নিউইয়র্ক: নিউইয়র্কের আরো একটি পত্রিকা এ সপ্তাহ থেকে ফ্রি হয়েছে। বিনামূল্যে পাঠক পাচ্ছেন প্রায় শত পৃষ্ঠার ট্যাবলয়েড একটি পত্রিকা।
শুরুটা ফ্রি পত্রিকা দিয়েই। দিন দুয়েক আগে ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই একজন সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধু ফোন করে তার খেদ ঝাড়লেন- ‘আরে ভাই নিউইয়র্কে আর পেশাদার সাংবাদিকের প্রয়োজন নেই!’
কথা শুনে মনে হলো খুব চটেছেন। কেন? জানতে চাইলে তিনিই প্রথম ওই পত্রিকা ফ্রি হওয়ার খবরটি জানালেন, বললেন, ফ্রি কাগজে পয়সা খরচ করে সাংবাদিক কেন? সবাইতো ঢাকার কাগজ থেকে কাট অ্যান্ড পেস্ট!
মনে পড়লো বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরে অনেক আগে প্রকাশিত একটি কলামের কথা ‘সংবাদপত্রগুলোতে কাট পেস্ট সম্পাদক নিয়োগ কবে?’ বন্ধুটিকে বললাম ‘কাট পেস্ট করতেও কিছু যোগ্যতা লাগে... এরা সেই যোগ্যতাটুকুও অর্জন করেছে কিনা তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
কিন্তু দেখলাম বন্ধুটির খেদ কেবল ফ্রি পত্রিকায়ই নয়, তার আরও ক্ষোভ আছে। নিউইয়র্কে একটি বড় গ্রুপ, তার ভাষায় ‘এক দঙ্গল’ সাংবাদিক রয়েছে যাদের এই কাজটি করার সামান্য যোগ্যতাও নেই।
স্বজাতীয়দের নিয়ে সিনিয়র সাংবাদিক বন্ধুটি এতটা চটে যাওয়ায় মনোযোগ বাড়ালাম। তিনি বললেন, এই যে খবর ছাপানোর নামে যারা পয়সা লুটছে তাদের বিষয়টা কি?
নিমেষে কতগুলো মুখ ভেসে উঠলো মনোজগতে। নিউইয়র্কে এমন কতগুলো মুখ রয়েছে যারা বাটপার, প্রতারক হিসেবে নাম কুঁড়িয়েছে, কিন্তু সাংবাদিক লেবাস নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। এদের লেবাস খুব সস্তা দরের। ঢাকার কোনও একটি খ্যাত কিংবা অখ্যাত সংবাদ মাধ্যমের তারা তথাকথিত প্রতিনিধি। এদের আর কিছু প্রয়োজন নেই আছে কেবল একটি নামের প্রয়োজন।
আর সেই নাম বেচে তারা নিউইয়র্কের কোনো সভা-সমিতি-সেমিনারের সামনের সারির আসনে বসার অধিকারী। তাদের পাঠানো খবর মাঝে মধ্যে ঢাকার সংবাদপত্রে ছাপাও হয়ে যায়। ঢাকার সংবাদমাধ্যমে এদের জন্য করুণার যে স্থানটি সংকুলান হয় তাই তারা এখানে বেচে অতি সস্তা দরে। ৫-১০-২০ ডলার হাত পেতে নেয় যাদের খবর ছাপা হয় তাদের কাছ থেকে।
বন্ধুটি এবার বললেন আরেকটি গ্রুপের কথা। এরা নিজেদের ‘প্রেস সেক্রেটারি’ নাম দিয়েছে। একটি প্রচলিত শব্দের অদ্ভুত ব্যবহার দেখি নিউইয়র্কে। এই প্রেস সেক্রেটারি হচ্ছেন তারা, যারা স্রেফ প্রেসে খবর ছাপানোর মধ্যস্ততা করেন।
নিউইয়র্কে কিছু নাম সর্বস্ব সংগঠন রয়েছে। এদের ক্রিয়া-কর্ম একটাই গুটিকয় লোক জড়ো হয়ে সংগঠনের নামে হাতি ঘোড়া, রাজা-উজির মারা। নিউইয়র্কের যারা পেশাদার সাংবাদিক তারা এদের চৌহদ্দিতে পা রাখে না। আর সেই সুযোগ নিচ্ছে প্রেস সেক্রেটারি নামধারীরা। ‘অনেকটা চোরের ওপর বাটপারির মতো’ বন্ধুটি বলে একচোট হাসলেন।
নাম সর্বস্বদের কাছ থেকে অর্থ নিয়ে এই লোকগুলো ঢাকার সংবাদপত্রে খবর ছাপানোর দূতিয়ালী নেয়। আর দুই পক্ষই একে অন্যকে নিয়ে ভাবে- ব্যাটাকে ঠকালাম।
আসলে কে যে কাকে ঠকায় সে প্রশ্ন পরে। কিন্তু আসলে ঠকছে সাংবাদিকতা। মহান এই পেশার চর্চাকে দিন দিন এভাবেই মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে এই প্রতারক মানুষগুলো।
তাদের কাছে সাংবাদিকতা পেশাটি সবচেয়ে লাভজনক। যাদের কোনো কিছুই করার যোগ্যতা নেই, বলার মতো কোনো অতীত নেই, গড়ে তোলার মতো কোনো ভবিষ্যত নেই। তারা শটকাটে সমাজে প্রতিষ্ঠা পেতে এ কাজটি বেছে নিচ্ছে। অর্থ, পরিচিতি, ক্ষমতা, চেয়ার, নিমন্ত্রণ সবত্রই এদেরই কদর।
বিষয়টি একটু খোলাসা করুন, বললাম অগ্রজ সাংবাদিক বন্ধুটিকে।
বললেন, নিউইয়র্কে বিভিন্ন সংগঠন, দেশের প্রবাসের প্রতিষ্ঠানের সভা, সংবাদ সম্মেলন, পথমেলাসহ সব ধরনের কর্মসূচি চুক্তি ভিত্তিতে এরা সফল করে এবং গ্যারান্টি সহকারে তার সংবাদ ও প্রকাশ করে দেশের ও প্রবাসের সংবাদ মাধ্যমে। তবে, এদের দুটি বিশেষত্ব রয়েছে।
এক. এরা স্বঘোষিত (সাংবাদিক!) এবং দুই হচ্ছে, এরা ছবি ছাপা হোক বা সংবাদ ছাপা হোক, কাজের পরে, যাকে বলে কাজ হাসিলের পরে পয়সা নেয়। অর্থাৎ বাকিতে বিশ্বস্ততা প্রমাণ করে। কোন অগ্রিম অর্থাৎ অ্যাডভান্স লাগেনা।
তার কথায় যখন কোন সায় দিচ্ছিলাম না, তিনি ব্যঙ্গ করে উল্টো জানতে চাইলেন কেন আপনি এসব জানেন না!
যা হোক, আলাপ এগালো। বললেন, এরাই তো প্রবাসের গর্ব। মায়ের গর্ভ থেকে কেউ সাংবাদিক হন না ঠিকই, আবার ছোট কাজ বড় কাজ বলেও কিছু ভাবি না, কিন্তু দেশে পেশায় নাপিত, দর্জি, জ্যোতিষ শাস্ত্রে আগ্রহী, পাড়ার পলাতক বাটপার, এমন সব পেশার লোকেরা এদেশে সাংবাদিক বনে গেছেন। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান খুললেও ব্যবসায় এরা ভালো করতেন।
কিন্তু নাম নিয়েছেন ‘সাংবাদিক। ’ কারণ এ পরিচয়টিই কেবল বিশেষ করে ‘গণ আক্রোশ’ থেকে রক্ষা করতে পারে। এছাড়া শটকাটে সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হওয়া যায়। নির্দিষ্ট কোনো কাজ ছাড়াই সারাদিন ঘুরে ফিরে ‘পকেট ও প্যাকেট (লাঞ্চ কিংবা ডিনার)’ দুইয়েরই নিশ্চয়তা থাকে।
কথিত রয়েছে , এরা যে যেখানেই যাবে, এদেরকে খুশি করতে যেকোন ইভেন্টে খানাপিনার ব্যবস্থা পাকা থাকতে হবে, সামনের সারির চেয়ার নিশ্চিত করতে হবে এবং এদের মাইক দিতেই হবে। কারণ এরা ঢাকার সংবাদ মাধ্যমে সংবাদ ছাপতে পারে।
এমনকি কোনো সংবাদ মাধ্যমের নিজস্ব প্রতিনিধি থাকা সত্বেও ঐসব সংবাদ মাধ্যমে উপযাচক হয়েই সংবাদ পাঠায় বিনা পয়সায়। কারণ বেতনের বেশি উপার্জন তাদের নিশ্চিত। আর তাই ঢাকায় যে কোনো নতুন সংবাদ মাধ্যম আত্মপ্রকাশ করলেই এরা প্রতিযোগিতায় নেমে যায় স্বনামে লেখা ছাপিয়ে সাংবাদিক পরিচয় তুলে ধরতে।
সাংবাদিক বন্ধুটির কথায় ইচ্ছা করেই আমি কোনো ধরনের সায় না দিলেও মোটেও নিরুৎসাহিত হলেন না তিনি। বরং আমাকে তার মতের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতেই যেন উঠে পড়ে লাগলেন।
তিনি বললেন, এখানে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে নিয়মিত চুরির দায়ে ধরা পড়া ব্যক্তির পরিচয় সাংবাদিক, মাসের পর মাস একটি বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থেকে উল্টো বাড়ির মালিকের বিরদ্ধে মামলা করা সহ নানা অপকর্মের চিহ্নিত ব্যক্তির পরিচয়ও সাংবাদিক, বাড়ি ভাড়া না দেওয়াসহ প্রতারণার দায়ে লোক সমক্ষে জুতাপেটা হয়েছেন এমন ব্যক্তির পরিচয়ও নিউইয়র্কে সাংবাদিক। আবার তথা কথিত অনুষ্ঠান উপস্থাপকের পরিচয়ও সাংবাদিক।
কিন্তু নানা কুকর্মে ধরা খাওয়ার পর এরা কখনো ৬ মাস কখনো ১ বছর গা ঢাকা দিয়ে থাকেন। কখনো কখনো শহর বদল করে সাংস্কৃতিক কর্মী পরিচয়ে তাদের অপকর্ম অব্যাহত রাখেন। আবার কেউ কেউ কুকর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ এদের মতোই আর কোনো প্রতিষ্ঠানের বড় পদ পুরস্কার পান।
কেউ কেউ নিজেদের দুর্বলতার ভয়ে এদেরকে লালনও করে। ফলে প্রবাসীরা সহজেই নতুন করে আপ্লুত হয়ে পড়েন এদের অব্যহত তোষামোদি ও বিব্র্রতকর স্তুতি বাক্যে।
প্রবাসের কিছু এবং বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংবাদ সম্মেলনে এরা প্রধান ঠিকাদার, ধান্ধালিস্ট।
সাংবাদিকতা পেশার প্রতি নিবেদিত এমন একজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের খেদের সঙ্গে একমত হয়েও কিছুই বলতে পারিনি।
তবে সময় এসেছে এদের বিরুদ্ধে কিছু বলার।
শিহাবউদ্দীন কিসলু, সংবাদকর্মী
বাংলাদেশ সময়: ০১২৫ ঘণ্টা, জুন ০৪, ২০১৪