ঢাকা, শুক্রবার, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ০৩ মে ২০২৪, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘নিখোঁজদের’ ‘জঙ্গি প্রশিক্ষণ’ দেওয়া হতো দক্ষিণবঙ্গের চরাঞ্চলে

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০২২
‘নিখোঁজদের’ ‘জঙ্গি প্রশিক্ষণ’ দেওয়া হতো দক্ষিণবঙ্গের চরাঞ্চলে

ঢাকা: কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ‘নিখোঁজ’ হওয়া তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ নিতে পটুয়াখালী ও ভোলাসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠায় ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) সংগঠন।  

সংগঠনটি ‘নিরুদ্দেশ’ হওয়া তরুণদের বিভিন্ন সেইফ হাউসে রেখে পটুয়াখালী এলাকায় তাদের বিভিন্ন ব্যক্তির তত্ত্বাবধানে রেখে পটুয়াখালী ও ভোলার বিভিন্ন চর এলাকায় শারীরিক কসরত ও জঙ্গিবাদের বিষয়সহ বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো।

প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়া নতুন সদস্যদের আত্মগোপনে থাকার কৌশল হিসেবে তাদের রাজমিস্ত্রী, রং মিস্ত্রী, ইলেক্ট্রিশিয়ানসহ বিভিন্ন পেশার কারিগরী প্রশিক্ষণও দেওয়া হতো।

বিভিন্ন সময় গ্রেফতার আসামিদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ‘নিরুদ্দেশ’ হওয়া তরুণের সংখ্যা ৫০- এর বেশি। যারা প্রায় দেড় মাস থেকে দুই বছরের বেশি সময় ধরে নিরুদ্দেশ বা নিখোঁজ ছিল বলে জানা গেছে।

সোমবার (১০ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয় সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।  

রোববার (০৯ অক্টোবর) রাতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-১০ এর যৌথ অভিযানে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী ও কেরাণীগঞ্জ এলাকা থেকে ৫ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

গ্রেফতাররা হলেন—সংগঠনের দাওয়াতি ও অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী শাহ মো. হাবিবুল্লাহ ওরফে হাবিব (৩২), নেয়ামত উল্লাহ (৪৩), মো. হোসাইন (২২),  রাকিব হাসনাত ওরফে নিলয় (২৮) এবং (৫) মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে রণি ওরফে জায়দ চৌধুরী (১৯)। তাদের কাছ থেকে ৫টি উগ্রবাদী পুস্তিকা, প্রায় তিনশত লিফলেট এবং ৫টি ব্যাগ জব্দ করা হয়।  

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ (পূর্বাঞ্চলীয় হিন্দের জামাতুল আনসার) সংগঠনের অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী হাবিবুল্লাহ কুমিল্লায় কুবা মসজিদে নামাজ পড়াতেন (ইমামতি)। এছাড়া তিনি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। তিনি ২০২০ সালে নেয়ামত উল্লাহর মাধ্যমে এই সংগঠনে যুক্ত হন। তিনি সংগঠনটির অন্যতম অর্থ সরবরাহকারী ছিলেন। তার নেতৃত্বে কুমিল্লা অঞ্চলে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তিনি সংগঠনের জন্য বিভিন্নভাবে অর্থ সংগ্রহ করতেন ও উগ্রবাদী কার্যক্রমে অর্থ সরবরাহ করতেন। পার্বত্য অঞ্চলের নাইক্ষ্যংছড়িতে তিনি প্রায় ২ বছর ধরে একটি মাদ্রাসা পরিচালনা করে আসছিলেন। তিনি পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছাত্র সংগ্রহ করে তার মাদ্রাসায় রাখতেন।

তিনি বলেন, গ্রেফতার নেয়ামত উল্লাহ কুমিল্লার একটি মহিলা মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতেন। তিনি ২০১৯ সালে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে এই সংগঠনে যুক্ত হন। তিনি সংগঠনের দাওয়াতি কার্যক্রমে যুক্ত থাকার পাশাপাশি নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণদের তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে ছিলেন। বাড়ি ছেড়ে যাওয়া সদস্যদের তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে আশ্রয় দিতেন বলে জানান।

গ্রেফতার হোসাইন পেশায় একজন ইলেকট্রিশিয়ান এবং রং মিস্ত্রী। তিনি স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হন। দীর্ঘ ১ বছর ধরে তিনি সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রমে জড়িত বলে জানা যায়।

অপরদিকে গ্রেফতার রাকিব কুরিয়ার সার্ভিসে ডেলিভারি বয়ের কাজ করতেন। তিনি হোসাইনের মাধ্যমে সংগঠনে জড়িত হন। উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি প্রায় ২ মাস আগে নিরুদ্দেশ হন বলে জানা গেছে।

গ্রেফতার সাইফুল পেশায় একজন রাজমিস্ত্রী। তিনি গত আগস্ট মাসে নোয়াখালী থেকে জঙ্গিবাদে উদ্বুব্ধ হয়ে নিরুদ্দেশ হন। তিনি নোয়াখালীর এক ব্যক্তির মাধ্যমে উগ্রবাদী এই সংগঠনে জড়িত হন বলে জানান।  

খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, প্রাথমিকভাবে কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কোমলমতি তরুণদের সংগঠনের সদস্যরা টার্গেট করতেন। পরবর্তীতে তাদের বিভিন্ন সময় মুসলমানদের ওপর নির্যাতন নিপীড়নের বিভিন্ন ভিডিও দেখানো এবং বিভিন্ন অপব্যাখ্যা দিয়ে উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করতেন। উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ করার পর তাদের বিভিন্ন পর্যায়ের সদস্যরা রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিভিন্ন অনিয়ম, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও বিভিন্ন তাত্ত্বিক জ্ঞান দেওয়ার মাধ্যমে তরুণদের সশস্ত্র হামলার প্রস্তুতি নিতে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিষয়ে উৎসাহী করে তুলতেন। উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রেফতার হওয়া হোসাইন ১ বছর আগে, গ্রেফতার সাইফুল দেড় মাস আগে এবং গ্রেফতার রাকিব ২ মাস আগে নিখোঁজ হন।

র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন সময় গ্রেফতারদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নিরুদ্দেশ হওয়া তরুণের সংখ্যা ৫০ এর অধিক। যারা প্রায় দেড় মাস থেকে দুই বছরের অধিক সময় ধরে নিরুদ্দেশ বা নিখোঁজ ছিলেন বলে জানা যায়। এদের মধ্যে কয়েকজনের পরিবার জানায়, তারা চাকরির জন্য বিদেশে অবস্থান করছেন এবং নিয়মিত পরিবারকে অর্থ পাঠাতেন। প্রাথমিকভাবে সংগঠনের সদস্যদের কাছ থেকে তাদের নাম ও ঠিকানা পাওয়া গেছে; ক্ষেত্র বিশেষে নাম ও ঠিকানায় কিছুটা তারতম্য থাকতে পারে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন সংগঠনের ছত্রছায়ায় দুর্গম অঞ্চলে আত্মগোপনে থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে এবং সংগঠনটির বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রাথমিকভাবে প্রাপ্ত এই তথ্যগুলো দেশের সকল গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন বাহিনীকে জানানো হয়েছে। বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সম্মিলিত অভিযান চলমান রয়েছে।

গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান র‌্যাবের এই কর্মকর্তা।

র‌্যাব জানায়, গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে ৮ তরুণের নিখোঁজের ঘটনা ঘটে। গত ২৫ আগস্ট কুমিল্লার কোতয়ালী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়। র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। তদন্তকালে প্রাথমিকভাবে জানা যায়, জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা গৃহত্যাগ করেছেন। ইতোমধ্যে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত ৬ সেপ্টেম্বর ঘর ছাড়ার প্রস্তুতিকালে ৪ তরুণকে হেফাজতে নিয়ে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয় র‌্যাব। গত ০১ সেপ্টেম্বর কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া ৮ তরুণের মধ্যে শারতাজ ইসলাম নিলয় (২২) নামে একজনকে রাজধানীর কল্যাণপুরের নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। নিলয়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গত ০৬ অক্টোবর মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহ এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে জঙ্গি সংগঠনের দাওয়াতি, তত্ত্বাবধানকারী, আশ্রয় দেওয়ার সঙ্গে যুক্ত ৩ জন ও নিরুদ্দেশ ৪ তরুণসহ মোট ৭ জনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। গ্রেফতার হওয়ার তরুণরা উগ্রবাদী সংগঠনটির সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ১০, ২০২২/আপডেট: ১৭৫৫ ঘণ্টা
এসজেএ/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।