ঢাকা, রবিবার, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

আশ্রয়কেন্দ্র থেকে এসে দেখি বসতঘরের জায়গায় নদী!

মো. নিজাম উদ্দিন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৫৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২২
আশ্রয়কেন্দ্র থেকে এসে দেখি বসতঘরের জায়গায় নদী!

লক্ষ্মীপুর: রাতে যে ঘর রেখে গেছি, সকালে এসে দেখি ঘরের অস্তিত্ব নেই। সেখানে নদী।

ঘরে চাল-ডাল, হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাসন, খাট-টেবিলসহ ব্যবহারিত যত মালামাল ছিল, সবি ভেসে গেছে নদীতে। মেঘনা আমাদের বসতবাড়ি কেড়ে নেবে জানি, তবে একরাতেই যে নিয়ে যাবে সেটা ভাবিনি। জানলে ঘরটা সরিয়ে ফেলতাম। ' 

কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাংলানিউজকে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের রাতের ঘটনা বর্ণনা করলেন মইফুল বিবি নামে এক নারী। তিনি লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার চরফলকন ইউনিয়নের লুধুয়া বাজার সংলগ্ন মজিবুল হক ডাক্তার বাড়ির বাসিন্দা। তার স্বামী নুর আলম পেশায় একজন জেলে।  

গত ২৪ অক্টোবর রাতে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে মেঘনার উপকূলে পানি উঠে যায়। স্বাভাবিকের চেয়ে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পায় ৪ থেকে ৫ ফুট। গভীর রাতের জোয়ারে এত বেশি পানি উঠবে, তা ভেবে পাননি উপকূলের বাসিন্দারা। তাই ঘূর্ণিঝড়ের ৭ নম্বর বিপদ সংকেতেও আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে ঘরেই থেকেছেন তারা। কিন্তু জোয়ারের সময় ঘরে বুক সমান পানি ওঠায় হঠাৎ বেকাদায় পড়েন নদীর তীরবর্তী বাসিন্দারা। ঘরে থাকার অবস্থা ছিল না কারো। ছুটে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন পার্শ্ববর্তী সাইক্লোন শেল্টারে।  

তবে নদীর তীরে যাদের বসতঘর ছিল, তারা পরদিন সকালে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ফিরে এসে দেখেন তাদের বসতঘর নেই। সেখানে ঢেউ খেলছে মেঘনা নদী।  

ঝড় থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারলেও বসতঘর রক্ষা করতে পারেননি তারা। সেই সঙ্গে ঘরে থাকা সব মালামালই নদীর পানিতে ভেসে গেছে।  

কমলনগরে চরফলকন ইউনিয়নের লুধুয়া এলাকায় ঝড়ের রাতে অন্তত ২০টির বেশি বসতঘর মুহূর্তেই নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। আর ঘূর্ণিঝড়ের আগে এবং পরে এক মাসের ব্যবধানে ওই এলাকার কয়েকশ ঘরবাড়ি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। লুধুয়া বাজরটিও এক সপ্তাহের ব্যবধানে নদীতে চলে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।  

ঝড়ের রাতে নদীতে বসতবাড়ি হারানো মইফুল বিবি বলেন, সন্ধ্যার পর থেকে ঝড় শুরু হয়। রাত ১১টার দিকে জোয়ারের পানি ওঠে। একদিকে ঝড়, অন্যদিকে জোয়ারের পানি। তাই ঘরের সবকিছু ফেলে স্বামী এবং দুই সন্তানকে নিয়ে জীবন বাঁচাতে চলে যাই আশ্রয়কেন্দ্রে। ঘরে ব্যবহৃত মালামাল সবকিছুই ছিল। সকালে এসে দেখি ঘরবাড়ি নেই। ঘর থেকে নদী দূরে ছিল। স্বাভাবিক সময়ে হলে আরও এক সপ্তাহ ঘরে থাকতে পারতাম। কিন্তু ঝড়ের কারণে নদী রক্ষুসী হয়ে যায়। এক ঢেউয়ের সঙ্গেই সবকিছু নিয়ে গেছে।  

একই রাতে ঘর হারানো বৃদ্ধ শাহ আলম মাঝি বাংলানিউজকে বলেন, ঝড়ের রাতে তাদের বাড়িতে থাকা চারটি ঘর নদীতে চলে গেছে। ঘরের সব বাসিন্দাই আশ্রয়কেন্দ্রে ছিল। সকালে এসে দেখি ঘরের জায়গায় নদী। এখন আমরা সবাই আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছি। অন্যের ভিটার ওপর পলিথিন দিয়ে ছাপড়া তৈরি করে কোনোভাবে রাত কাটাই। ঘর করার জায়গা নেই। এ বৃদ্ধ বয়সে কোথায় যাব জানি না। সামনে শীত আসছে, পলিথিনের ঘরেও থাকা যাবে না। চোখে মুখে অন্ধকার দেখতেছি। সরকার যদি একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দিত।

একই বাড়ির বাসিন্দা কুলছুম বেগম বলেন, একটা মাছ ধরার নৌকা ছিল, স্বামী সন্তানরা মিলে নদীতে মাছ ধরে সংসার চালাতো। ঝড়ের রাতে জোয়ারের তোড়ে নৌকাটিও ভেঙে যায়। এখন আয়ের উৎস বন্ধ হয়ে গেছে। বসতবাড়িটিও নদীগর্ভে চলে গেছে। অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে আছি।  

ঘর হারানো বিবি আমেনা বলেন, ঘর নিয়ে গেছে মেঘনা। আর যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। পলিথিনের ঘরে থাকতেছি। এভাবে কি বাঁচা যায়? 

বিবি লাইজু বলেন, ঝড়ের রাতে বসতঘরের সঙ্গে পরনের পোশাক পর্যন্ত নদীতে চলে গেছে। ছোট ছোট দুটা সন্তান। তাদের পরানোর মতো কিছু নেই। এক কাপড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গেছি। এখন সেই কাপড়েই আছে। প্রতিবেশীরা তাদের পুরনো কাপড় দিয়ে গেছে, সেগুলো পড়তেছি। ঝড়ের পরে এতদিন হয়ে গেল, আমাদের খবর কেউ রাখে না। চেয়ারম্যান বা মেম্বার, কেউ এসে জিজ্ঞেসও করলো না। কোনো খাদ্য সহায়তা বা অনুদানও পাইনি আমরা।  

উপকূলের বাসিন্দারা জানায়, মেঘনা নদীর তীররক্ষা বাঁধ না থাকায় জোয়ারের পানি খুব সহজেই বসতবাড়িতে ঢুকে পড়ে। জোয়ারের তোড়ে উপকূলে ব্যাপক ভাঙন দেখা দেয়।  

বাংলাদেশ সময়: ২০৪৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৯, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।