ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

নববর্ষ সংখ্যা

মেঘে মেঘে পেরিয়ে গেল ।। লুনা রুশদী

গল্প / বাংলা নববর্ষ বিশেষ সংখ্যা / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৯ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪
মেঘে মেঘে পেরিয়ে গেল ।। লুনা রুশদী অলঙ্করণ: মাহবুবুল হক

আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি...

সকাল বেলায় আকাশ কালো ছিল। বিকালেও।

সন্ধ্যার আগে আগে ঘুম ভেঙে দেখলাম কমলা রঙের সূর্য শেষ হয়ে যাচ্ছে। আমি ভাবলাম সকাল লিখবো, বিকালও লিখবো। মেঘ দেখে আমার খালি খালি লাগা আর ওই কমলা সূর্যটা যে খুব দুঃখী। এর মাঝে কাঁপাকাঁপা কথাগুলো থাকে... নাকি?
     ডোরাকাটা যে তেজি বেড়ালটা দুপুরবেলায় দৃপ্ত লাফিয়ে আসে, যার চোখ দেখলে মনে হয় একটুখানি সূর্য ঢুকে গেছে, তাকানো যায় না, আবার জ্বলজ্বল করে গহীনে কোথাও— তাকে দেখলাম চুপচাপ ঘাসের উপর গোল। সামনের বাড়ির বটল-ব্রাশ ফুলের ডালটা আমাদের বেড়ার এপাশে ঝুঁকে আছে। লাল ফুলে ভর্তি। এক রবিবার কড়ি আর ওর বন্ধুরা টুল নিয়ে ওই ফুল পাড়ছিল বলে আমি মানা করেছিলাম। ওরা আম্মার গাছের লেবুর শরবত বানিয়ে আম্মার কাছেই বিক্রি করলো আর হাসলাম আমরা। রবিবার তো শেষ হয়ে যায়।
     তুমি বলেছিলে ‘ভালোবাসা না...অভ্যস্ততা’। হবে...
     আমি এখন অনভ্যস্ত। তবু তোমার এক লাইনের চিঠিতে যখন লেখো ‘আমি মদ খেয়ে কান্নাকাটি করেছি আর শাহবাগ মোড় দুই ফিট পানির তলায় ডুবে গেছিল...’
আমি জানতে চাই ‘সাঁতড়ায়ে ফিরলা বাড়ি?’
উত্তর তো তুমি দাও না! হয়তো কোনোদিন মাঝরাতে ফোন করে বলতেও পারো ‘আমি তো হারায়ে গেছি আর এখন খুব বৃষ্টি’...

ভোরবেলার ইয়ারা নদী আগের মতন। তখনো আকাশ কালো ছিল। ওই ব্রিজটা পার হয়ে যেতাম আমি। এখন যাই না। একদিন ওই বেঞ্চটায় বসেছিলাম সারা দুপুর। এক জটাধারী বলে গেল পৃথিবী ডুবে যাচ্ছে আর তখনই বাজলো সন্তুর। সুরটা কেমন টলটল করতে করতে ঢুকে গেল আমার পেটের মধ্যে। মনে করলাম, বসেই থাকি, ডুবেই যাব যখন।
     কলিন স্ট্রিটের অফিসটা এত্ত বিশাল! উঁচু সিলিং, আকাশের চেয়েও দূরের মনে হয়। একপাশে কি যেন স্কাল্পচার একটা, খাঁজ কাটা আরো কী সব ভিতরে। ইচ্ছা হচ্ছিল ভালো করে দেখি, দেখলাম না। ওদের পানির বোতলটা খুব সুন্দর, স্বচ্ছ কাঁচের উপর রূপালি ঢাকনা। ‘বাকিংহাম প্যালেস কি এত বিশাল? মানুষ তো পাইপেও থাকে’... ভাবলাম আমি।
     পার হচ্ছিলাম স্টেশনের পর স্টেশন। এখন বসন্তকাল। গাছের পাতাগুলি নতুন আর ফুল রঙিন। এরকম একটা শহরকে চিনতাম, এই শহরটা অন্য।

একটা প্লাটফর্মে স্কুল ফেরতা একজোড়া ছেলেমেয়ে বসেছিল, সিমেন্টের উপরে। দুইজনের দুইপাশে মেরুন রঙের ভারী ব্যাকপ্যাক গড়াচ্ছে। কালো জুতা, সাদা মোজা। সামনে মেলে দেয়া পা। কি অনায়াস! মেয়েটার কালো চুল, রেশমী। কোলের উপর একটা হাত আরেক হাত মেঝেতে ঠেকানো। ওরা ঝুঁকে আছে একে অপরের দিকে, চোখে চোখ। মেয়েটার ঠোঁট কাঁপছিল হালকা, মুখটা হাসি হাসি... পার হয়ে এলাম। ক্লাস টেনে উলরিখ একবার আমাকে ‘এঞ্জেল’ ডেকেছিল।
     ঘরের জানালা। কিছু দেখছিলাম না আমি। ঘুম পাচ্ছিল। কোনো কারণ ছাড়াই মান্না দে’র গানের লাইন মনে আসলো—
‘আমি কি আর ভালো হবো না ডক্টর রয়?
আমাকে আপনি বাঁচিয়ে দিন...
বড্ড ঘুম পাচ্ছে, ভিজিটিং আওয়ার্সে মমতা এলে
প্লিজ ডেকে দেবেন...’
     আকাশে তখনো কালো মেঘ। বৃষ্টি হলো না।

সব কথা বলা হলো...

আজ দুপুর বেলা বাড়িটা ভরাট মানুষে-আসবাবে। গানের সুর আর দুই একটা শব্দ বাতাসে সাঁতার দিতে দিতে পৌঁছে যায় আমার কাছে। আমি শুনি হাসি, ছিটেফোঁটা কথা, শুনি এ ঘর সে ঘর পায়চারি, কারো বাড়িতে কুকুর ডাকছে আর কোথায় যেন শালিক পাখিদের ঝগড়া...আমি শুনি—
যারে চাই সে নাই
আমারও মনের আজ কোনও খোঁজ নাই...
     রান্না হচ্ছে আর সুগন্ধী ধোঁয়া উঠে ছড়িয়ে যাচ্ছে সেইসঙ্গে চায়ের কেতলির হুইসেল। সিনেমায় সৌমিত্রের ট্রেন পার হয়ে যায় স্টেশনের পর স্টেশন, এক শহর ছেড়ে অন্য শহরে—
ফিরবে না কোনোদিন ডেকো না ডেকো না
নতুন আকাশ পেয়ে আজ বুঝি ভুলেছে আমায়...
     অন্য ঘর থেকে পিয়ানোর টুংটাং আর এই ফেব্রুয়ারির দুপুরে ‘সাইলেন্ট নাইট, হোলি নাইট...’। আর সব শব্দ ছাপিয়ে পিয়ানোতে দুপুর বেলার নীরব রাত্রি বেশি সত্যি মনে হয়। ডুবে যাচ্ছি আর আমার ডুবে যাওয়া ধোঁয়ার মতো, গাছের মতন... শিকড় ছড়াচ্ছে কোথায় যে আর মিশে যাচ্ছে বাতাসে। মনে পড়ে সেই সমস্ত দিনের শেষে নেমে আসা সন্ধ্যার কথা। সে কী রকম? একটু আর্দ্র, কান্না মেশানো আর ঠিক বৃষ্টির আগে আগে ধুলার গন্ধের মতন।
ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল...
     জীবন বাবুর চিলেরা কেমন দুখি হয়। তারা কিছু পায় না কোনোদিন। তারা ঠোঁট দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে ফেলে রোদের ঝাঁঝ আর অন্ধকারে হারিয়ে যায়...
হায় চিল, সোনালি ডানার চিল...
     ‘হায় চিল’ কেন? কারণ সোনালি ডানা তো ভ্রম মাত্র, রোদের গন্ধের সাথে মুছে যায়... স্মৃতি থাকে না। তুমি বলতে ‘আমার কিছু মনে থাকে না... আমি স---ব ভুলে যাই’... আমরা হাসতাম।
     এখনো বাজছে সুরটা, শিশিরের শব্দের মতো।

তারার নিচে বাতাস বয়ে যায়...

ঘুম ভেঙে দেখলাম আলো দিতে দিতে ক্ষয়ে যাওয়া চাঁদটাকে একটা মেঘ এসে ঢেকে দিয়েছে। তাকে প্রায় ফুরিয়ে যাওয়া সাবানের মতন লাগছিল। যেনো এভাবেই মেঘে মেঘে, তারায় তারায়, আকাশে বাতাসে নিজেকে ছড়াতে ছড়াতে শেষ হয়ে যাবে। পাখিদের ঘুম ভাঙছে আর আমার ঘরে অবাধে চলে আসছে ভোর মেশানো বাতাস। কিছুটা জ্যোৎস্না কি মিশে আছে বাতাসেও? তাকে এত নরম কেন লাগে? যিশুর হাতের মতন। পাখিদের পাখায় মাখামাখি চাঁদের শরীর উড়ে যায় দূরে দূরে। আমাদের লেবুপাতা, লাউমাচার উপর শুয়ে থাকে শিশিরের সাথে মিলেমিশে। বিষণ্ন কোমল চাঁদটা তাই নাই হয়েও রয়েই যাচ্ছে...
     সেই বোকা গিম্পেল বলেছিল দুনিয়ায় কোনো মিথ্যা নেই। যা আমরা বলি, আমাদের বলার মধ্যেই কিছুটা সত্যি হয়ে যায়। আমাদের ভাবনার ভিতরেও। আমার জীবনে যদি না-ই ঘটে, আর কারো জীবনে ঘটবে। বাস্তবে না হলে, স্বপ্নে। আজ না হলে কাল অথবা অন্য কোনোদিন। এই দেশে না হোক, আরেক দেশে... আমি ভাবি এমনও তো হতে পারে যে আর কারো ভেবে ফেলা, স্বপ্নে পাওয়া দিনগুলোতে আমি বেঁচে আছি। আমি কি অতীত তবে? অন্য কেউ? আমি আছি কিনা এখন, এখানে... কে বলবে? অথচ দেখো আমিও তো কতকিছু ভাবি, স্বপ্ন দেখি। মনে হয় আমারই ভাবনা সেসব, আমারই স্বপ্ন। অথচ সেরকম হয়তো না... অথবা সেরকমও, কারণ সব রকমই তো রকম, সবই সত্যি।

এই ভোরবেলাটা যেমন সেই বিলীন হয়ে যাওয়া চাঁদটাকে সাথে নিয়েই দুপুরের দিকে চলেছে তেমনি তোমার সাথে সাথে আমিও তো আছি। বইমেলার আড্ডায়, চায়ের চুমুকে, সন্ধ্যার অন্ধকারে মিশতে থাকা সিগারেটের ধোঁয়ায়, তোমার প্রেমিকার গায়ের গন্ধে-স্পর্শে, তার নতুন করে পড়া তোমার পুরানো কবিতায়... তোমার অজান্তেই আমি রয়ে যাই...

বাংলাদেশ সময় : ১৭৫৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

নববর্ষ সংখ্যা এর সর্বশেষ