগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। কাজেই, বিএনপি যদি মনে করে একটি সুশীল সরকার এসে তাদের জামাই আদর করবে, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার এলে বাংলাদেশ থেকে রাজনীতি নির্বাসিত হবে।

গণতন্ত্রের কবর রচিত হবে। অর্থনীতি ধ্বংস হবে। শুধু রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করেই ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বসে থাকেনি। তারা রাজনীতিতে কিছু মেরুদন্ডহীন চাকর-বাকরের সন্ধানে নেমেছিল। এই ভৃত্যদের দিয়ে প্রধান দুই দুটি রাজনৈতিক দলে ভাঙন ধরানোর নীলনকশা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল এক-এগারো সরকার। মাইনাস ফর্মুলা করে জনপ্রিয় দুই নেত্রীকে অসাংবিধানিকভাবে রাজনীতি থেকে বিদায় করতে চেয়েছিল সুশীলরা। যেন তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা যায়। মজার ব্যাপার হলো, সে সময় যারা ওই সেনাসমর্থিত সরকারের পদলেহন করত, সে সময় যারা সংস্কারপন্থি হিসেবে ঘৃণিত হয়েছিল, তখন যারা রাজনীতিকে কলঙ্কিত করেছিল- তারাই এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সবচেয়ে সোচ্চার। বিএনপিতে এক-এগারোর সময় যারা নিপীড়নের শিকার হয়েছিল, তারা এখন অনেকেই কোণঠাসা। সংস্কারপন্থিরা এখন বিএনপির ড্রাইভিং সিটে।

এক-এগারোর সময় যেসব লোভী নেতা সেনা গোয়েন্দাদের পায়ের কাছে বসে থাকতেন, তারাই এখন সরকারকে ফেলে দেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি চিৎকার করেন। তাহলে কি এক-এগারোর অসমাপ্ত এজেন্ডা সমাপ্ত করার মিশনে তারা এক-এগারো আসলে কী আমার বিবেচনায় বাংলাদেশকে পরনির্ভর এবং পঙ্গু বানিয়ে পশ্চিমাদের পুতুল রাষ্ট্র বানানোই এক-এগারোর মূল ধারণা। শুধু ক্ষমতা লিপ্সা থেকে সে সময় ক্ষমতার পালাবদল ঘটেনি। ড. ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদের শাসনামল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল সে সময়। দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হলো বেসরকারি খাত। বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে সেই সময় শুরু হয়েছিল কুৎসিত খেলা। শুরুতেই গ্রেফতার করা হয়েছিল বড় বড় শিল্প উদ্যোক্তাকে। তথাকথিত শীর্ষ দুর্নীতিবাজদের তালিকা ছিল মানহানিকর আপত্তিকর এবং আইনের প্রতি চরম অবজ্ঞা। এই তালিকা দিয়েই শুরু হয় নির্বিচারে চাঁদাবাজি। দেশের আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে হানা দেওয়া শুরু হয়। নানা অজুহাতে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের তুলে নিয়ে যাওয়া, মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করার আতঙ্কজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। অনেকে মানসম্মানের ভয়ে সারা জীবনের অর্জিত টাকা তুলে দেন রাষ্ট্রীয় চাঁদাবাজদের হাতে। কেউ দেশের বাইরে চলে গিয়ে দূর থেকে সর্বনাশের নির্মমতায় ডুকরে কেঁদেছেন। কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে ভোরের অপেক্ষায় ছিলেন। এক-এগারোর সময় দেশে বেসরকারি খাত থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত এই অর্থ আদায়কে অবৈধ ঘোষণা করেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও এই অর্থ ফেরত পাননি ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা।

বাংলাদেশের অর্থনীতির এক বড় স্তম্ভ হলো কৃষি খাত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ঝড়ে ল-ভ- হয়েছিল আমাদের কৃষিও। সারের উচ্চমূল্য ও সংকট, বিদ্যুতের অভাবে সেচ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে দিশাহারা হয়ে যান আমাদের কৃষক। ন্যায্যমূল্য না পেয়ে রাস্তায় উৎপাদিত আলু ফেলে প্রতিবাদ করেন তারা। কৃষক যখন অস্তিত্বের সংকটে তখন পাঁচতারকা হোটেলে আলু উৎসব করে এক নিষ্ঠুর তামাশা করেন তৎকালীন সেনাপ্রধান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হয় কারাগারে। শিক্ষকদের কোমরে দড়ি বেঁধে গোটা জাতিকে অপমানিত করা হয়। সাধারণ মানুষ এক দুর্বিষহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হন। নির্বিচারে ধরপাকড় গোটা দেশকে আতঙ্কপুরীতে পরিণত করে। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৭ সালে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের একটি তারবার্তা যায় ওয়াশিংটনে। তাতে বলা হয়, ‘নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত পুলিশ, আধাসামরিক বাহিনী ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনীর হাতে ৪৩ হাজার মানুষ গ্রেফতার হয়েছে। ’ (তথ্যসূত্র  এক-এগারো বাংলাদেশ ২০০৭-২০০৮, পৃষ্ঠা  ১৯৭)। নিম্ন আদালত নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল সেনাসমর্থিত সরকার দ্বারা।

এমনকি উচ্চ আদালত জামিন দিলেও ড. কামাল হোসেনের মতো মানবাধিকারের ঠিকাদার তার প্রতিবাদ করেন। আজ যারা বাংলাদেশের মানবাধিকার নিয়ে হাহাকার করেন, সেদিন তারা এর প্রতিবাদ করেননি। বরং মানবাধিকারের এই চরম লঙ্ঘনকে সমর্থন করেছেন। বাংলাদেশের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। বরং বলেছে বেশ বেশ। কিছু তাঁবেদার পরগাছা রাজনীতিবিদ, ভ- লোভী বুদ্ধিজীবী ছাড়া কেউ সেনাসমর্থিত ওই সরকারকে সমর্থন করেনি। তাহলে বিএনপি কি দেশে আবার সেরকম একটি পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে চায়

ঘূর্ণিঝড় বা প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন আঘাত হানার আগে কিছু লক্ষণ জানান দেয়। তেমনি রাজনৈতিক ঝড়েরও আগমনী পূর্বাভাস কিছু ঘটনাবলিতে বোঝা যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এখন আরেকটি রাজনৈতিক ঝড়ের আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দুর্যোগের প্রথম আলামত রাজনৈতিক অস্থিরতা। বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কীভাবে হবে তা নিয়ে এক অস্থিরতা এবং অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। বিএনপি রাজনীতিতে একটি উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টির ঘোষণা দিয়েছে। বিএনপি যদি সামনে জ্বালাও-পোড়াও এবং অগ্নিসন্ত্রাসের পথ বেছে নেয় তাহলে তা দুর্যোগকে ত্বরান্বিত করবে। এ ধরনের একটি পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য ক্ষমতাসীন দলেরও ব্যর্থতা থাকে। তাদের ভিতরও কিছু গোষ্ঠী গোপনে এ ধরনের দুর্যোগকে স্বাগত জানায়। আওয়ামী লীগ টানা ১৪ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায়। কিন্তু এ সময়ে সব দায়িত্ব একাই পালন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

অন্য কারও যেন কোনো কাজ নেই। মন্ত্রীদের একটি বড় অংশ অযোগ্য। কেউ কেউ দুর্নীতিতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। একজন প্রতিমন্ত্রী কদিন আগে বিস্ফোরক এক সাক্ষাৎকার দিয়েছেন কয়েকটি গণমাধ্যমে। সেখানে তিনি মন্ত্রীদের সিন্ডিকেট, দুর্নীতি এবং ব্যর্থতা নিয়ে খোলামেলা কথাবার্তা বলেছেন। সরকারের ভিতর অস্থিরতা প্রকাশ্য রূপ নিচ্ছে। সরকারের ভিতর সুবিধাবাদী, চাটুকারদের প্রচ- ভিড়। এরা সরকারপ্রধানকে সঠিক তথ্য দিচ্ছে না। প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা ষড়যন্ত্রকারী সুযোগসন্ধানীরা আস্তে আস্তে প্রকাশ্য হচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন। শেখ হাসিনা তাদের আবার ক্ষমতায় আনবেন এমন একটি ভাবনায় বুঁদ আওয়ামী লীগ। দলের অবস্থা হতশ্রী।

বিভক্তি কোন্দল কোন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তা গাজীপুর আর বরিশাল সিটি করপোরেশনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। এসব অনির্বাচিত সরকার আসার পূর্ব লক্ষণ। অনির্বাচিত সরকারের মাস্টারমাইন্ড হলো সুশীল সমাজ। এরা আসলে পশ্চিমা প্রভুদের এজেন্ট, পোষা প্রাণী। প্রভুদের কথায় এরা সবকিছু করে। এখন কোনো রকম রাখঢাক ছাড়াই এরা মাঠে নেমেছে। সরকারকে নাস্তানাবুদ করার জন্য সবকিছু করছেন ক্ষমতালিপ্সু সুশীলরা। সুশীলদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র। যাদের এখন বাংলাদেশ নিয়ে মাথাব্যথার শেষ নেই। গণতন্ত্র, মানবাধিকার ইত্যাদি ইসু্যুতে তারা কোণঠাসা করতে চাইছে সরকারকে। সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের মনস্তাত্ত্বিক কূটনৈতিক লড়াই এখন প্রকাশ্যে। এটাও অনির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা দখলের ইঙ্গিত। এক-এগারো আনার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন এই কূটনীতিকরাই।

তবে, এক-এগারো আঘাত হানতে গেলে দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার করতে হয়। অতীতে দেশে যতবার অগণতান্ত্রিক শাসন এসেছে প্রত্যেকবারই সেনাবাহিনীর একটি উচ্চাভিলাষী বিভ্রান্ত অংশের ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এখন অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে পেশাদার, বিশ্বমানের। নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকে তারা দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতীক হয়ে আছে। এ ধরনের বিভ্রান্তির প্রলোভনে গত ১৪ বছর তারা পা দেয়নি। এ কারণেই দুর্যোগ শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে আঘাত হানবে কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। আশার আরেকটি কারণ হলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহস, দৃঢ়তা এবং রাজনৈতিক দূরদর্শিতা। এ ধরনের দুর্যোগ সামাল দেওয়ার জন্য যে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা দরকার শেখ হাসিনার তা ভালোমতোই আছে। তার কারণেই এক-এগারোর তাণ্ডব থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পায়।  তার জন্য ২০১৪ এবং ২০১৫-এর রাজনৈতিক সাইক্লোন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

আকাশে মেঘের ঘনঘটা। কালবৈশাখীর আগে যেমন প্রকৃতি থমথম হয়ে যায়, বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন তেমন। শেখ হাসিনা কি পারবেন শেষ পর্যন্ত মোখা বাংলাদেশে আঘাত হানেনি।  সেন্টমার্টিনের একটি অংশের ওপর দিয়ে আঘাত হানে মিয়ানমারে। বাংলাদেশ রক্ষা পায় বড় প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে। রাজনৈতিক ঝড়ও কি এভাবে ঠিকানা বদল করবে।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত

[email protected]
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।