ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

নদী দিবসে নৌকাডুবি, ৪০ মরদেহের ৪টি একই পরিবারের

শরিফুল ইসলাম, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২
নদী দিবসে নৌকাডুবি, ৪০ মরদেহের ৪টি একই পরিবারের

পঞ্চগড় থেকে: ২৫ সেপ্টেম্বর, নদী দিবস৷ ‘আমাদের জনজীবনে নৌপথ' এই প্রতিপাদ্যকে সামনে নিয়ে দিবসটি পালন করেন পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন। এ দিনেই জেলায় ঘটে ভয়াবহ নৌ দুর্ঘটনা।

 

গতকাল রোববার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে জেলার বোদা উপজেলার ৬ নম্বর মাড়েয়া ইউনিয়নের আওলিয়া ঘাটে এ ভয়াবহ নৌ দুর্ঘটনা ঘটে। একই পরিবারের পাঁচজনের মধ্যে চারজনের মরদেহ পাওয়া গেছে। স্ত্রী, তিন বছর বয়সী সন্তান ও পরিবারের আরও দুই সদস্যকে হারিয়ে নির্বাক হয়ে গেছেন রবিন চন্দ্র। আত্মীয় স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠেছে আশপাশ।
 
চলছে পরিবারে ও এলাকায় শোকের মাতম। জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের হাতিডুবা ছত্রশিকারপুর গ্রামের বাসিন্দা রবিন চন্দ্র। পেশায় তিনি ভাটা শ্রমিক। মহালয়া দেখতে তার পরিবারের পাঁচজন সদস্য আওলিয়া ঘাট থেকে বদশ্বেরী ঘাটে যাচ্ছিলেন। নৌকাডুবিতে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। বেঁচে ফিরেছেন একজন।
 
ভয়াবহ নৌকাডুবিতে রবিনের স্ত্রীর সঙ্গে মারা গেছে তিন বছর বয়সী সন্তান বিষ্ণু রায়, ছোট ভাই কার্তিক রায়ের স্ত্রী লক্ষ্মী রানী (২৫) ও বড় ভাই বাবুল রায়ের ছেলে দীপঙ্কর (৩)। এখন পর্যন্ত ৪০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া মরদেহগুলোর মধ্যে ৩০টি ইতোমধ্যে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকিগুলো শনাক্তকরণ চলছে। দুপুর পৌনে ৩টায়ও উদ্ধার অভিযান চলছে।  

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মহালয়া দেখতে আওলিয়া ঘাট থেকে বদশ্বেরী ঘাটে যাচ্ছিলো নৌকাটি। নৌকাটি ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এতে ১০০ জনেরও অধিক যাত্রী ছিল। ছাড়ার শুরুতেই নৌকাটি দুলতে থাকে। দুলতে দুলতে মাঝপথে গিয়ে নৌকাটি ডুবে যায়। এখন পর্যন্ত ৪০ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। আরও অনেকে এখনো নিখোঁজ রয়েছে।  

বেঁচে ফিরে আসা বিপাশা চন্দ্র বলেন, আমার এক ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে নৌকায় উঠেছিলাম। মাঝখানে গিয়ে নৌকাটা উল্টে যায়। আমি আমার আট মাস বয়সী বাচ্চাটা নিয়ে নৌকার নিচে ডুবে যায়। এক হাত দিয়ে নৌকাটা ধরেছি, আরেক হাত দিয়ে বাবুটাকে বুকে ধরেছি৷ তারপর আর কিছু বলতে পারি না। আমি আর বাচ্চাটা এখন মোটামুটি সুস্থ। মেয়েটাকে খুঁজে পায়নি এখনো।  

নির্বাক রবিন চন্দ্র বলেন, সারাদিন কাজ কাম করে টাকা জমাচ্ছিলাম নতুন কাপড় চোপড় কেনার জন্য৷ সেই টাকা দিয়ে এখন লাশের সৎকার করতে হবে। বাচ্চাটা খুব বায়না ধরেছিল নতুন কাপড় নেবে। আমি বলেছিলাম মহালয়া শেষ হলে তারপর কিনে দেব৷ আমার বাচ্চার আর নতুন কাপড় পড়া হলো না। আমার সব শেষ হয়ে গেল। কি নিয়ে বেঁচে থাকব আমি৷ 

প্রাণে বেঁচে আসা দিপু (১৫) বলে, আমরা মহালয়া দেখার জন্য যাচ্ছিলাম। নদীর মাঝখানে যাওয়ার পর হঠাৎ নৌকা দুলতে দুলতে উল্টে যায়। তারপর আমি নিচে পড়ে যায়। কিছুক্ষণ আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। তারপর সাঁতার কাটলাম। আমি আমার নিজ হাতে তিনটা লাশ উদ্ধার করেছি। আরও কয়েকজনকে বাঁচিয়েছি। বেশি লোক নৌকায় নেওয়ায় নৌকাটা ডুবে যায়। প্রায় একশো জনের বেশি লোক আমরা নৌকায় ছিলাম৷

দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ফরিদুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত আমার ইউনিয়নের আটজনের লাশ পাওয়া গেছে৷ এদের মধ্যে চারজন রবিনের পরিবারের। বিষয়টি আসলে অনেক কষ্টদায়ক।  

৬ নম্বর মাড়িয়া বামহাট ইউনিয়ন পরিষদে নিহতদের সন্ধান নিতে এসেছেন অনেকে।

পঞ্চগড় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তদন্ত কমিটির প্রধান অথৈ থৈ আদিত্য বলেন, ৫ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। সোমবার বিকেলে তারা একটি প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক বরাবর দাখিল করবেন তখন আরও বিস্তারিত বলা যাবে। এখন পর্যন্ত ৪০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। মৃতদের মধ্যে ১৬ নারী, ১০টি শিশু ও সাতজন পুরুষ রয়েছেন।  
 
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক জহুরুল ইসলাম বলেন, নদী দিবসে জেলায় ভয়াবহ নৌকাডুবি। এখনো উদ্ধার অভিযান চলছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহতদের পরিবারের মাঝে ২০ হাজার টাকা করে অনুদান দেওয়া হবে। আর অসুস্থদের চিকিৎসা খরচ বহন করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫০০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২২
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।