ঢাকা, বুধবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫

নববর্ষ সংখ্যা

বৈশাখি নববর্ষ নিয়ে কিছু বিপরীত চিন্তা ।। আহমদ রফিক

প্রবন্ধ / বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৩৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪
বৈশাখি নববর্ষ নিয়ে কিছু বিপরীত চিন্তা ।। আহমদ রফিক

ইতিহাস চিহ্নিত ‘মহান সম্রাট আকবর’ (আকবর দ্য গ্রেট) নেই, কিন্তু রয়ে গেছে বাংলায় তার রাজস্ব আদায়ের প্রয়োজনে তৈরি বঙ্গাব্দ তথা বাংলাবর্ষ। তার সুবে বাংলা বা নবাবী বাংলা ইংরেজদের রাজনৈতিক টানে খণ্ডিত হয়ে যে ছোটখাট বঙ্গদেশের জন্ম তাও তাদেরই কূটবুদ্ধিতে বিভাজিত হয়ে এবং পাকিস্তানি বন্ধন ছিঁড়ে যে ক্ষুদ্র বাংলাদেশের আবির্ভাব সেখানে আর যাই হোক বাংলা তথা বৈশাখি নববর্ষের উদ্‌যাপন নিয়ে আবেগের কোন কমতি নেই।

অন্তত রাজধানী নাগরিক পরিবেশে বৈশাখি নববর্ষের উদযাপনে বিশাল আয়োজনের ঘনঘটা দেখলে তেমনটাই মনে হবে।

বৈশাখি নববর্ষ পালন আমাদের চোখে ঐতিহ্যবাহী বাঙালিয়ানার প্রকাশ, সে অর্থে জাতীয় সংস্কৃতির প্রকাশ। প্রকাশ যেমন সাংস্কৃতিক বিনোদনে তেমনি বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক দিক বিচারে নববর্ষের হালখাতার বিরাচরিত অনুষ্ঠানে যেখানে ক্রেতাবিক্রেতার নান্দনিক সম্পর্কের উদ্ভাস ঘটে। এ সম্পর্ক মূলত গ্রামবাংলার ঐতিহ্য, পরবর্তীকালের ছোটখাট শহর পেরিয়ে কয়েকদশক ধরে রাজধানীতে বর্ণবিভায় প্রতিষ্ঠিত। অর্থনীতি ও সংস্কৃতির হাত ধরাধরি করে চলা। নেপথ্যে বাঙালিয়ানার চরিত্র প্রকাশ। এ উদযাপন গ্রামে যতই আন্তরিকতার সঙ্গে সম্পন্ন হোক না কেন রাজধানী ঢাকায় বিশাল আয়োজনে, বর্ণাঢ্য নান্দনিকতায় এর মধ্যে মস্ত বড় একটি স্ববিরোধীতা রয়েছে। এবং তা আমাদের জাতীয় চেতনা ঘিরে। যে আবেগের হাত ধরে বর্ষ শুরুর আবাহন প্রীতির সুরে ‘এসো হে বৈশাখ, এসে এসো’ বলে দিনটিকে বরণ করি তা নিতান্তই একদিনের জন্য। পরদিন থেকে শুধু বাকি বৈশাখি দিনগুলোই নয়, গোটা বাংলা বছরটিকে নাগরিক বাঙালি অচেনা শহরে ফেলে মুক্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

বছরের বাকি দিনগুলো চলে খ্রিস্টিয় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, বাংলা বর্ষপঞ্জি নাগরিক বা শহরে জীবনযাত্রায় বর্জিত। তাই আমাদের জাতীয় জীবনের ক্রান্তি দিবসগুলো হয়ে ওঠে একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ বা ষোল ডিসেম্বর। অথচ সে দিনগুলো ভাষিক জাতীয়তা থেকে ভূখণ্ডভিত্তিক জাতীয়তার লড়াইয়ের স্মৃতিচিহ্নিত। তবু বাংলা সনতারিখ সেখানে পরিত্যজ্য।

এর কারণ আর কিছুই নয়, জাতীয় জীবনটাকে আমরা বাঙালি নাগরিক অবাঙালি তথা বিজাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছি। শুধু জড়িয়ে নেওয়া নয় সর্বাঙ্গ ঢেকে ফেলেছি জাগতিক-নান্দনিক সব দিক থেকে। নেপথ্যে প্রায় দুশো বছরের বিজাতীয় শাসনের প্রভাব। এ বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আমরা শিক্ষিত শ্রেণী যুক্তি হাতড়িয়ে নানা অজুহাত বা উপলক্ষ্য তৈরি করে থাকি।

স্বভাবতই সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ প্রশ্ন করতে পারেন: ‘গোটাবছর খ্রিস্টিয় দিনপঞ্জিমাফিক চলার পর একদিনের জন্য বাংলা নববর্ষের পয়লা বৈশাখকে স্মরণ করা কেন?’ যদি এর জবাব বা কারণ হয়ে থাকে বাঙালির সংস্কৃতির ঐতিহ্যে অবগাহন ইত্যাদি, তাহলেও প্রশ্ন : ‘সারাবছর তা নয় কেন? যেমনটি আমরা দেখি গ্রামঞ্চলে শিক্ষিত-অশিক্ষিত মানুষের মধ্যে? যদি এ প্রশ্নের জবাব এমন হয় যে বিশ্বায়নে ছোট হয়ে আসা বিশ্বে আন্তর্জাতিক যোগাযোগের প্রয়োজনে খ্রিস্টিয় বর্ষমাস দিনতারিখ ব্যবহার, তাহলে জাতীয় চেতনার কথা মনে রেখে পাল্টা জবাব হতে পারে, ‘সেক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক প্রয়োজনে বাংলা সনতারিখ নিচে খ্রিস্টিয় সনতারিখ বসিয়ে দিলেই তো বিদেশী যোগাযোগের ল্যাঠা চুকে যায়, জাতীয়বোধও রক্ষা পায়।

কিন্তু না, আমাদের ঐতিহ্যপ্রীতি বা বাঙালিয়ানার আবেগের সুবুদ্ধি আমাদের ততদূর টেনে নিতে পারেনি। স্বভাবতই তেমন পরিপ্রেক্ষিতে মনে হতে পারে, তাহলে পয়লা বৈশাখ ও বাংলা নববর্ষ নিয়ে টানাটানি না করে পয়লা জানুয়ারির নববর্ষ উদযাপন নিয়েই আমরা খুশি থাকি না কেন? বৈশাখ গ্রামীণ বাংলার জন্য তোলা থাক না কেন? বিশেষ করে গ্রামবাংলার মানুষ যখন তাদের প্রাত্যাহিক কাজকর্মে, আচার অনুষ্ঠানে বাংলা সনতারিখ ব্যবহার করে থাকে। তাদেরই মানায় বৈশাখি নববর্ষ পালন।

কিন্তু না, আমরা এ বিষয় না ঘরকা না ঘটকা অবস্থায় রয়েছি। বাঙালি জাতীয়তার কথা, জাতিসত্তার ঐতিহ্যের কথা বলে বৈশাখি নববর্ষ থেকে একাধিক ক্ষেত্রে আবেগের ফুলঝুরি ফোটাই, মাতৃভাষার ক্ষেত্রে একই ধরনের আবেগে ভাসি, কিন্তু স্বাধীন স্বদেশে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বা উচ্চআদালতে ব্যবহারিক ভাষার ক্ষেত্রে মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে ঔপনিবেশিক ভাষাকে ধরে রেখেছি। এমনকি শাসনতান্ত্রিক আচার আচরণে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থাপনা থেকে মুক্ত হতে চাইনি। ভেবে দেখিনি ওই ব্যবস্থা ইংরেজ শাসকগণ করেছিল তাদের উপনিবেশবাদী স্বার্থের প্রয়োজনে এবং তাদের সুখ সুবিধার কথা মনে রেখে।

আশ্চর্য যে দ্বিধাবিভক্ত গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে সর্বত্র হীনমন্যতার প্রকাশ ইংরেজি শাসন ও সংস্কৃতিকে ঘিরে। ভুলতে চাইছি না উপনিবেশবাদী শাসনের কথা। ইংরেজ আমলে পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য পর্ব থেকে পর্বান্তরে আত্মোৎসর্গের যে স্বাধীনতা সংগ্রাম সংঘঠিত হয়েছিল সে স্বাদেশিকতার চেতনার প্রকাশ স্বাধীন স্বদেশে দেখা যাচ্ছে না।

এর কারণ কি এমন হতে পারে যে আমাদের স্বাধীনতার চেতনা নিখাদ ছিল না। আর সেজন্যই বোধহয় এত সংগ্রাম, এত আত্মদানের পরও আপন শক্তিতে স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। সেটা পাওয়া গেছে ইংরেজের সুবুদ্ধির দান হিসেবে। আর তাই বহুকথিত স্বাধীনতা ১৯৪৭ আগস্টে হয়ে দাঁড়ায় ‘ক্ষমতার হস্তান্তর’। ইংরেজ শাসক তার স্বার্থের আংশিক রক্ষার চাতুর্যে দেশীয় রাজনীতিকদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে সসম্মানে ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যায়। অসম্মানের বোঝা তাদের বইতে হয়নি। বরং বিভাজিত ভারতবর্ষ ব্রিটিশ শাসন ও ঐতিহ্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছে।

একেই বলে ইংরেজের বেনিয়াবুদ্ধি! তাই তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক প্রভাব উপনিবেশ ভারতবর্ষে ঠিকই থেকে গেছে ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্তির পরও। শিক্ষা সংস্কৃতি ক্ষেত্রে তা আরো প্রকট। যেমন ভারতে, তেমনি পাকিস্তানে, তেমনি বাংলাদেশে। এমনকি তা শাসন ব্যবস্থায়ও অনেকাংশে লক্ষ করার মতো।

হয়তো এসব কারণেই বাংলাদেশে প্রকট জাতীয়তাবাদী চেতনার তথা বাঙালিয়ানার তাৎক্ষণিক প্রকাশ সত্ত্বেও তা দেখা যায়নি শিক্ষা, সংস্কৃতি, এমনকি শাসন ব্যবস্থার নানাক্ষেত্রে।

পূর্বতন আভিজাত্য-চাপানো গোলামির প্রকাশ সমাজে, রাজনীতিতে বহন করে চলেছি। স্বশাসনে স্বাতন্ত্র্যের যথাযথ বিকাশ ঘটাতে পারিনি। আমাদের কথায় ও কাজে তেমনটাই চোখে পড়ে।

আর সেজন্যই আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীর মানবভুবনে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির অবস্থান গভীর ও স্থায়ী দাগ কাটতে পারেনি। অথচ আমরা জানি, এই শিক্ষিত শ্রেণীই তো আমাদের জাতীয়তাবোধের জন্মদাতা, স্বাধীনতাবোধের তৎপরতার প্রকাশক। কবি সমর সেনের ভাষায় ‘শেকলের বিষবৃক্ষের ফল’ এই শিক্ষিত শ্রেণী, বিশেষ করে এর এলিট উপশ্রেণীই দু-নৌকোর যাত্রী হয়ে জাতীয় জীবনে পিছু হটার কারণ ঘটিয়েছে। এরা প্রাতঃস্মরণীয় সন্দেহ নেই। এদের প্রভাবেই জাতিসত্তার আত্মঅন্বেষণ দিশাহারা, বিভ্রান্ত।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

নববর্ষ সংখ্যা এর সর্বশেষ