ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

উপন্যাস

নীল উড়াল: চতুর্দশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫০৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৭
নীল উড়াল: চতুর্দশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অস‍ৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

১৪.
ডা. ফাহমিদের কাছ থেকে চিকিৎসা দর্শন সম্পর্কে পাওয়া আশাবাদ ভেঙে গেল একটি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে গিয়ে। চিকিৎসকের নীতি-দর্শন, আসক্ত ব্যক্তির চিকিৎসার নানা তত্ত্ব কথা শুনেছিলাম।

বাস্তবে দেখা গেল অন্য রকম ব্যাপার। ইংরেজি প্রবাদের মতো: ‘দেয়ার ইজ গাল্ফ অব ডিফারেন্স বিটুইন লিপ্স অ্যান্ড কাপ। ’ কাপ আর ঠোঁটের মধ্যে দেখছি সমুদ্র-সমান বিস্তর ব্যবধান।

 নীল উড়াল: ত্রয়োদশ পর্ব

ফার্মগেটের কাছে অবস্থিত মাদকাসক্তি কেন্দ্রটির নাম বেশ জাঁকালো ‘ফ্রি ফ্রম এডিকশন’। ঢাকায় এখন শত শত এমন কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। জেলা ও মফঃস্বল শহরেও নাকি এন্তার মাদক নিরাময় কেন্দ্র রয়েছে। যার চাহিদা থাকে, সেটাই বাড়-বাড়ন্ত হয়। পোশাক শিল্পাঞ্চলের কাছাকাছি দেখা যাবে অগণিত মেটারনিটি। নারী শ্রমিকদের শারীরিক বিষয়ের নানা অজ্ঞতায় তৈরি হওয়া বহু-বিচিত্র যৌন জটিলতার অবসান ঘটানো হয় সেগুলোতে। চূড়ান্ত মুহূর্তে অজ্ঞ আয়া ও নার্সের হাতে বছরে বহু মেয়ে কুচিকিৎসায় প্রাণ হারায়। তখন ফুটপাতে, ডাস্টবিনে সদ্য প্রসূত জীবিত বা মৃত শিশু পড়ে থাকার খবর পাওয়া যায়।

‘ফ্রি ফ্রম এডিকশন’ ঝকঝকে, সাজানো, গোছানো। অভিজাত রেস্ট হাউজও বলা চলে। রিসিপশনের তরুণী মেয়ে সাগ্রহে আমাকে গ্রহণ করল:
-বলুন আপনার জন্য কি সাহায্য করতে পারি ?

কথার চেয়ে মেয়েটির চোখ, ভ্রু, ঠোঁট কাজ করছে বেশি। হয়ত এসব তার চাকরি যোগ্যতার পূর্বশর্ত। তাকে মৃদু কণ্ঠে বলি:
-আমি একজন রোগী ভর্তি করাতে চাই। আপনাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার ধরণ ও খরচ সম্পর্কে জানতে এসেছি।

একটি ব্রুশিয়র আমার দিকে এগিয়ে দিল মেয়েটি:
-এতে সব লিখা আছে। পড়ে দেখুন।

রঙিন চমৎকার ব্রুশিয়র। ঝকঝকে ছাপা। নানা যন্ত্রপাতি আর আরামদায়ক থাকার ব্যবস্থাগুলোর সচিত্র বিবরণ দেওয়া। খরচ-পাতির কথাও বলা আছে। পড়া শেষে আমি মন্তব্য করি:
-বেশ কস্টলি ও এক্সপেন্সিভ মনে হচ্ছে?

মেয়েটি হাল্কা মাথা নাড়ল:
-আপনাকে কি কোনও ডক্টর রেফার করেছেন এখানে? তার নাম বলুন। আমরা কথা বলে কমিশন দিয়ে আপনার জন্য প্যাকেজ বানিয়ে দিচ্ছি।

আমি অসম্মতিতে জানাই:
-না, না। আমি নিজেই এসেছি। আমার কোনও চিকিৎসকের রেফারেন্স নেই।

এবার মেয়েটি বললো:
-তাহলে আপনি ডাইরেক্টর ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলুন। আপনার কথা শুনে তিনি ট্রিটমেন্ট প্রসেস সম্পর্কে আপনাকে জানাবেন।

একজন নার্স দোতলায় ডাইরেক্টর ম্যাডামের কাছে নিয়ে গেল। দরজায় নাম লিখা দেখতে পেলাম ‘মিসেস খোন্দকার’। একতলা থেকে আসতে নজর কাড়লো দেয়াল, পর্দা, আসবাব, সব কিছু গোলাপী রঙের। নেশা ধরানো অবস্থা। রিসেপশনের মেয়েটি মনে হচ্ছে আমার আগমনের কথা মিসেস খোন্দকারকে ফোনে জানিয়ে থাকবে। অতি সানন্দে তিনি আমাকে রিসিভ করলেন:
-আসুন, আসুন।

একটি চেয়ার টেনে বসতে বসতে আমি বলি:  
-ধন্যবাদ। সব হাসপাতালে দেখি সাদা রঙ ব্যবহার করা হয়। আপনারা এতো গোলাপী রঙ অ্যাপ্লাই করেছেন কেন?

কৌতুহল চেপে রাখতে না পেরে বসতে বসতে আমি প্রশ্ন করি। মিসেস খোন্দকার স্মার্টলি জবাব দেন:
-আপনি খুবই তীক্ষ্ণ দৃষ্টির মানুষ। ঠিকই ধরেছেন। আমরা প্রথাগত অর্থে হাসপাতাল চালাই না। এটা নিরাময় কেন্দ্র। নেশার জগত কাটাতে আরেক নেশা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য চারদিকে গোলাপী রঙের স্বপ্নের জগত তৈরি করেছি।

নিজের উত্তরে নিজেই যেন খুব মজা পেয়েছেন, এমন ভঙ্গিতে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলেন মিসেস খোন্দকার। ভদ্রমহিলার বয়স চল্লিশ ছুঁই ছুই করছে। কিন্তু এখনও অটুট যৌবন। মজবুত শরীরের গাঁথুনি। হাসির রেশ টেনেই বললেন:
-চলুন কফি খেতে খেতে আলাপ করি। কফি বলি?

আমি সম্মতি জানালাম। আলাপের জন্য পরিবেশ তৈরি করাটাও জরুরি। কফির কথা বলে আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন ভদ্রমহিলা:
-আপনার জন্য কি করতে হবে বলুন?

সরাসরি ইস্যুতে যাওয়ার আগে একটু খেলিয়ে নেওয়া ভালো। আমি আস্তে আস্তে সুতা ছাড়ছি:
-আপনাদের ফিচার ও ফ্যাসিলিটি জানতে পারলে আমার সুবিধা হবে। ব্রুশিয়র পড়ে পুরোটা বুঝতে পারি নি।

মিসেস খোন্দকার সবিস্তারে জানাচ্ছেন:
-সব ধরনের সহযোগিতার জন্য আমরা প্রস্তুত। আপনার রিকোয়ারমেন্ট শুধু আমাদের জানান। ওকে। আপনাকে ডিটেলে বলছি। কাগজের লিখায় সব বলা হয় নি।

কফি এসে গেছে। মিসেস খোন্দকার দীর্ঘ বক্তব্যের পূর্বপ্রস্তুতিমূলক ভঙ্গিতে কফির কাপে লম্বা চুমুক দিয়ে বললেন:
-আপনাকে তা হলে খুলেই বলি। এখানে আমরা অনেকগুলো কামরার ব্যবস্থা রেখেছি। হাসপাতালের কেবিন বলতে পারেন। একেকটির চার্জ একেক রকম। থ্রি-স্টার, ফাইভ-স্টার হোটেলের মতো স্যুটও আছে এখানে। আপনি নিশ্চয় জানেন বড় লোকদের সংসারে ড্রাগস হু হু করে ঢুকে গিয়েছে। বাপ-মা বাচ্চাদের খেয়াল রাখার সময় পায় না। তলে তলে ছেলে-মেয়েরা নানা হতাশায় ড্রাগসে জড়িয়েছে। অনেকে পারিবারিক শান্তির জন্য, সামাজিক লজ্জা এড়াতে ছেলে-মেয়েদের এখানে রেখে যায়। আমরা তাদের দেখা-শোনা করি। কেবিনে এসি, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক সব আছে। বন্ধু-বান্ধবীদের আসতে-যেতে বা রাত কাটানোরও আমরা ব্যবস্থা রাখি। পার্টির প্লেজার দেখাই আমাদের বিজনেস মটো।

আমি উৎসাহ দিয়ে বলি:
-বাহ! বেশ ভালো ব্যবস্থা তো আপনাদের? তো চিকিৎসার কি হয়?

আমার প্রশংসায় ভদ্রমহিলা খুশি মনে বলতে লাগলেন:
-ড্রাগসের সে রকম চিকিৎসা নেই। যারা সিরিয়াস তাদেরকে মাদক থেকে সরিয়ে আনার ব্যবস্থা আছে। সেটা কত দিন স্বাভাবিক থাকে, সে গ্যারান্টি দিতে পারব না।

আমি অবাক হই:
-তাহলে?

মিসেস খোন্দকার জানান:
-বাসায় নেশা নিতে পারে না, নিলেও ভায়োলেন্ট হয়ে গণ্ডগোল করে, এমন পেশেন্টই এখানে বেশি। আমরা ড্রাগসের ব্যবস্থাও রেখেছি। ওদের চাহিদা মতো সাপ্লাই দিই। অনেক সময় বিরাট ধনী যৌন ব্যর্থতায় আক্রান্ত হয়ে প্রচণ্ড হতাশা নিয়ে এখানে আসে। আমরা ইয়াবা বা ভায়েগ্রা দিয়ে তাকে চাঙ্গা করি। ক্লায়েন্টদের কেবিনে ফ্রি সেক্স, ডিংকস, ড্রাগসে আমরা বাধা দিই না।

আমার পোশাকের নীচে জামা-কাপড় ভিজে ঘাম ছাড়ছে। একি! এগুলো কী নিরাময় কেন্দ্র না আশ্রয় কেন্দ্র! মিসেস খোন্দকারকে আমার মনের অবস্থা বিন্দু মাত্র বুঝতে দিলাম না। ভদ্রমহিলা এখন বলার মুডে আছেন। তাকে দিয়ে যতটুকু পারা যায়, বলিয়ে নেওয়াই ভালো। তাকে আরও উস্কে দিয়ে আমি বলি:
-আসলেই আপনারা খুব সেফ অ্যারেঞ্জমেন্ট রেখেছেন।

মিসেস খোন্দকার প্রশংসায় আরও খুশি হলেন। সপ্রতিভভাবে বললেন:
-এ ব্যাপারে আপনি শতভাগ নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। প্রশাসন, পুলিশ, মাস্তান, সবাই আমাদের হাতের মুঠোয়। আমাদের এখানে নির্বিঘ্নে আনন্দ ও উপভোগ করতে পারবেন। কেউ তাকিয়েও দেখবে না। আমাদের কাজের সঙ্গে কিছু চিকিৎসকও পার্টনার আছেন। তারা আপনার প্রেসার, স্যুগার দেখে আপনার জন্য ড্রাগসের ডোজ ঠিক করে দেবেন। আপনি শুধু এনয়জ করতে থাকুন। বাকী সব ঝামেলা আমাদের।
আমি আগ্রহী ক্লায়েন্টের ভঙ্গি নকল করে জানতে চাই:
-আচ্ছা মিসেস খোন্দকার, ড্রাগসের সাপ্লাই আপনারা কোত্থেকে পান? আসল জিনিস পাওয়া যায় তো?

মাত্র এক মুর্হূত ভদ্রমহিলা আমাকে জরিপ করলেন। তারপর নির্দ্বিধায় বললেন:
-আমাদের এখানে সবই আসল। বিজনেস সিক্রেট ও সোর্স আপনাকে বলবো না। আপনি যে ড্রাগস চান, সেটাই আমরা দ্রুততম সময়ে সাপ্লাই করতে পারবো।

একটু থেমে আমার আগ্রহী মুখের দিকে তাকিয়ে সাহস পেলেন তিনি। বাঁকা হাসি হেসে বললেন:
-আমাদের যোগাযোগে ২০ বছরের ভার্সিটি ছাত্রী থেকে সব ধরনের মেয়েও আছে। বললেই এনে দিতে পারি। এজন্য অবশ্য পেমেন্ট বেশি লাগবে।

আমি বোকা বোকা গলায় বলি:
-কোনও সমস্যায় পড়বো না তো?

ভদ্রমহিলা একটি মিমি গর্জন দিলেন:
-ছ্যা! কি যে বলেন। কুছ পরোয়া নেহি। আমাদের যারা মালিক, তারা খুবই পাওয়ার ফুল। ক্ষমতার অনেকটাই তাদের দখলে। একদম চিন্তামুক্তভাবে আমাদের এখানে চলে আসুন।

আমি বেশ আশ্বস্ত হয়েছি, এমন গলায় বললাম:
-ওকে ম্যাডাম। আমি কাল আসবো। কাজ করতে করতে একেবারেই ক্লান্ত হয়ে বুড়িয়ে গিয়েছি। কদিন রিলাক্স করা দরকার।

দুষ্টুমিতে ভরা কণ্ঠে মিসেস খোন্দকার বলেন:
-নিশ্চয় আসবেন। আমাদের দরজা সব সময় খোলা। জীবনটাকে এনজয় করতে না পারলে, সেটা আবার কিসের জীবন!

মনে হলো ভদ্রমহিলার নিজের গোপনে রাখা উপভোগের পেয়ালাটিও উপচে পড়বে। আমি আর দেরি না করে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। কে জানে, বেশি আন্তরিক হলে আবার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের ঝাঁপি খুলে যাবে। সে আবেগের তীব্রতা সামলানো কষ্টকর হবে।
‘ফ্রি ফ্রম এডিকশন’ থেকে বের হয়ে ফুটপাতে পা রাখলাম। এই পড়ন্ত বিকেলে কি করা যায়, ভাবছি। হঠাৎ তখনই খেয়াল হলো আমার সামনে দিয়ে অতি চেনা একটি গাড়ি দ্রুতবেগে চলে গেল। পিছন ফিরে দেখি গাড়িটি ‘ফ্রি ফ্রম এডিকশন’-এর গেটে থেমেছে। আরে! এটি তো এনামুলের গাড়ি। গাড়ির দরজা খুলে ব্যস্ততার সঙ্গে রোকসানা নেমে এলো। কোনও দিকে না তাকিয়ে সে গটগট করে ‘ফ্রি ফ্রম এডিকশন’-এর অভ্যন্তরে ঢুকে গেল।

ব্যাপার কী? এখানে এখন রোকসানা কেন? ওর কি কোনও পেশেন্ট আছে? মনের মধ্যে একটি তীক্ষ্ণ কাঁটা খচ করে ঘা দিল। জরুরি কোনও কাজও হাতে নেই। অপেক্ষা করে দেখতে হবে আসল ঘটনা কি? একটি ল্যাম্পপোস্টের আড়ালে দাঁড়িয়ে ‘ফ্রি ফ্রম এডিকশন’-এর গেটের দিকে তাকিয়ে রইলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। পনের-কুড়ি মিনিটের মধ্যে রোকসানা বের হয়ে এলো। একই ব্যস্ততায় গাড়িতে চেপে নিমেষে চলে গেল। আমি কী ‘ফ্রি ফ্রম এডিকশন’-এর ভেতরে গিয়ে খোঁজ নেবো? নাকি ফোন করবো? ফোন করাই ভালো। তাতে কে খোঁজ নিচ্ছে বুঝতে পারবে না। ‘ফ্রি ফ্রম এডিকশন’-এর ব্রুশিয়র দেখে ফোন নম্বর মিলিয়ে রিং করলাম:
-হ্যালো! ‘ফ্রি ফ্রম এডিকশন’।

কণ্ঠস্বর শুনে চিনতে পারছি, রিসিপশনের মেয়েটি ফোন ধরেছে। গম্ভীর কণ্ঠে আমি বললাম:
-রোকসানা  এসেছে? ওকে দাও।

মেয়েটি থতমত খেয়ে বললো:
-তিনি তো এইমাত্র চলে গেলেন। ডাইরেক্টর ম্যাডামের সঙ্গে আলাপ করে আর বসেন নি।
আমি গম্ভীর কণ্ঠে বলি:
-তাহলে মিসেস খোন্দকারকে দাও।

মেয়েটির গলা আরও মিইয়ে গেছে। তার ধারণা ফোনে কথা বলছে কর্তৃপক্ষের কেউ একজন। সে অতি বিনয়ের সঙ্গে বললো:
-আপনি কাইন্ডলি অপেক্ষা করুন স্যার। আমি কানেকশন দিচ্ছি।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মিসেস খোন্দকারের গলা শোনা গেল:
-হ্যালো।

আমি আমার স্বাভাবিক গলায় বললাম:
-মিসেস খোন্দকার, আমি বলছি, কিছুক্ষণ আগে এসেছিলাম। রোকসানাকে দেখলাম আপনার ওখানে। কী ব্যাপার।

হঠাৎ চুপসে গেলে যেমন হয়, তেমন আধ-ভাঙা গলায় আঁতকে ওঠলেন ভদ্রমহিলা:
-আপনি? আপনি কোত্থেকে?

শান্তভাবে উত্তর দিই আমি:
-আমি কাছেই আছি। কী ব্যাপার বলুন তো?

ভদ্রমহিলা অতি চাপা স্বরে বললেন:
-আপনাকে আর কিছুই বলা যাবে না। আপনি এনামুল স্যারের বন্ধু সেটা বলেন নি কেন?

আমি পাল্টা প্রশ্ন করি:
-সেটা বললে কী হতো?

মিসেস খোন্দাকার আগের সুরেই বললেন:
-আমরা সব কথা সবাইকে জানাই না। তিনি আমাদের প্রতিষ্ঠানের অন্যতম মালিক-ম্যানেজিং পার্টনার। আপনি দয়া করে আর আসবেন না। ফোনও করবেন না। আমার চাকরি বাঁচান। আপনার কারণে বড় রকমের বিপদেও পড়তে পারি। আমাকে এখনই অফিস শেষ করতে হবে। আর কথা বলতে পারছি না। বাই।

মিসেস খোন্দকার গট করে ফোন রেখে দিলেন। রোকসানা কী এমন কথা বলেছে যে মহিলা নিমেষেই বদলে গেলেন। কিছুই তো বুঝতে পারছি না। তবে এটা বেশ টের পাচ্ছি, আমার প্রতিটি পদক্ষেপ এনামুলের জানা।

হাত ঘড়িতে সময় দেখছি পৌঁনে পাঁচটা। তার মানে অল্পক্ষণেই অফিস শেষে মিসেস খোন্দকার বের হবেন। তার কথায় সেটার আঁচও পাওয়া গেছে। বেশ। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পুরো ব্যাপারটিই জেনে নেওয়া যাক। জোয়ান দেখে একটি সিএনজি ড্রাইভারকে ডাকলাম:
-তোমাকে ঘণ্টা খানেক আমার সঙ্গে থাকতে হবে? পারবে?

ড্রাইভার জিজ্ঞেস করলো:
-কই যাইবেন স্যার?
আমি নির্লিপ্ত কণ্ঠে উত্তর দিই:
-জানি না।
-জানেন না মানে?

ড্রাইভারের চোখে রাজ্যের বিস্ময়। আমি ইঙ্গিতে ‘ফ্রি ফ্রম এডিকশন’ অফিস দেখিয়ে বলি:
-ওই অফিস থেকে একজন বের হবে। গাড়িতে আসতে পারে। হেঁটেও পারে। তার পিছন পিছন গিয়ে ধরবো। পারবে?

অবাক গলায় ড্রাইভার বলে:
-স্যার কি পুলিশের লোক? গোয়েন্দা?

আমি তাকে আশ্বস্ত করে বলি:
-সেটা জেনে তোমার কাজ নেই। তবে বেআইনি কিছু হবে না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।

ড্রাইভার নিশ্চিত হয়ে বললো:
-আমার কি স্যার! ভাড়া পাইছি, ভাড়া মারুম। ঠিক আছে।

আমি বলি:
-কত নেবে?

ড্রাইভার ছেলেটি কথা বাড়ালো না। বললো:
-পোষাইয়্যা দিয়েন স্যার।

আমিও ভাড়া নিয়ে তর্কে গেলাম না। কাজ হওয়াই আসল। বললাম:
-আচ্ছা। কাজ করতে হবে কিন্তু ঠিক ঠিকভাবে।

সিএনজির ড্রাইভার আমাকে আশ্বাস দেয়:
-কুনু চিন্তা কইরেন না স্যার। আপনি শুধু পথ দেখাইয়্যা যাইবেন। বাকী কাজ আমার।
ড্রাইভার আয়েশ করে একটি সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান দিল। আমি সিএনজির পেছনের সিটে বসে। ড্রাইভারের সঙ্গে ভাব জমানো যাক। আন্ডারস্টান্ডিং ভালো হলে কাজে কোঅরডিনেশন জমবে। আমি আন্তরিক গলায় বলি:
-কি নাম তোমার?

আমার কথায় ছেলেটি খুশি হয়। বলে:
-স্যার সাইফুল।

অপেক্ষার ফাঁকে আমি কথা চালিয়ে যাই:
-বাড়ি কোথায়?

সে-ও আলাপে মজা পাচ্ছে। উৎসাহ নিয়ে বললো:
-বিক্রমপুর।

তার উত্তরে আমি অবাক হই:
-এখনও বিক্রমপুর আছে নাকি? মুন্সিগঞ্জ হয় নি?

সে আমাকে বুঝিয়ে বলে:
-হইছে স্যার। তয় আমরা বিক্রমপুরই বলি।

আমি প্রসঙ্গ বদলে বলি:
-বেশ। শোন সাইফুল, তোমার মোবাইল আছে?

এমন কথা সে যেন আর শোনে নি, এমন মুখভঙ্গি করে বললো:
-কন কি স্যার! আইজকাল ফকির গো হাতেও মোবাইল। মোবাইল ছাড়া একজন ভিখারি বা কাজের বুয়াও আপনি পাইবেন না। আমার আছে দুইডা। এক সেট, দুই সিম।
-আমি তোমার মোবাইল নম্বর রাখতে চাই। প্রয়োজনে ডাকবো। ভাড়ার টাকার জন্য ভাববে না। তোমার আপত্তি আছে?
-একদম না স্যার। আমার আরও বান্ধা পেসেঞ্জার আছে। ফোন করলেই হাজির হই।

ড্রাইভার সাইফুলে মোবাইল নম্বর সেভ করে রাখি। কে জানে, কখন কাজে লাগবে। এনামুলের কাছ থেকে গাড়ি চেয়ে কাজ করা যাবে না। সব ফ্ল্যাশ হয়ে যাবে। সাইফুলের সঙ্গে কথা বলছি আর বার বার  ঘড়ি দেখছি। পাঁচটা পাঁচে ‘ফ্রি ফ্রম এডিকশন’ লিখা সাদা রঙের একটি নোহা মাইক্রোবাস রাস্তায় নেমে এলো। মিসেস খোন্দকারকে দেখা গেল সামনের সিটে বসে আছেন। আরও কয়েকজন স্টাফ আছে পেছনের সিটগুলোতে।

রিসেপশনের মেয়েটিকে ছাড়া কাউকে চিনতে পারছি না। আমি ড্রাইভার সাইফুলকে তাড়া দিলাম:
-চলো। ওই মাইক্রোকে ফলো করো।

সিএনজি এক লাফে মিসেস খোন্দকারের গাড়ির পিছনে চলে এলো। গাড়িটি তেজগাঁ পেরিয়ে মহাখালীর দিকে যাচ্ছে। ওভারব্রিজের নীচে এসে বাঁয়ে মোড় দিয়ে নিউ ডিওএইচএস ঢুকে গেল মাইক্রো। পিছনে আমাদের সিএনজি। এ গলি সে গলি ঘুরে একটি বহুতল এপার্টমেন্টের সামনে মিসেস খোন্দকারকে নামিয়ে মাইক্রোবাস চলে গেল। ততক্ষণে সিএনজিও হাজির। ভদ্রমহিলা বাসার গেটে ঢুকতে যাচ্ছেন। আমি সিএনজি থেকে নামতে নামতে চেঁচিয়ে ডাকলাম:
-মিসেস খোন্দকার! প্লিজ শুনুন।

ভুত দেখলেও অত অবাক হয় না মানুষ। ভদ্রমহিলা তারচেয়েও বেশি অবাক হলেন। আতঙ্কে মনে হচ্ছে তার বিস্মিত চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। ঘোর কাটার আগেই আমি তার পাশে চলে এসেছি। এক ঝটকায় তাকে নিয়ে এপার্টমেন্টের পার্কিং-এর কোণার দিকে চলে এলাম। উত্তেজনা চেপে রেখে বললাম:
-কি হয়েছে বলুন? আমাকে হঠাৎ এড়িয়ে যাচ্ছেন কেন?

সম্বিত ফিরে মিসেস খোন্দকার অস্ফুটে বললেন:
-আপনাকে বারণ করেছি না যোগাযোগ করতে? কেন আমাকে বিপদে ফেলছেন?

ভদ্রমহিলা উত্তেজনায় মৃদ্যু কাঁপছেন। আমি আলতো করে তার একটি হাত আমার হাতে তুলে নিলাম:
-আমার দিক থেকে আপনার কোনও বিপদ হবে না।

মিসেস খোন্দকার এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললেন:
-দেখুন, এই ব্যবসায় জড়িতরা অনেক শক্তিশালী, ভয়ঙ্কর ও নির্মম। রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, সন্ত্রাস থেকে অপরাধ, সর্বত্র তাদের প্রভাব। তারা চান না যে, তাদের ব্যবসার বিষয়-আশয় আপনার কাছে প্রকাশিত হোক। আমাকে সতর্ক করা হয়েছে আপনার কাছে মুখ না খুলতে। যা জেনেছেন, ভুলে যান। আর আমার রেফারেন্স কোথাও দেবেন না। আশা করি এতেই আপনি ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন।

আমিও বেশ বুঝতে পারছি ‘ডাল মে কুছ কালা’। স্বাভাবিক ভাবেই বললাম:
-অবশ্য পেরেছি। আপনাকে ধন্যবাদ মিসেস খোন্দকার।

ভদ্রমহিলা এক লহমায় দৌড় দিয়ে লিফটের ভিতরে চলে গেলেন। দরজা বন্ধ হওয়ার আগে তার সকরুণ চোখ দেখা গেল। আশ্চর্য! বিকেলেই সেই দীপ্ত, যৌবনময়ী চেহারা তার আর নেই। ভীতি মানুষের মন থেকে শরীর পর্যন্ত কঠিন ছাপ এঁকে দেয়। চলবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৬, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

উপন্যাস এর সর্বশেষ