ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

নববর্ষ সংখ্যা

‘মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব’

সাক্ষাৎকার / বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪
‘মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব’

তরুণ ঘোষ চারুকলা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় থেকে ১৯৭৭ সালে ডিগ্রি নিয়ে মাস্টার্স করেন ভারতের বরোদা থেকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যায় চারুকরায় শিক্ষকতা করেন ১৯৭৯-৮৯ সাল পর্যন্ত।

তারপর বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে ২১ বছরের চাকুরি। বর্তমানে ফ্রিল্যান্স এই শিল্পী ৮ম এশিয়ান আর্ট ভিয়েনালে তার বেহুলা সিরিজের কাজের জন্য পুরস্কৃত হন।   গুণী এই শিল্পী ছিলেন প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রায়। স্বাক্ষাৎকার মোহাম্মদ আসাদ।


প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের সঙ্গে ছিলেন আপনি, কীভাবে যুক্ত হলেন এর সঙ্গে?
ঢাকায় মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে। আমি তখন ভারতের বরদা থেকে মাস্টার্স করে ফিরেছি। তখন লোকশিল্প নিয়ে কাজ করছি। সারা দেশ থেকে লোকশিল্প সংগ্রহ করে চলেছি। এই বিষয়টা তখনকার চারুকলার ছাত্ররা অনেকেই জানতেন। ছাত্রদের সঙ্গে আমার নানা ভাবে যোগাযোগ হতো। এভাবেই যুক্ত হয়ে যাই প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনে। প্রথম বছর কিন্তু মঙ্গল শোভাযাত্রা কথাটি আসেনি। সে বছর পোস্টারে লিখেছিলাম আনন্দ শোভাযাত্রা। তার পরের বছরই মঙ্গল কথাটি যুক্ত হয়। তারপর থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। এখনতো প্রায় সব জেলাতেই মঙ্গল শোভাযাত্রা ছড়িছে পরেছে। চারুকলার শিল্পীরা যার যার জেলায় এই শোভাযাত্রা ছড়িয়ে দিয়েছে।

প্রথম বছর পোস্টারের বিষয় ছিল কি?
প্রথম পোস্টারে ছিল একটি বাঘের মুখোশ। তখনতো আর এতো ডিজিটাল ছিল না। মেনুয়ালে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেই সেই পোস্টার তৈরি করা করি। দুই ধরনের কাগছে পোস্টারটি ছাপা হয়। এই পোস্টার বিক্রয় করে কিছু ফান্ড রাইজ করা হয়েছিল। অপরদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ এলাকা পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় প্রতি বছর নানা রকম থিম নিয়ে আজও একটি করে পোস্টার হয়।

মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ, কেন?
মুখোশ হচ্ছে আদিম লোকশিল্প। আদি থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত পৃথিবীজুড়ে এর চর্চা চলছে। আমাদের দেশেও তাই। কখনও মাঙ্গলিক, কখনও ধর্মীয় অথবা ম্যাজিক বিশ্বাসে মুখোশের উৎপত্তি। মুখোশের  ব্যবহার আমাদের দেশে আগেও ছিল, এখনও আছে। গ্রামেগঞ্জে সং নৃত্য ও নানারকম পূজায় মুখোশের ব্যবহার হয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে। চৈত্র-সংক্রাতিতে মুখোশ পড়ে নৃত্য প্রাচীন ধার্মাচার। আসলে মুখোশ অভিব্যক্তির প্রকার করে। এই বিষয়টি মাথায় রেখেই সে সময় শোভাযাত্রার জন্য কয়েকশ মুখোশ তৈরি করা হয়। সেখানে মুলত বাঘের মুখোশই ছিল বেশি। পেঁচা, মানুষের মুখও ছিল। সেই সময়ে মুখোশ তৈরি করার জন্য প্রথমে আমরা একটা ওয়ার্কসপ করি। তারপর চারুকলার ছাত্র-ছাত্রী সবাই মিলে মুখোশগুলো তৈরি করা হয়।
এখনও কিন্তু নানা ভাবে মুখোশ চর্চা হয়। অনেকেই মুখোশ দেয়ালে ঝুলায় ঘরের শোভা বর্ধনের জন্য। এটা করে দিয়েছে এই মঙ্গল শোভাযাত্রা। এখনতো মুখোশচর্চা হচ্ছে নানাভাবে। মঙ্গল শোভাযাত্রার জন্য দুইভাবেই মুখোশ তৈরি করা হয়। একটি হলো আগে মাটির সাচ তৈরি করে তার ওপর টুকরো টুকরো কাগজ লাগিয়ে মুখোশের সেপ আনা হয়। অন্যটি হচ্ছে কাগজ কেটে কেটে মুখোশ তৈরি করা। তারপর রঙ করলেই হয়ে গেল মুখোশ। এছাড়া নানান মাধ্যম ব্যাবহার করে এখন মুখোশ তৈরি করা হচ্ছে। লোহা, কাঠ, বাঁশ, সিমেন্ট সবই ব্যাবহৃত হচ্ছে মুখোশে। কখনও মিক্স মিডিয়াতেও মুখোশ তৈরি করা হচ্ছে।

মুখোশ ছাড়াও বড় বড় জীব-জন্তু দেখা যায় মঙ্গল শোভাযাতায়, তা কিসের ওপর ভিত্তি করে করা হয়?
মঙ্গল শোভাযাত্রার উপাদানগুলো আমাদের লোকশিল্প থেকে নিয়ে তা বড় আকারে তৈরি করা হয়। আসলে লোকশিল্পের উপাদানগুলো সবসময় সমসাময়িক, সবসময় আধুনিক। প্রতি বছর এই উপাদানগুলো বড় আকারে তৈরি করে সে সময়ের মন্দ বিষয়গুলোকে ঘৃনা, প্রতিবাদ করা হয়। প্রথম শোভাযাত্রার সময় চলছিল শ্বৈরশাসন। বাঘের মাধ্যমে তার প্রতিবাদ জানিয়েছি।

আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রাকে কার্নিভাল বলা চলে?
আমদের শোভাযাত্রা অবশ্যাই কার্নিভাল। হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহন থাকে এখানে। তবে পুথিবীর বড় কার্নিভালগুলো থেকে এটা আলাদা। সেখানে অনেক দল কার্নিভালে তাদের আয়োজন প্রদর্শন করে। আমাদের এখানে এই দায়িত্বে আছে শুধুই চারুকলা। বাকিরা শুধু দেখে। চারুকলা ছাড়াও ঢাকাতেই আরো কয়েটি শোভাযাত্রার আয়োজন আছে। তবে সবই বিচ্ছিন্নভাবে হয়ে থাকে। আশা করি আমাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা বড় কার্নিভালে রূপ নেবে।

আমাদের লোকশিল্প সম্পর্কে আপনার মতামত?
আমাদের লোকশিল্প অনেক উন্নত। এর রয়েছে হাজারও উপাদান। লোকশিল্পের এইসব উপাদান কখনও ধর্মীয় কাজে, কখনও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজে ব্যাবহার হয়ে থাকে। গ্রামীণ জীবনযাত্রায় এইসব উপাদান নিত্যপ্রয়োজনীয়। এই শিল্পটি নিজের জায়গা থেকে অনেক উন্নত, অনেক আধুনিক। গ্রামীণ শিল্পীদের তৈরি এই শিল্পকর্ম রঙে, ফর্মে মানুসের মন জয় করে নেয়।

আমাদের শিল্পকলায় লোকশিল্পের প্রভাব কতটুকু?
আমাদের লোকশিল্পের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় অনেক শিল্পীর কাজেই। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন তার কাজে আমাদের লোকশিল্প, লোকমটিভ ব্যাবহার করেছেন। শিল্পী রশিদ চৌধুরী লক্ষ্ণী সরার ফর্ম নিয়ে কাজ করেছেন। নভেরার ভাস্কর্যে লোকশিল্পের প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়। পটুয়া কামরুল হাসান লোকশিল্পের ফর্ম নিয়ে এঁকেছেন সবচেয়ে বেশি। আমিও কাজ করেছি লোকগাঁথা নিয়ে।

আপনার সংগৃহিত লোকশিল্পগুলো কী অবস্থায় আছে?
আমার সংগ্রহ করা লোকশিল্পগুলো আমার কাছেই আছে। মাটি-শোলার এই কাজ সংরক্ষণ অত্যন্ত কঠিন। আমার সংগ্রহের শতাধিক লোকশিল্প নিয়ে একটি বই করার চিন্তা আছে। আসলে এটা ছিল আমার থিসিস পেপার। ভাল কোন প্রকাশক না পেয়ে সেই বই আর করা হয়নি। লেখা আর লোকশিল্প যেমনি ছিল তেমনিই আছে। আমাদের তো আর গুরুসদয় দত্ত মিউজিয়াম নেই যে, সেখানে রেখে আসব। অবাক লাগে লোকশিল্পের ভাল কোন সংগ্রহশালা নেই। তোফায়েল আহম্মেদ সাহের একটি করেছিলেন, তার মৃত্যুর আগে সেটা দিয়ে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিকে। শুনেছি তারা সেই মূল্যবান সম্পদ অযত্নে  অবহেলায় ফেলে রেখেছে।

মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের কি দিয়েছে?
মঙ্গল শোভাযাত্রা একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব। আগেই বলেছি চারুকলার ছাত্ররা যার যার শহরে ছড়িয়ে দিয়েছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা হাজারও মানুষকে একই কাতারে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে। এই শোভাযাত্রা শুধু একটি র্যালি নয়। এই মুভমেন্ট পরিবর্তন এনেছে মানুষের পোষাক, অলংকার, জীবনযাত্রায়।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

নববর্ষ সংখ্যা এর সর্বশেষ

welcome-ad