ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জীবনযাপন

কোরআন তেলাওয়াতে চিন্তা, ভাবনা ও গভীর অভিনিবেশ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৮ ঘণ্টা, মে ২৩, ২০১৯
কোরআন তেলাওয়াতে চিন্তা, ভাবনা ও গভীর অভিনিবেশ ছবি : প্রতীকী

পবিত্র রমজান মাস একদিকে যেমন সিয়াম-কিয়াম ও দান-সদকার মাস, অন্যদিকে তেমন এটা কোরআনেরও মাস। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘রমজান মাসই হল সে মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুষ্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী।’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৮৫)

কোরআনে আরো বলা হয়েছে, ‘আমি একে নাজিল করেছি শবে-কদরে। ’ (সুরা ক্বদর, আয়াত: ০১) আরো ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি একে নাজিল করেছি।

এক বরকতময় রাতে, নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। (সুরা দুখান, আয়াত: ০৩)

আল্লাহ তাআলা কোরআনকে এমন এক আলো হিসেবে অবতীর্ণ করেছেন, যা কখনো নির্বাপিত হয় না। এটা এমন এক প্রোজ্জ্বল প্রদীপ যার প্রভা কখনো দূরীভূত হয় না। এটা মানুষকে সুপথ দেখায়, বিভ্রান্ত করে না। এটা এমন এক মর্যাদাবান কিতাব যার ধারক-বাহকরা কখনো পরাজিত হয় না। এই পবিত্র কোরআন হলো ঈমানের খনি এবং জ্ঞানের ফোয়ারা। আল্লাহ তাআলা একে আলেমদের তৃষ্ণা নিবারণ এবং ফিকাহবিদদের হৃদয়ের বসন্ত বানিয়ে দিয়েছেন। এটা এমন এক ঔষধ যার মাধ্যমে অন্তরের রোগ দূর হয়ে যায়।

কোরআন হল আল্লাহর সুদৃঢ় রজ্জু, প্রজ্ঞাময় উপদেশ, সঠিক পথনির্দেশ। এতে রয়েছে আমাদের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা। এটি আমাদের মাঝে পার্থক্যরেখা টেনে দেবে।  এটিই সত্য কিতাব। এটি কোন খেল-তামাশার বিষয় নয়। আল্লাহ তাআলা একে সত্য সহকারে অবতীর্ণ করেছেন। এর উপর যে আমল করবে তাকে প্রতিদান দেয়া হবে। এর মাধ্যমে যে বিচারকার্য পরিচালনা করবে সে ন্যায়বিচার করবে। যে এর প্রতি আহ্বান জানাবে সে সঠিক পথ প্রাপ্ত হবে। যে এর মাধ্যমে হেদায়েত তালাশ করবে আল্লাহ তাআলা তাকে মর্যাদাবান করবেন। যে এছাড়া অন্য কিছুর মাধ্যমে হেদায়েত তালাশ করবে আল্লাহ তাআলা তাকে লাঞ্ছিত করবেন। আল্লাহ তাআলা কোরআনের মাধ্যমে অনেক জাতিকে মর্যাদাশীল করেন আর অনেক জাতি কোরআন ছেড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কেয়ামতের দিন কোরআন তার ধারক-বাহক এর জন্য সুপারিশকারী হবে। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহ তাআলার কিতাবের একটি হরফ যে ব্যক্তি পাঠ করবে তার জন্য এর সাওয়াব আছে। আর সাওয়াব হয় তার দশগুণ হিসেবে। আমি বলি না যে, ‘আলিফ-লাম-মীম’ একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ। (তিরমিজি, হাদিস নং: ২৯১০)

পবিত্র কাবাঘরের সামনে খুতবা দিচ্ছেন শাইখ সাউদ আশ-শুরাইম।  ছবি: সংগৃহীত

আল্লাহ তাআলার এ কিতাব নিশ্চয়ই জীবনের জন্য এক আধ্যাত্বিক প্রত্যাবর্তনস্থল এবং হেদায়েতের আলোকপ্রদীপ। যে এ কিতাব পাঠ করে না এবং এর উপর আমল করে না সে জীবিত নয়, বরং মৃত। যদিও সে কথা বলে, কাজ-কর্ম করে বা চলাফেরা করে। আর যে এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে না সে আকাশে থাকুক বা সমুদ্রের তলদেশে থাকুক পথভ্রষ্ট হবেই, সুপথ প্রাপ্ত হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেন, যে ব্যাক্তি মৃত ছিল, যাকে আমি পরে জীবিত করেছি এবং যাকে মানুষের মধ্যে চলার জন্য আলোক দিয়েছি, সে ব্যাক্তি কি ঐ ব্যাক্তির মতো যে অন্ধকারে রয়েছে এবং সেখান থেকে আর বের হবার নয়? (আল আনআম, আয়াত: ১২২)

কোরআনবিহীন মানুষের জীবন, পানি আর বাতাসবিহীন জীবনের মতো। বরং যেন মনে-প্রাণে, ভাবে-অনুভবে শুধু শূন্যতা আর শূন্যতা। এ সময়ই প্রয়োজন কোরআনি ওষুধ। কোরআনই এসবের শেফা। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর আমি নাজিল করি কোরআন, যা মুমিনদের জন্য শেফা ও রহমত। (আল-ইসরা, আয়াত: ৮২)

আর যদি আমি এটাকে করতাম অনারবী ভাষায় কোরআন তবে তারা অবশ্যই বলত, ‘এর আয়াতগুলো বিশদভাবে বিবৃত হয়নি কেন? ভাষা অনারবীয়, অথচ রাসুল আরবীয়! বলুন, ‘এটি মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও শেফা। ’ আর যারা ঈমান আনে না তাদের কানে রয়েছে বধিরতা এবং কোরআন এদের (অন্তরের) উপর অন্ধত্ব তৈরী করবে। (ফুসসিলাত, আয়াত: ৪৪)

কোরআন মানুষের জন্য শেফা। মানুষের আত্মিক ও দৈহিক আরোগ্য লাভের মাধ্যম। জীবনের পথ-পরিক্রমা সংকীর্ণ হয়ে গেলে এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অনুসন্ধানকারী পথ হারালে এই কোরআনই সঙ্গ দেয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন পথে আলো বিলিয়ে যায় এ কোরআন। কোরআনই হল মানুষের সর্বোত্তম বন্ধু, যা আলোচনা ও পুনরাবৃত্তিতে বিরক্ত হয় না। এতে শুধু সাজ-সজ্জা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়।

মুমিন যখন কোরআন তেলাওয়াত করে তখন তার অন্তর এবং সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শান্তি ও প্রশান্তিতে ছেয়ে যায়। এর মাধ্যমে তার অন্তরাত্মা উন্নত হয়। সে কিছুরই পরোয়া করে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এই আয়াতই তেলাওয়াত করে সে, হে নবী আপনি বলে দিন, আমাদের কাছে কিছুই পৌঁছবে না, যা আল্লাহ আমাদের জন্য রেখেছেন তা ছাড়া। (সুরা তাওবা ৯:৫১)

এর মাধ্যমে মন্দ কাজের কুমন্ত্রণা এবং দুর্বলতা বাষ্পে পরিণত হয়। আসলে মানুষ বাস্তবতার চেয়ে সন্দেহের মাধ্যমে বেশি পরীক্ষিত হয় এবং বাস্তব জীবনে পরাজিত হওয়ার আগেই মনে-প্রাণে পরাজিত হয়ে যায়।

একশ্রেণীর মুসলমান তার প্রভূর কিতাব কোরআনুল কারিমের প্রতি অবহেলা করে। এমনকি কেউ কেউ পবিত্র কোরআন খতম করে কিন্তু এর কোনো অর্থই সে বুঝতে পারে না। আরেকশ্রেণীর মুসলমান পবিত্র কোরআনকে শুধু বিশুদ্ধরূপে পাঠ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আরেক শ্রেণীর মুসলমান পবিত্র কোরআন খুলে এবং বন্ধ করে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে। পাঠ করে নির্লজ্জ বেসুরা সুরে। কেউ কেউ শোক-সমাবেশ ও বিভিন্ন মাহফিলে একে পুনরাবৃত্তি করে। কেউ কেউ এর মাধ্যমে মাল কামাই করতে চাই। আর কেউ কেউ  এর মাধ্যমে তাবিজ বানিয়ে ঘাড়ে ঝুলিয়ে রাখে, কেউবা বুকে লাগিয়ে রাখে।

কোরআনের আয়াত নিয়ে চিন্তা, ভাবনা ও গভীর মনোনিবেশ দুনিয়া এবং আখেরাতে বান্দার জন্য অধিক উপকারী, মুক্তি ও সৌভাগ্যের জন্য অধিক নিকটবর্তী। এর মাধ্যমে বান্দা ভালো-মন্দ বুঝতে পারে। এর মাধ্যমে তার অন্তরে দুনিয়ার দৃশ্য ফুটিয়ে তোলা হয় এবং বিভিন্ন জাতির মাঝে তাকে উপস্থিত করা হয় এবং ঐসব ঘটনা তাকে স্মরণ করানো হয়, যা তাদের মাঝে ঘটেছে। অতঃপর সে দেখে নূহ আ. এর জাতির পানির নিচে নিমজ্জিত হওয়া, আদ এবং সামুদ জাতির বজ্রাঘাতে মৃত্যু হওয়া। ফেরাউন পানির নিচে নিমজ্জিত হওয়া এবং কারুনের মাটির নিচে দেবে যাওয়া সম্পর্কে জানতে পারে।

অনেক উপদেশসমৃদ্ধ আয়াত আমরা তেলাওয়াত করছি, অনেক ঘটনাবলী শুনছি, অনেক সুরা পাঠ করছি- কিন্তু এগুলো ডান কান দিয়ে ঢুকছে আর বাম কান দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আমাদের মধ্যে কে আছে, যে সুরা আল হাক্কা তেলাওয়াতের সময় দু’ফোঁটা তপ্ত অশ্রু ঝরায়? সুরা জিলযালের তেলাওয়াত শুনে কার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে? কে তওবা করে যখন সে সুরা আল-কিয়ামাহ পড়ে? আমাদের অন্তরে কি মরিচা ধরে গেল? আমাদের অন্তরে কি পাথর চেপে বসল? যদি এই কোরআন পাহাড়ের ওপর অবতীর্ণ হত, তবে পাহাড় বিনীত হয়ে আল্লাহ তাআলার ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে যেত। কিন্তু আমাদের অন্তর নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। কোরআনের ভাষায়- ‘তা পাথরের মতো অথবা তদপেক্ষাও কঠিন। পাথরের মধ্যে এমন ও আছে; যা থেকে ঝরণা প্রবাহিত হয়, এমনও আছে, যা বিদীর্ণ হয়, অতঃপর তা থেকে পানি নির্গত হয় এবং এমনও আছে, যা আল্লাহর ভয়ে খসে পড়তে থাকে! আল্লাহ তোমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে বে-খবর নন। ’ (সুরা বাকারা ২:৭৪)

কঠোর এবং গাফেল হৃদয় থেকে আমরা আল্লাহর আশ্রয় প্রার্থনা করছি।

অনুবাদ: সাঈদ হোসাঈন

শাইখ সউদ বিন ইবরাহিম আশ-শুরাইম: সিনিয়র ইমাম ও খতিব, পবিত্র মসজিদুল হারাম, মক্কা মুকাররামা, সৌদি আরব

অনুবাদক: আলেম-গবেষক ও সমকালীন বিশ্লেষক

রমজানবিষয়ক যেকোনো লেখা আপনিও দিতে পারেন। লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৮ ঘন্টা, মে ২৩, ২০১৯
এমএমইউ

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জীবনযাপন এর সর্বশেষ