ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

মুক্তমত

প্রায়শ্চিত্ত করছে পাকিস্তান

তাপস হালদার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩
প্রায়শ্চিত্ত করছে পাকিস্তান

অবশেষে দেউলিয়া হওয়ার পথে পাকিস্তান। অনেক দেনদরবার করেও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণ পেতে ব্যর্থ হয়েছে।

২০১৯ সালে ইমরান খান সরকারের সময় সাড়ে ছয় বিলিয়ন ডলার ঋণের প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছিল আইএমএফ। কিন্তু ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে ঋণ আটকে যায়।  

বর্তমান শেহবাজ শরিফ সরকার দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে আইএমএফের কাছে প্রথম কিস্তিতে ১.১ বিলিয়ন ঋণ চেয়েছিল। আইএমএফ পাকিস্তানকে এই মুহূর্তে ঋণ দিতে আস্থায় পাচ্ছে না।  

এরই মধ্যে রিজার্ভ তিন বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। অলৌকিক কিছু না ঘটলে আগামী এক মাসের মধ্যে পাকিস্তানে ভয়ংকর অর্থনৈতিক বিপর্যয় নেমে আসবে।

পাকিস্তানের এই অবস্থার জন্য রাজনৈতিক অস্থিরতারই দায়ী। স্বাধীনতার ৭৫ বছরেও সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ২৩ জন শাসকের কেউই ক্ষমতার মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। ২৫ বছর ছিল সরাসরি সামরিক শাসন, আর বাকি ৫০ বছরও গণতান্ত্রিক সরকারগুলো সামরিক শাসকদের হাতের পুতুল ছিল।


বর্তমান সময়ে নজিরবিহীন অর্থনৈতিক সংকটে টালমাটাল পাকিস্তান। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে মানুষ দিশাহারা। রিজার্ভ প্রায় শূন্য। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে আমদানি বন্ধ। জ্বালানিসংকটে বেশির ভাগ কারখানাই বন্ধ হওয়ার পথে। গ্যাসসংকটে বেশির ভাগ বিদ্যুেকন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে গোটা দেশ। মুদ্রাস্ফীতি ২৭.৫৫ শতাংশ, যা দীর্ঘ ৪৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এক হাতে পারমাণবিক বোমা, অন্য হাতে ভিক্ষার থালা।

গত বছর ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়েছিল শ্রীলঙ্কা। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে প্রেসিডেন্টকে বিদেশে পালিয়ে চলে যেতে হয়েছিল। তখনই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো খুব দ্রুত আরো এক ডজন দেশের শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল। সেখানে পাকিস্তান, ইউক্রেন, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, মিসর, এল সালভাদর, বেলারুশ, ইকুয়েডর, নাইজেরিয়া, আর্জেন্টিনার মতো দেশগুলোকে মারাত্মক ঝুঁকির দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, পাকিস্তান ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে খুব দ্রুত শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি হবে।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় মোট জনসংখ্যার ৫৬ শতাংশ জনগণ পূর্ব পাকিস্তানে ছিল। তা সত্ত্বেও শুরু থেকেই রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক, শিক্ষা, প্রশাসনিকসহ প্রতিটি ক্ষেত্রেই পূর্ব পাকিস্তানকে পদে পদে বঞ্চিত করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এই বঞ্চনার প্রথম প্রতিবাদের প্রকাশ ঘটে। ভাষা আন্দোলন থেকেই ধীরে ধীরে স্বাধিকার আন্দোলনে পরিণত হয়। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের অন্যায়, শোষণ, নির্যাতন ও অবিচারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানের ধর্ম-বর্ণ-গোত্র-নির্বিশেষে সব মানুষ স্বাধীনতার মন্ত্রে একত্র হয়েছিল বলেই বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা অর্জিত হয়।

১৯৭১ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বেশির ভাগ অর্থনৈতিক সূচকে পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরই বাংলাদেশের অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে। ১৯৭১ সালে মাথাপিছু আয় জিডিপির বিচারে পাকিস্তান ৭০ শতাংশ এগিয়ে ছিল। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় দুই হাজার ৮২৪ ডলার (২০২২), অন্যদিকে পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৬৭১ ডলার। পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে বৈদেশিক মুদ্রার মাত্র ১৭ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তান পেয়েছিল এবং বাকি ৮৩ শতাংশ ব্যয় হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। ব্যাংকের আমানতের মাত্র ৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তান ও ৯২ শতাংশ পেত পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা। কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটের মাত্র ২৮ শতাংশ পূর্ব পাকিস্তান ও ৭২ শতাংশ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হতো। পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বাঙালিদের অংশগ্রহণ ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত ব্যক্তি খাতে শিল্প-কারখানার মালিকানা মাত্র ১১ শতাংশ ছিল বাঙালিদের হাতে, বাকি ৮৯ শতাংশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি কিংবা অবাঙালিদের হাতে। বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন করে পাকিস্তানের তিনটি প্রধান শহর করাচি, রাওয়ালপিন্ডি ও ইসলামাবাদ নির্মাণ করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন পাকিস্তানি শাসকদের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়, তখন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চিরতরে ধ্বংস করার জন্য এ দেশে অবস্থিত প্রায় সব ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে দেশীয় অর্থ, সোনা ও বৈদেশিক মুদ্রা পাকিস্তানে পাচার করে নিয়ে যাওয়া হয়।

বাংলাদেশ শূন্য ভাণ্ডার দিয়ে যাত্রা শুরু করে মাত্র ৫০ বছরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সব সূচকেই পাকিস্তানকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানের প্রায় দ্বিগুণ। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাংলাদেশ ৩৪ বিলিয়ন ডলার, পাকিস্তান ৩০৯ কোটি ডলার, যা ১১ গুণেরও বেশি। এক ডলার সমান বাংলাদেশের ১০৭.৩৫ টাকা, অন্যদিকে পাকিস্তানের ২৭৬.৫০ রুপি। অর্থাৎ বাংলাদেশের এক টাকা সমান পাকিস্তানের ২.৫৭ রুপি। বাংলাদেশের টাকা পাকিস্তানি রুপির চেয়ে বর্তমানে আড়াই গুণের বেশি শক্তিশালী। বাংলাদেশের শতভাগ জনগণ বিদ্যুৎ পায়, পাকিস্তানে ৭৩ শতাংশ। বাংলাদেশের জনগণের গড় আয়ু ৭২.৮ বছর, পাকিস্তানের ৬৬ বছর। বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার ৭৫ শতাংশ, পাকিস্তানের ৫৯ শতাংশ। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২ শতাংশ, অন্যদিকে পাকিস্তানে ২.১ শতাংশ। বাংলাদেশে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ২১ জন, পাকিস্তানে ৫৯ জন। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ ৩৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ২৩ শতাংশ। দারিদ্র্যের হার ২০.৫ শতাংশ, পাকিস্তানে ৪৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়, এশিয়ারই অন্যতম সেরা অর্থনীতির দেশ। অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিটি সূচকে পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে, অনেক ক্ষেত্রে ভারত থেকেও এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদ, সুধীসমাজ এমনকি রাজনীতিবিদদের প্রায়ই বাংলাদেশের উদাহরণ দিতে দেখা যায়। উন্নয়নের জন্য ‘বাংলাদেশ মডেল’-এর কথা জোর দিয়ে বলা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর মতে, বাংলাদেশ এখন ৩৫তম অর্থনীতির দেশ। ২০৩০ সালে ২৫তম এবং ২০৪১ গিয়ে দাঁড়াবে ২১তম দেশে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশের দারিদ্র্য ছিল ৭৫ শতাংশ বেশি, কিন্তু এখন পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ ৪৫ শতাংশ ধনী রাষ্ট্র। পাকিস্তানি অর্থনীতিবিদদের অনেকে মনে করেন, ২০৩০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানের সাহায্য চাইতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রশংসা করে পাকিস্তানের গণমাধ্যমগুলোতে একাধিক নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে পাকিস্তান সরকারকে শেখ হাসিনার কাছ থেকে শেখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৪ বছর ধরে একটি টেকসই প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছেন। পাকিস্তানের মধ্যেই আওয়াজ উঠছে সিঙ্গাপুর কিংবা নিউ ইয়র্ক নয়, আমাদের বাংলাদেশ বানিয়ে দাও।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে পাকিস্তান থেকে সব সূচকে এগিয়ে থেকে ৩০ লাখ শহীদ ও দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর ঋণ কিছুটা হলেও শোধ করতে পেরেছে বাংলাদেশ। অন্যায়, অত্যাচার ও নিপীড়নের ফলাফল কী হতে পারে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে পাকিস্তান। এটা তাদের কৃতকর্মের ফল।

 লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

বাংলাদেশ সময়: ১১২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৩  
এসআইএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।