ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

নিষেধাজ্ঞা: সহায়তায় অনিয়ম আর গোপনে মাছ শিকার নিয়ে দুঃশ্চিনায় জেলেরা

মুশফিক সৌরভ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৬ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০২২
নিষেধাজ্ঞা: সহায়তায় অনিয়ম আর গোপনে মাছ শিকার নিয়ে দুঃশ্চিনায় জেলেরা

বরিশাল: মাছের সুরক্ষা ও সংরক্ষণ আইনের অধীনে নিয়মানুযায়ী এ বছর ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমে আগামী ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর ২০২২ (২২ আশ্বিন থেকে ১২ কার্তিক) পর্যন্ত মোট ২২ দিন সারাদেশে ইলিশ মাছ আহরণ, পরিবহন, মজুদ, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

পাশাপাশি মা ইলিশের বিচরণ ও অভিপ্রয়াণ নিরাপদ রেখে প্রজননের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ইলিশের প্রবৃদ্ধি অক্ষুন্ন রাখার জন্য এ বছর সরকার নির্ধারিত ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুমের ওই ২২ দিন দেশের সামুদ্রিক মৎস্য আহরণ এলাকায় সব প্রকার নৌযানের ইলিশসহ সব বা যে কোনো প্রজাতির মৎস্য আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আর এ সময়কালে জেলেদের খাদ্য সহায়তা দেওয়া হবে। যে সহায়তায় পরিবার প্রতি ২০ কেজি হারে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এরইমধ্যে। মৎস অধিদফতরের হিসেব বলছে, গোটা বরিশাল বিভাগে নিষেধাজ্ঞার সময় বরিশাল বিভাগের নিবন্ধিত মা ইলিশ আহরণে সম্পৃক্ত ৩ লাখ ৭১ হাজার ১২১ জেলে পরিবারকে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় ২০ কেজি করে মোট ৬ হাজার ১শ ৪৩ টন চাল দেওয়া হবে।

তবে এ নিষেধাজ্ঞার ফলে অনিবন্ধিত জেলেরা পড়েছেন চরম দুঃশ্চিন্তায়। কারণ নিষেধাজ্ঞার সময় অনিবন্ধিত প্রায় সোয়া লাখ পরিবার পান না কোনো সরকারি সহায়তা। আবার নিবন্ধিত জেলেদের অভিযোগ টাকা না দিলে বরাদ্দকৃত সুবিধা সঠিকভাবে পান না, সেই সঙ্গে কোনো কোনো জায়গায় ২০ কেজির চালের স্থলে পরিমাণে কমও দেওয়া হয়।  

বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের শ্রীপুর এলাকার বাসিন্দা ও জেলে দুলাল জানান, যারা মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে তাদের জেলে কার্ড নেই। অথচ যারা অন্য পেশায় স্বাভাবিকভাবে সংসার চালিয়ে নিতে পারছেন তাদের জেলে কার্ড রয়েছে।  

তিনি বলেন, মোরা জেলে কার্ডের লইগ্যা গ্যালে টাহা চায়। ভোটের লইগ্যা যাগো পূর্বপুরুষরাও কোনোদিন জেলে ছিলো না, হ্যাগো তো ঠিকই কার্ড দেয়। যদিও কয়েকবছর আগে তালিকায় নাম ওঠানোর লইগ্যা মেম্বারে তথ্য নিছিলো কিন্তু আইজ পর্যন্ত চাউল পাই নাই। অথচ যারা মেম্বারের কাছের লোক হ্যারা পাইছে। এহন মাছ ধরমু না চাউলের জন্য মেম্বারের কাছে গিয়া বইয়া থাকমু হ্যা তো বোঝতাছি না। তয় একদিন মাছ না ধরতে পারলে ঘরে যে বাজার হইবে না হ্যা বুঝি।  

অপর জেলে তারেক জানান, নদীতে তেমন একটা ইলিশ ছিলো না এবছরে। তাই তেমন আয়ও করতে পারেননি মৌসুমজুড়ে। হাতে জমা টাকা না থাকায় সামনের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় তার খুব কষ্ট করে চলতে হবে পরিবার-পরিজন নিয়ে। তারওপর তিনি নিবন্ধিত জেলে না হওয়ায় পাননা খাদ্য সহায়তা। কারণ মাছ শিকার করে আদতে তারা জেলে হতে পারেননি।

তারেক বলেন, খাদ্য সহায়তা না পেলেও সরকারি নির্দেশনা মেনেই নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ শিকারে যাইনা। অথচ যারা খাদ্য সহায়তা পায় তাদের দেখি নিষেধাজ্ঞার সময় মাছ শিকার করছে, আবার তা গোপনে বিক্রি করে অর্থও উপার্জন করছে। এদের কার্যক্রম বন্ধ না করতে পারলে দেশের নদীতে ইলিশের সংখ্যা কমে যাবে বলে দাবি তার।

এদিকে বরিশাল ইসলামী কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ইমন, তাকে আড়িয়াল খাঁ নদীতে মাছ শিকার করে সংসার চালাতে হয়। সেই ইমনেরও আগামী ৭ অক্টোবর থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার খবরে চিন্তার ভাঁজ তার কপালে। জানান, ৫ বছর চেষ্টার পরও মৃত বাবার জেলে কার্ডের স্থানে নিজের নাম লেখাতে না পারায় দিশেহারা তিনি।

অপরদিকে সামুদ্রিক জেলেদের দাবি, তাদের অবস্থাও ভালো নয়। আহরণ কম হওয়ায় দাদনের টাকা আর ব্যাংক ঋণ পরিশোধের চিন্তায় দিশেহারা তারা। তার ওপর নিষেধাজ্ঞার সময় ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা বাংলাদেশ সীমানায় ঢুকে সব মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ তাদের।  

জেলেরা বলেন, নিষেধাজ্ঞায় মৎস শিকার বন্ধ না করতে পারলে দেশের অংশে মা ইলিশের বিচরণ নিরাপদ হবে না। আর পরবর্তীতে দেশের অভ্যন্তরীন অভয়াশ্রমগুলোতে মা ইলিশ ডিম দিতে আসতে চাইবে না। এতে ইলিশের প্রজননের পাশাপাশি আহরণও কমে যাবে দেশে।

বরিশাল মৎস আড়তদার মালিক সমিতির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর সিকদার বলেন, প্রজননের এ সময়টাতে বাংলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে ভারত ও মায়ানমারও যদি নিষেধাজ্ঞা দেয় তাহলে সুফল সবাই মিলে ভোগ করতে পারবে। কিন্তু এখন আমাদের দেশে যখন নিষেধাজ্ঞা তখন ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা অবাধে মাছ শিকার করতে পারে। এমনকি আমাদের সীমানায় এসেও মাছ শিকার করে বলে অভিযোগ জেলেদের। এতে মূলত আমাদের দেশের জেলেসহ মৎস সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।

মৎস অধিদফতর বরিশাল বিভাগের উপ-পরিচালক আনিছুর রহমান তালুকদার বলেন, চাল বিতরণে কিছু জায়গাতে অনিয়মের খবর পাওয়া যায়, তবে সেটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমরা এবং প্রশাসন চেষ্টা করছি এগুলোও সমাধান করতে। আর নিষেধাজ্ঞার সময় সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নে মৎস অধিদফতর, নৌ-বাহিনী, কোষ্টগার্ড, নৌ-পুলিশ, র‌্যাবসহ মাঠ প্রশাসন তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করবেন। আশা করি বিগত সময়ের থেকে অভিযান আরও জোরদার হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫১৫ ঘণ্টা, অক্টোবর ০৪, ২০২২
এমএস/এসএ
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।