ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

চোরের মার বড় গলা

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৩
চোরের মার বড় গলা

‘অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি’- বিপ্লবী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের একটি কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি। সুকান্ত এ কথা লিখেছিলেন ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন আমলে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে।

ব্রিটিশরা বিদায় নিয়েছে, তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে পাকিস্তানি উপনিবেশিক শাসকদেরও। তারপরও সুকান্তের লাইনটি অনেক ঘটনায় মনে পড়ে যার একটি হলো যখন ‘চোর সিনা জোর’ করে কথা বলে।  কথাটি মনে পড়ল কয়েক দিন আগে প্রেস ক্লাবের সামনে দিয়ে যাত্রাকালে। দেখলাম গুটিকয়েক লোক পোস্টার নিয়ে কী যেন আবোল-তাবোল বকছে।

গানম্যানকে জিজ্ঞেস করায় সে জানাল সরকার তারেক রহমানের ‘দিনকাল’ নামক পত্রিকাটি বন্ধ করে দেওয়ায় এই লোকজন জড়ো হয়েছে। এতে অবাক না হওয়া কোনো মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। আইনের কথা বাদ দিয়ে এমনকি সাধারণ জ্ঞানও বলে যে, খুনের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিকে আগে প্রদান করা পত্রিকা প্রকাশের অনুমোদন চলতে দেওয়া যায় না। দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলো একটি প্রচারপত্র বিতরণ করছিল, পরে যার একটি আমি পেয়েছি। প্রচারপত্রে তারা যেসব উদ্ভট কথা লিখেছে তা আরও বেশি হাস্যকর এবং উন্মাদনাসম। লেখা রয়েছে যে, ২০০২ সালের ১৬ এপ্রিল ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তারেক জিয়াকে ওপরে উল্লিখিত পত্রিকাটির প্রকাশক হিসেবে সেটি প্রকাশের অনুমোদন প্রদান করলেও ২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর তারিখে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পত্রিকাটির অনুমোদন বাতিল করে দেন, আর তাই তাদের জটলা। সেই প্রচারপত্রে উল্লেখ রয়েছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ‘প্রেস আপিল বোর্ডে’ আপিল করেও তাদের লাভ হয়নি, আপিল খারিজ হয়ে গেছে।

ঘটনাটি বিস্তারিতভাবে জানার জন্য আমি আপিল বোর্ডের রায়ের একটি কপি সংগ্রহ করে জানতে পারলাম, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ‘দৈনিক দিনকাল’ কর্তৃপক্ষকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছিলেন আইনি প্রয়োজনীয়তা পূরণকল্পে। কিন্তু পত্রিকা কর্তৃপক্ষ কোনো জবাব দেয়নি। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ১৯৭৩ সালের ‘ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধীকরণ)’ আইনের ১০, ১১, ১৬ এবং ২০(১) (খ) ধারায় প্রাপ্ত ক্ষমতাবলে ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কর্তৃপক্ষের নামে কিছু লোক ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের’ প্রেস আপিল বোর্ডে আপিল করলে বোর্ড তথাকথিত আপিলকারীদের দরখাস্ত মোতাবেক আপিল শুনানি দীর্ঘ সময় মুলতবি করে অবশেষে ২০২৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি তাদের যুক্তিতর্ক শুনে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আপিল খারিজ করে দেন। তারেক রহমান খুনের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত একজন পলাতক আসামি এ কথা না বলে তথাকথিত আপিলকারীগণ ‘তারেক রহমান বিদেশে অবস্থান করছে’ বলে শুধু মিথ্যারই আশ্রয় নেয়নি, বরং আরও অনেক উদ্ভট কথা লিখে আপিল বোর্ডকে প্রতারিত করার চেষ্টা করেছে। বলা হয়েছে, তারেক রহমান আহমেদ আজম খান নামক বিএনপির এক সহসভাপতিকে ক্ষমতা প্রদান করে একটি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে জমা দিলেও দূতাবাস তা কার্যকর করেনি। দেখা যায় আপিলকারীদের পক্ষে কয়েকজন অ্যাডভোকেট ছিলেন। এ কথা তাদের অজানা থাকতে পারে না যে, ফৌজদারি মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি ফেরারি হয়ে গেলে দেশের কোনো কর্তৃপক্ষই তার অথবা তার পক্ষে পেশ করা কোনো আবেদন গ্রহণ করতে পারে না। আইনের দৃষ্টিতে একজন পলাতক আসামিকে বলা হয় ‘আউট ল’ অর্থাৎ আইনি অস্তিত্বের বাইরে। এমতাবস্থায় লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাস সম্পূর্ণ আইনসংগত কাজটিই করেছে, অন্যথায় দূতাবাস বেআইনি কাজে অভিযুক্ত হতো। দূতাবাসটি বাংলাদেশের এখতিয়ারবহির্ভূত এলাকায় হওয়ায় সেখানকার কর্মকর্তাদের পক্ষে তারেক জিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশে সোপর্দ করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশে হলে সেটি না করলে সংশ্লিষ্টদের অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতো। মাননীয় বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে আপিল বোর্ড যে রায় দিয়েছে তাতে ত্রুটি ধরার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই। বোর্ড বলেছে, ‘অত্র আদেশটি (জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের) পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, পত্রিকাটির প্রকাশকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অবস্থান করছেন, ফৌজদারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েছেন এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে অফিসের ঠিকানা ও ছাপাখানা পরিবর্তন করেছেন। ’ বোর্ড আরও লিখেছে “....দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশে অবস্থান করা, ফৌজদারি মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়া এবং ছাপাখানা পরিবর্তন করায় ‘ছাপাখানা ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধন) আইন ১৯৭৩’-এর যথাক্রমে ১০, ১১, ১৬, ২০(১)(খ) ধারা লঙ্ঘন করায় বাংলা ‘দৈনিক দিনকাল’ প্রকাশক ও মুদ্রাকর জনাব তারেক রহমানের নামে নিবন্ধনমূলে প্রদানকৃত পত্রিকাটির ঘোষণাপত্র ফরম (বি) এবং পত্রিকা মুদ্রণের ঘোষণাপত্র বাতিল করা হয়। ” বোর্ড উল্লেখ করেছে, “এই পত্রিকার মুদ্রাকর ও প্রকাশক তারেক রহমান অনেক দিন আগেই বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন এবং তার অনুপস্থিতির মেয়াদ ছয় মাসের অধিক। তাই তার পক্ষে দেওয়া ঘোষণাপত্র বাতিলযোগ্য। তদুপরি উক্ত তারেক রহমান বাংলাদেশের আদালত কর্তৃক কারাদন্ডে দন্ডিত হয়েছেন এবং বাংলাদেশে অনুপস্থিত আছেন। যার ফলে তিনি একজন দন্ডিত ব্যক্তি। কাজেই তার পক্ষে আইনত প্রকাশনা ও মুদ্রাকর হিসেবে কাজ করা কোনোভাবেই সম্ভবপর নয় এবং তার কর্তৃক পূরণকৃত ফরম (বি)-এর এফেক্ট থাকাও কোনোক্রমে সম্ভব নয়। ”

মাননীয় বোর্ড আরও লিখেছে, ‘ডিক্লারেশন আইন অনুযায়ী আমাদের কাছে এই অ্যাটর্নির কোনো মূল্য নাই। আমরা দেখবো প্রকাশক, মুদ্রাকর এবং সম্পাদক। ’ মাননীয় বোর্ড উল্লেখ করেছে, “বর্তমানে এই পত্রিকার কোনো প্রকাশক নাই। তারেক রহমান সাহেব নিজেই আদেশটি আইনত চ্যালেঞ্জ করতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা না করে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সাহেব এই আপিলটি দায়ের করেছেন। (জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের) আদেশটি ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের বিরুদ্ধে করা হয়নি। দেখা যাচ্ছে ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে আপিলকারীকে নিয়োগ দিয়েছেন মহাব্যবস্থাপক, আইনত এই নিয়োগ দেওয়ার কথা প্রকাশকের। ”

জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং মাননীয় আপিল বোর্ডের যথাযোগ্য রায়ের আলোকে কিছু কথা পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলা প্রয়োজন। খুনের মামলায় যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হয়ে তারেক জিয়া ফেরারি হওয়ায় সংশ্লিষ্ট আইনের ১০ এবং ১১ ধারায় তাকে প্রদান করা অনুমোদন নিশ্চিতভাবে বাতিলযোগ্য, যা না করলে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটই বেআইনি কাজের দায়ে অভিযুক্ত হতেন। একজন পলাতক আসামি আইনের দৃষ্টিতে অদৃশ্য বলে বিবেচিত হয় বিধায় কোনো কর্তৃপক্ষই তার অথবা তার পক্ষে অথবা তার দ্বারা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কারও কাছ থেকে কোনো আবেদন গ্রহণ করতে পারে না বলে লন্ডনের বাংলাদেশ দূতাবাস তার আমমোক্তারনামা গ্রহণ করতে পারে না। এমনকি পলাতক আসামির আমমোক্তারনামা কার্যকর করার চেষ্টা বা সেটি কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করাও ফৌজদারি অপরাধ। বাংলাদেশে এটি হলে সংশ্লিষ্ট নোটারি পাবলিক ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হতেন। তৃতীয়ত, ১৯৭৩-এর আইন পত্রিকার প্রকাশক হিসেবে অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতা প্রদান করেছে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটদের ওপর। কোনো আমমোক্তার দ্বারা অন্য ব্যক্তিকে প্রকাশকের স্থলাভিষিক্ত করার সুযোগ নেই। তাই এমনকি যদি তারেক জিয়া পলাতক না হয়ে যথার্থ আমমোক্তারনামা দ্বারা কথিত আহমেদ আজমকে প্রকাশক হিসেবে ক্ষমতা প্রদানের চেষ্টা করত, সেটিও কার্যকর হতো না। এ কথাও উল্লেখযোগ্য যে, এই আপিলটি মোটেও বিবেচনাযোগ্য ছিল না, যে কথা মাননীয় বোর্ড উল্লেখ করেছে, কেননা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশটি তারেক জিয়ার বিরুদ্ধে হওয়ায় তথাকথিত আপিলকারীদের কোনো আইনি অধিকার ছিল না আপিল করার। আপিল শুধু তারেক জিয়াই করতে পারত, কিন্তু ফেরারি হিসেবে এটি করা তার অথবা তার পক্ষে কারোরই সম্ভব নয়। তার দন্ডাদেশকে চ্যালেঞ্জ করে হাই কোর্টে আপিল করার সুযোগ খুনি তারেক জিয়ার ছিল বটে, কিন্তু আপিল করার সময়সীমা বেশ কয়েক বছর আগেই পার হয়ে গেছে।  আর তাই সে সব সময়ের জন্য খুনের দায়ে দন্ডিত আসামি হিসেবেই চিহ্নিত থাকবে।

শেষ করার আগে এটি না বললেই নয় যে, সব আইনজ্ঞ জলজ্যান্ত মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে খুনের দায়ে দন্ডিত তারেক জিয়ার দন্ডাদেশের কথা এবং তার ফেরারি হয়ে যাওয়ার কথা গোপন রেখে তাকে শুধু বিদেশে অবস্থানরত হিসেবে দেখানোর কথা বলে প্রেস কাউন্সিলের আপিল বোর্ড নামক ‘অর্ধ বিচারিক’ (কুয়াজাই জুডিশিয়াল) সংস্থাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছে এবং একজন পলাতক আসামির স্বার্থ রক্ষার তাগিদে আপিল করেছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা বার কাউন্সিলের জন্য অপরিহার্য। খুনের দায়ে দন্ডিত তারেক জিয়ার স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রেস আপিল বোর্ডে তথাকথিত আপিল করা নিশ্চিতভাবে আমাদের দন্ডবিধি আইনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, আর তাই এদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করাও আইনের শাসন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয়।  বস্তুত, ফেরারি আসামিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করাও শাস্তিযোগ্য অপরাধ, যে কাজটি তারা নিশ্চিতভাবে করেছে।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

বাংলাদেশ সময়: ০১২৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৩
এমএইচএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।