ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

নববর্ষ সংখ্যা

বিবেকের বৈশাখি-মঞ্চ ।। মইনুদ্দীন খালেদ

শিল্পকলা / বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৪৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪
বিবেকের বৈশাখি-মঞ্চ ।। মইনুদ্দীন খালেদ অলঙ্করণ: সুমন

আমরা যতখানি সংস্কৃতি চর্চা করি, সংরক্ষণ করি, তার চেয়ে বেশি তা প্রতিনিয়ত হারিয়ে ফেলছি। কৃষিপ্রধান গ্রামনির্ভর বাংলাদেশ কত দ্রুত বদলে যাচ্ছে।

এখন গ্রাম আর শহরের মধ্যে তেমন ফারাক নেই। সময়ের চলমানতায় বিশ্ব ও মহাবিশ্ব সবই বদলে যাবে এটাই স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু প্রকৃতির নিয়মে রূপান্তর আর মানুষের চক্রান্তে বদলে যাওয়া তো আর এক হতে পারে না। ফসলের উৎসবে আর কর্মের সংস্কৃতিতে মুখরিত গ্রামীণ সংস্কৃতির এই অপমৃত্যু তো কখনো কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। বিশ্বায়ন, কর্পোরেট কালচার ও বাজার অর্থনীতি বঙ্গজ সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দিয়েছে। জীবনের প্রয়োজনে এদেশে আমরা যা কিছু তৈরি করেছিলাম তার পেছনে ছিল শিল্পের পরিমার্জনা ও উজানি জীবনবোধ। এখন সবই বিশাল কলকারখানায় উৎপন্ন হচ্ছে। কিন্তু কিছুকাল আগেও পল্লীর প্রায় সব মানুষই তার মননের মধু দিয়ে কিছু একটা বুনতো, গাঁথতো, গড়তো। এখন সে তার প্রয়োজনের জিনিস বাজার থেকে কেনে। এমনকি কোমল পানীয় শুধু নয়, বোতলজাত পানিও কিনে খায় গ্রামের মানুষ।

গ্রামের উৎসব এখন শহরে চলে এসেছে। সব প্রান্তিকজনের সংস্কৃতিতে রঙ চড়িয়ে জাঁকালো উৎসবের ডামাঢোল বাজাচ্ছে রাষ্ট্র তার রাজধানীতে ও বড় শহরে। চৈত্র-সংক্রান্তি আর বৈশাখি উৎসব ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্যতম বিষয়। ফসলের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে আকবর বাদশাহ বাংলা সন গণনা শুরু করেন। এ তথ্য ঐতিহাসিক সত্য হলেও চৈত্রের সংক্রান্তি আর বৈশাখের আগমনে আবাহন-উৎসব যে ইতিহাসপূর্বকাল থেকে বহমান তা সংস্কৃতির ইতিহাস-সচেতন মানুষমাত্রই বুঝতে পারবেন। নৃ-তত্ত্বের বিদ্যার্থী না হলেও বাংলার মাঠে এসে দাঁড়ালেই নাকে এসে লাগে প্রত্ন-পৃথিবীর ঘ্রাণ। মনে প্রশ্ন জাগে, কারা, কবে কোন সুদূর অতীত থেকে কর্ম ও সংস্কৃতি একাকার করে বুঝেছিল জীবন মানে উৎসব— জীবন মানে উজানে বেয়ে চলা— জীবন মানে সকালের সূর্যের দিকে মুখ রেখে কর্মে নিবিষ্ট হওয়ার অঙ্গীকার করা।

মাটির ঘরে মাটির মানুষ— এই প্রবচন আজ বিলুপ্ত। মাটিকে আমরা মা ডেকেছি। কিন্তু সেই মাটি-মাকে আজ আমরা ভুলে গিয়ে কেবলই উৎসবে মেতেছি। গ্রামের উৎসব যে শহরে এসেছে শুধু তা-ই নয়, যেটুকু গ্রাম আছে তা-ও আজ নগরকে নকল করে চলেছে।

নগরের উৎসব অর্থহীন— একথা বলা আমার বিষয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বর্ষবরণ, রমনার বটমূলে ছায়ানটের উৎসব, ধানমন্ডি লেকের পাড়ের অ্যাম্ফিথিয়েটারের নৃত্য-গীত এসবের গুরুত্ব এতটুকু খাটো না করেও বলতে চাই যে বৈশাখি উৎসবকে আমরা সীমায়িত করে ফেলেছি। ঢাকা শহরের কয়েক লক্ষ লোক আজ একটি বটগাছকে লক্ষ্য করে অগ্রসর হচ্ছে, অপরদিকে গ্রাম-বাংলার শত শত বটতলা আজ নিশ্চিহ্ন। এই বটতলাগুলোই ছিল সংস্কৃতিচর্চার উৎস। আমরা লেকের পাড়ে সমবেত হয়েছি, কিন্তু নদীর পাড় ভুলে গেছি। নদী আজও আছে— আছে অদূরেই— তবু নগরকেন্দ্রে সমবেত হয়ে উদযাপন চলছে চৈত্র-সংক্রান্তির ও বৈশাখি মেলার। এজন্য মর্মপীড়া হওয়া কি স্বাভাবিক নয়!

যারা কোনোদিন গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে বসবাস করে ষড়ঋতুর রূপ-বৈচিত্র পঞ্চেন্দ্রিয়ের সজীবতায় অনুভব করেনি, তাদের কাছে এসব উৎসবের গভীরতর তাৎপর্য কি বোঝা সম্ভব! আমার মনে হয় দেশজ, বঙ্গজ বললে সংস্কৃতির যে রূপ ফুটে ওঠে আমরা আদৌ তার দিকে গভীর অভিনিবেশে তাকাইনি। বৈশাখে আমরা অতীতের গ্লানিময় সময়কে ভুলে গিয়ে প্রকৃতি-মাতার নতুন আশীষ প্রার্থনা করি। এ ভাবনার মধ্যে যতখানি আদিমতা আছে ততোধিক আছে আশাবাদ-পুষ্ট জীবন-ভাবনা। গ্রামের মানুষেরা স্বতস্ফূর্ত তাগিদ থেকে ঋতুর রূপান্তরে নানা গান বেঁধে, ছড়া কেটে জীবনের শুভ-অশুভ দ্বান্দ্বিক-সূত্র অনুভব করেছে। লোক সংস্কৃতির প্রধান কর্ম হচ্ছে তা প্রবহমান, সজীব, সচল। তা কোনো কালখণ্ডে আবদ্ধ নয়। তা নদীর মতো বাঁক নেয়। কখনো তা উপরিতল থেকে হারিয়ে গেলেও ফাল্গুধারার মতো মৃত্তিকার গভীরে কল্লোলিত হয়ে চলে। সময়ের প্রয়োজনে তা আবার দৃশ্যমান হয়। তবে লোক-সংস্কৃতির অনেক নদী মরুতে হারিয়ে গেছে। তা কি আর কোনোদিন পথ খুঁজে পেয়ে ফিরে আসবে! এ কান্না নিয়েও নেতির সাগরে ডুবে যেতে চাই না। লোক-সংস্কৃতির প্রধান উৎসব নগরে চলে এলেও তার গুরুত্ব তুচ্ছ করা চলে না। যদিও রাজপথে এসে আবহমান বাংলাকে কংক্রিটের অরণ্যে দাঁড়িয়ে অনুভব করা সম্ভব নয়, তবু এ আয়োজনেও লোকদর্শনের চর্চা রয়েছে।

সহজ ভাবনায় মনে হয় লোক-সংস্কৃতির রাগ নেই; তা শুধু আনন্দময়তায় বিস্তার। কিন্তু সাধারণ জনগোষ্ঠী যে বিবেকের শাসন ও বিবেচনা-বোধ নিয়ে বাঁচে এবং মানব সমাজকে বাঁচিয়ে রাখতে চায় তারই অস্ত্র লোক-সংস্কৃতি। পরনকথা-উপকথা-রূপকথা সব জায়গায় জীবনের মর্মবাণী সংগুপ্ত রয়েছে। লোকগীতি, বিশেষ করে বাউল গানে, জগৎসংসারের অসঙ্গতি ও ভালো-মন্দের সংবাদ যেভাবে সংকীর্তন হয় তা বিদ্যালয়ে মরাল-সায়েন্সে পড়িয়েও সম্ভব নয়। গভীরঅর্থে লোকদর্শনস্নাত মানুষেরাই ’৭১-এর মুক্তি সংগ্রামে যোগ দিয়েছিল। এই দর্শনস্নাত প্রতিবাদী ও প্রতিরোধী সংস্কৃতির চর্চা বৈশাখি আয়োজনে এক নতুন রূপ লাভ করেছে। সব দুঃসময়েই এ সংস্কৃতি অবিনাশি হাতিয়ারের মতো কাজ করেছে। লোকসংস্কৃতি কালের প্রয়োজনে নতুন পরিমার্জনায় নতুন সংস্করণ লাভ করে। আসলে এটাই এ সংস্কৃতির ধর্ম। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচলিত ছড়া বদলে গিয়ে তা সমকালীন হয়ে উঠলো। গ্রামের স্বভাব ছড়াকার লিখলেন—
                              ইলিশ মাছের তিরিশ কাঁটা
                              বোয়াল মাছের দাড়ি
                              টিক্কা খান ভিক্ষা করে
                              শেখ মুজিবের বাড়ি। ।
লোক-সংস্কৃতির স্পর্শমণি স্পর্শ করেই আমরা নতুনকে লাভ করি। যুদ্ধোত্তরকালে স্বপ্নভঙ্গ হলে লোকশিল্পীরা অনেক গান বেঁধেছেন; একজন কামরুল হাসান লোকশিল্পের ভাষায় ছবি এঁকে সব দুষ্টুকালেই প্রতিবাদ জানিয়েছেন। মধ্য সত্তরের দশক থেকে ছদ্ম সামরিক শক্তির রাষ্ট্রের ক্ষমতাদখলের কারসাজিতে এবং পরবর্তী সময়ে মৌলবাদের উত্থানে সংক্ষুব্ধ হয়ে কবি-শিল্পী-সাহিত্যিক সমবেত হয়ে যে যার অস্ত্র নিয়ে সমবেত হয়ে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। ষাটের দশকে আইয়ুব সামরিক জান্তা বঙ্গজ সংস্কৃতি ও রবীন্দ্রনাথকে আঘাত করার কারণে যে প্রতিবাদের জন্ম হয় তা-ই গত অর্ধ-শতাব্দিতে বিরামহীনভাবে নানা বৈচিত্র্যে আরো বিকশিত হয়ে চলেছে। যদিও লোক-সংস্কৃতির স্বতঃস্ফূর্তি এ আয়োজনে আগের মতো নির্ভেজাল নয়। বিশেষ করে যে মঙ্গল-শোভাযাত্রাগুলো হচ্ছে তাতে চারুকলার বিদ্যালয়-শিক্ষিত শিল্পীকূলের সম্পর্ক অনেক বেশি প্রত্যক্ষ। এরসঙ্গে গ্রামীণ লোকশিল্পী, কবি, কবিয়াল, গায়ক বাদকদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের সুযোগটা উন্মুক্ত রাখা সঙ্গত ছিল। তবুও তো সময়ের ভূত ছাড়ানোর জন্য আমরা মুখোশ, আল্পনায় মহোৎসব করে চলেছি। এতে রাষ্ট্র পীড়ন করে তার দুষ্টু কুশীলবরা আতঙ্কিত হয় কি-না, কারো বোধদয় হয় কি-না, তা আমরা কখনো বুঝে উঠতে পারছি না। বৈশাখ শুধু উৎসব নয়, লোকদর্শনঋদ্ধ প্রতিবাদী লোক-সংস্কৃতি, এই উপলব্ধিকে যেন ম্লান করে না দেয় নব অর্থনীতির কূটচাল, কর্পোরেট চোখ ধাঁধানো বিজ্ঞাপন, মানে অর্থ-কামানো। বাংলার বিবেকমঞ্চ বটতলা যেন বিকিয়ে না যায় কর্পোরেট হাউজের জটিল স্থাপত্যে; বৈশাখে এই প্রার্থনা করি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

নববর্ষ সংখ্যা এর সর্বশেষ

welcome-ad